শিরোনাম
রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়িতে বিএনপির ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী উদ্যোগে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন ভূমিকম্পে ভয়াবহ বিপর্যয়ে আফগানিস্তান, নিহত বেড়ে ৫০০ স্কুল ও কলেজের ম্যানেজিং কমিটি থেকে বাদ রাজনৈতিক নেতারা রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ির দুর্গম পাহাড়ে সড়ক উন্নয়ন ও শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে সেনাবাহিনী চবি শিক্ষার্থীদের রক্তে ভিজলো জোবরা গ্রাম, আহত শতাধিক, ১৪৪ ধারা জারি ‘মুনিয়ার ঘটনায় তৌহিদ আফ্রিদি রেহাই পেয়েছে পিএম অফিসের জন্য’ আওয়ামী লীগের তিন কালের নয় কাহিনি ৪৮ বছরে বিএনপি, স্বস্তির সঙ্গে আছে শঙ্কাও বৈঠক শেষে বিএনপি ফুরফুরে, জামায়াত-এনসিপি হতাশ নির্বাচন ছাড়া বিকল্প নেই, অন্য কিছু ভাবা বিপজ্জনক: অধ্যাপক ইউনূস

শেয়ার বাজারে গিয়ে ধরা খেলো ৩১ ব্যাংক

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় সোমবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
  • ৫১ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- বাংলাদেশের ব্যাংক খাত আবারও আলোচনায় উঠে এসেছে। মূল ব্যাংকিং কার্যক্রমে তুলনামূলক সুশাসন বজায় রেখেও শেয়ার বাজারে গিয়ে ধাক্কা খেলো ৩১টি ব্যাংক। ২০২৪ সালে সম্মিলিতভাবে তারা লোকসান করেছে প্রায় ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এই লোকসান সরাসরি ‘আনরিয়ালাইজড’—অর্থাৎ শেয়ার বিক্রি না করেও দামের পতনের কারণে পোর্টফোলিওর মূল্য কমেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংকগুলোর শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ যেন অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার মতো। ‘জাঙ্ক স্টক’-এ অযথা ঝুঁকি নেওয়া, দক্ষ পোর্টফোলিও ম্যানেজারের অভাব এবং রাজনৈতিক অস্থিরতায় বাজারের দীর্ঘ পতন—এই তিনটি কারণে ব্যাংক খাত ব্যাপক ধাক্কা খেয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, শেয়ার বাজারে ধাক্কা খাওয়া ৩১টি ব্যাংকের অভিজ্ঞতা ব্যাংক খাতের জন্য একটি বড় সতর্কবার্তা। বাজার ও বিনিয়োগ-নীতির মধ্যে যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে, তা উপেক্ষা করলে ব্যাংকগুলোর ভবিষ্যৎ আরও সংকটে পড়তে পারে।

তাই এখনই প্রয়োজন স্বচ্ছতা, পেশাদার দক্ষতা, এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত বিনিয়োগ কৌশল। না হলে শেয়ারবাজারে ব্যাংক খাতের এই লোকসান একদিন পুরো আর্থিক ব্যবস্থার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর সর্বাধিক ক্ষতি

তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে। জনতা ব্যাংক এককভাবে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা হারিয়েছে। এর বড় অংশ এসেছে বেক্সিমকো সুকুক বন্ড, বাংলাদেশ ফিক্সড ইনকাম ফান্ড, সামিট পাওয়ার ও বেস্ট হোল্ডিংসে বিনিয়োগ থেকে।

জনতা ব্যাংকের পোর্টফোলিওতে আরও রয়েছে ৫০ কোটির বেশি টাকার ‘জাঙ্ক স্টক’, যার মধ্যে এবি ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, পিপলস লিজিং, ফিনিক্স ফাইন্যান্স, প্রাইম ফাইন্যান্স ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের মতো দীর্ঘদিন ধরে সমস্যায় জর্জরিত প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে।

এ ছাড়া সোনালী ব্যাংক ৩৯৮ কোটি, ইস্টার্ন ব্যাংক ৩৫৩ কোটি এবং সাউথইস্ট ব্যাংক ৩২৬ কোটি টাকা লোকসান করেছে। এবি ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংকের লোকসান প্রত্যেকটির ২০০ কোটির বেশি। উত্তরা ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক ও শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ক্ষতি ১০০ থেকে ২০০ কোটির মধ্যে সীমাবদ্ধ।

অপরদিকে বিদেশি ব্যাংকগুলো স্থানীয় শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ না করায় এই ক্ষতি থেকে রেহাই পেয়েছে।

বেক্সিমকো সুকুক: ঝুঁকির ফাঁদ

ব্যাংকগুলোর বিপর্যয়ের কেন্দ্রে রয়েছে বেক্সিমকো গ্রুপের গ্রিন সুকুক বন্ড। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গ্রুপটির মালিক সালমান এফ রহমান গ্রেফতার হন এবং ২০২৪ সালের মাঝামাঝি বাজারে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে সুকুকের দাম প্রায় অর্ধেকে নেমে দাঁড়ায় ৪০ টাকায়।

এছাড়া বহুদিন ধরে সমস্যায় থাকা আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক ও পিপলস লিজিংয়েও কিছু ব্যাংক বিনিয়োগ করেছিল, যা ‘ডুবন্ত জাহাজে চড়ার মতো সিদ্ধান্ত’ বলে অভিহিত করেছেন বিশ্লেষকরা।

বাজার পতনের বাইরেও দায়

২০২৪ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ১,০২৬ পয়েন্ট বা ১৬ শতাংশ কমে যায়। তবে এ পতনই লোকসানের একমাত্র কারণ নয়। এজ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও আলী ইমাম বলেন, “পোর্টফোলিও ম্যানেজাররা মন্দাবাজারেও ভালো পারফরম্যান্স করতে পারেন। আসল সমস্যা হলো, ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনায় দক্ষতার ঘাটতি।”

তার মতে, ব্যাংকগুলো সাধারণত ঋণ পরিচালনায় দক্ষ কর্মকর্তাদের দিয়ে ইক্যুইটি বিনিয়োগ করিয়েছে। “ফলে দেখা গেছে, কর্মকর্তারা এমন শেয়ার কিনেছেন যেখানে ঋণ দেওয়াও সম্ভব নয়। দক্ষতার অভাবে বিনিয়োগ হয়েছে অচল কোম্পানি ও জাঙ্ক স্টকে।”

প্রথমবারের মতো লভ্যাংশ দিতে পারেনি ইসলামী ব্যাংক

একসময় দেশের সেরা বেসরকারি ব্যাংক হিসেবে পরিচিত ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ৩২ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো ২০২৪ সালের জন্য কোনও লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারেনি। চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের ব্যাপক ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে ব্যাংকটিতে বিশাল অঙ্কের প্রভিশন ঘাটতি তৈরি হয়েছে, যা লভ্যাংশ প্রদানে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

২০২৪ সালের শেষে খেলাপি ঋণের বিপরীতে ইসলামী ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬৯ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা। ব্যাংকিং নিয়ম অনুযায়ী, আমানতকারীদের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে সম্ভাব্য খেলাপি ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে মুনাফা থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ আলাদা করে রাখতে হয়, যাকে লোন লস প্রভিশন বলা হয়। ফলে প্রভিশন ঘাটতির কারণে ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার সঠিক চিত্র নেতিবাচকভাবে প্রতিফলিত হয়েছে এবং শেয়ারহোল্ডারদের জন্য লভ্যাংশ ঘোষণা করা সম্ভব হয়নি।

গত ২৬ আগস্ট ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি’র পরিচালনা পর্ষদের সভায় ২০২৪ সালের জন্য শেয়ারহোল্ডারদের কোনও লভ্যাংশ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর প্রথম কয়েক বছর ছাড়া ব্যাংকটি প্রতিবছর লভ্যাংশ দিয়ে আসছিল। এবারই টানা ধারাবাহিকতা ভাঙলো।

উল্লেখ্য, টানা সাত বছর ধরে ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণে ছিল এস আলম গ্রুপ। এই সময়ে ব্যাপক অনিয়ম হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রতিবেদন অনুযায়ী, এস আলম গ্রুপ ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রায় ৭৩ হাজার ১১৩ কোটি টাকা ঋণ বের করে নিয়েছে, যা ব্যাংকের মোট ঋণের প্রায় অর্ধেক। বিভিন্ন নথি অনুযায়ী, এর মধ্যে সরাসরি ঋণের পরিমাণ ৫৬ হাজার ১১৮ কোটি টাকা, পরোক্ষ ঋণ ৭ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা এবং স্বার্থসংশ্লিষ্ট ঋণের পরিমাণ ৯ হাজার ৪৭১ কোটি টাকা।

প্রভিশন ও ব্যতিক্রম

বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে ব্যাংকগুলোকে লোকসান সামাল দিতে প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে বাধ্য করেছে। এতে খাতটি সরাসরি ধস থেকে রক্ষা পেয়েছে। তবে ব্যতিক্রমও আছে। মার্কেন্টাইল ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক ও প্রাইম ব্যাংক—এই তিনটি ব্যাংক শেয়ার বাজারে লাভ করতে সক্ষম হয়েছে।

বাংলাদেশ অ্যাকাডেমি ফর সিকিউরিটিজ মার্কেটসের মহাপরিচালক তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন “ব্যাংকের আসলে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করার কথা নয়। কারণ এর রিটার্ন অনিশ্চিত। শেয়ার বাজার এক ধরনের ভিন্ন সিকিউরিটিজ, যা পরিচালনা করতে হয় প্রশিক্ষিত ও পেশাদার জনবল দিয়ে। বিশেষ করে জাঙ্ক স্টকে ব্যাংকের বিনিয়োগ করা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।”

কেন বারবার একই ভুল?

শেয়ার বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সমস্যার মূল উৎস হলো ‘মালিকানা প্রভাব’। অনেক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বা প্রভাবশালী পরিচালকরা তাদের নিজস্ব বা সম্পর্কিত কোম্পানির শেয়ার কিনতে ব্যাংককে চাপ দেন। এর ফলে ব্যাংকের পোর্টফোলিওতে অকার্যকর কোম্পানির শেয়ার ভরে ওঠে।

তাছাড়া ব্যাংকগুলো নিজেদের ব্যাংকিং কার্যক্রমের মতো ‘গ্যারান্টিড রিটার্ন’-এর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পুঁজিবাজারে প্রবেশ করে, যেখানে মূলত ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তাই প্রাধান্য পায়।

খাতের জন্য সতর্কবার্তা

বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোই শেয়ার বাজারের প্রধান প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী। তাদের পোর্টফোলিও’র দুর্বলতা বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট তৈরি করছে। আলী ইমাম বলেন, “শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করার জন্য আলাদা দক্ষতার প্রয়োজন। এটি ব্যাংকের ট্রেজারি অপারেশনের মতো নয়। সঠিক পেশাদার ছাড়া ব্যাংকগুলো সামনে আরও বড় ক্ষতিতে পড়তে পারে।”

সামনে কী হতে পারে

অর্থনীতিবিদদের মতে, ৩১টি ব্যাংকের এই লোকসান খাতটির তারল্য ব্যবস্থাপনা ও মুনাফা বণ্টনে চাপ সৃষ্টি করবে। দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব পড়বে শেয়ার বাজারেও।

তবে কিছু ইতিবাচক দিকও রয়েছে। ব্যাংকগুলো এখন ‘অসতর্ক বিনিয়োগের ঝুঁকি’ বুঝতে শুরু করেছে। সঠিক শিক্ষা নিলে এবং পেশাদার পোর্টফোলিও ম্যানেজমেন্ট চালু করলে আগামীতে তারা লোকসান ঘোচাতে সক্ষম হতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “ব্যাংকের মূল কাজ ঋণ দেওয়া ও আমানত রক্ষা করা। শেয়ার বাজারে তাদের অতিরিক্ত ঝুঁকি নেওয়া উচিত নয়। নইলে একসময় এ খাতের তারল্য ও স্থিতিশীলতাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে।”ট্রিবিয়ন

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions