ডেস্ক রির্পোটৃ:- বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বিস্তৃত পার্বত্য চট্টগ্রাম—রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি—শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নয়, সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং সংগ্রামেরও একটি ভূখণ্ড। এই পাহাড়ি জনপদে বসবাসকারী বিভিন্ন উপজাতি সম্প্রদায়ের জীবনে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা বঞ্চনা, উন্নয়নবিমুখতা ও নিরাপত্তাহীনতা এখনো অনেকাংশে প্রকট। আর এই সংকটের সবচেয়ে স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি দেখা যায় এখানকার নারীদের জীবনে।
কিন্তু সময় পাল্টেছে। সাহস আর সচেতনতায় ধীরে ধীরে নিজেদের জীবন বদলাচ্ছে পাহাড়ি নারীরা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আত্মনির্ভরতার পথে হাঁটছেন তারা। রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা, সেনাবাহিনীর মানবিক উদ্যোগ ও কিছু সফল নীতির কারণে এই পরিবর্তন সম্ভব হচ্ছে। তবে এর ঠিক বিপরীতে দাঁড়িয়ে উপজাতিদের কিছু সশস্ত্র গ্রুপ, যারা এখনো নারীদের অগ্রযাত্রায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা ভয়ভীতি, নির্যাতন ও দমননীতির মাধ্যমে পাহাড়ি মেয়েদের এগিয়ে যাওয়া ঠেকাতে চায়। অথচ সময়ের দাবি একটাই—সশস্ত্র দমন নয়, আত্মনির্ভরতা চায় পাহাড়ি নারীরা।
🔶শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা: অন্ধকারে আলোর রেখা
একসময় পাহাড়ি মেয়েরা স্কুলে যাওয়া তো দূরের কথা, নিজের নাম লেখতেও জানত না। দুর্গমতার অজুহাতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছায়নি বহু গ্রামে। কিন্তু গত এক দশকে বদলে যেতে শুরু করেছে এই বাস্তবতা। সেনাবাহিনীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে বান্দরবানের রুমা, থানচি, খাগড়াছড়ির গুইমারা বা রাঙামাটির রাজস্থলীর মতো অঞ্চলে গড়ে উঠেছে “আর্মি রান স্কুল”। এখানে পাহাড়ি মেয়েরা মাতৃভাষার পাশাপাশি বাংলা ও ইংরেজি শিখছে। তাদের দেওয়া হচ্ছে পোশাক, বই, পুষ্টিকর খাবার।
সেনাবাহিনী প্রতি মাসে দুর্গম এলাকায় আয়োজন করছে মেডিকেল ক্যাম্প। মা ও শিশুদের জন্য বিনামূল্যে ওষুধ, স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও পরামর্শ দিচ্ছেন সেনা চিকিৎসকেরা। শুধু তাই নয়—গর্ভবতী নারীদের নিরাপদ প্রসব নিশ্চিত করতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করছে তারা।
সরকারের বিভিন্ন সংস্থাও ভূমিকা রাখছে। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ‘নারী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’, সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের ‘স্বাবলম্বী নারী’ প্রকল্প, এবং এনজিওগুলোর সহযোগিতায় পাহাড়ি নারীরা এখন সেলাই, কৃষি, হাঁস-মুরগি পালন ও হস্তশিল্পে দক্ষ হয়ে উঠছে। এসব প্রশিক্ষণ শুধু আয় নয়, দিয়েছে আত্মবিশ্বাস।
🔶পাহাড়ি মেয়েরা এখন রোল মডেল
এই প্রশিক্ষণ, শিক্ষার সুযোগ ও সচেতনতার ফলে অনেক পাহাড়ি নারী আজ নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ স্কুল শিক্ষিকা, কেউ নার্স, কেউ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ের উপজাতি মেয়ে বুনোই আজ গ্রামের কয়েকজন মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে চালাচ্ছে হস্তশিল্প কর্মশালা। রাঙামাটির ঘিলাছড়িতে উপজাতি মেয়ে সোনালী এখন চালাচ্ছে হোমস্টে রিসোর্ট। এই গল্পগুলো এখন শুধু ব্যতিক্রম নয়—এইগুলো পাহাড়ের গোপন বিপ্লব।
🔶 কিন্তু বাধা এখনো ভয়াবহ
এই অগ্রযাত্রার পথ একেবারেই মসৃণ নয়। পাহাড়ে এখনো সক্রিয় কিছু সশস্ত্র উপজাতি সংগঠন, যারা নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে নারীদের উন্নয়নকে বিপদ হিসেবে দেখে। তাদের চোখে শিক্ষিত, আত্মনির্ভর নারী মানে অবাধ্য, নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া এক শক্তি।
এই সংগঠনগুলো ভয় দেখায়—“সরকারি স্কুলে যেও না”, “সেনাবাহিনীর সাহায্য নিও না”, “এটা বাঙালিদের ফাঁদ”। কেউ অমান্য করলে শুরু হয় হুমকি, অপহরণ, এমনকি যৌন হয়রানি ও জোরপূর্বক বিয়ে। একাধিক মেয়ের অভিজ্ঞতা বলে—তারা শুধু স্কুলে যেতে চেয়েছিল, অথচ তাদের বাবা-মাকে প্রকাশ্যে মারধর করা হয়েছে। কেউ কেউ অপহৃত হয়ে আর ফিরে আসেনি।
এরা পাহাড়ি মেয়েদের শুধু নির্যাতনই করে না, তাদের মানবিক পরিচয়কে ধ্বংস করতে চায়। ভয়, লজ্জা আর অপমানের এমন দেয়াল গড়ে যে মেয়েরা আর কোনোদিন উঠে দাঁড়াতে পারে না।
🔶 রাষ্ট্রের জবাব হওয়া উচিত উন্নয়ন
এই বাস্তবতায় রাষ্ট্রের জবাব হওয়া উচিত আরও সুসংগঠিত, মানবিক ও কার্যকর। শুধু নিরাপত্তা নয়—প্রয়োজন পাহাড়ি সমাজের প্রতিটি স্তরে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে, দুর্গম এলাকায় স্থায়ী স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র ও আবাসিক স্কুল চালু করতে হবে।
সেনাবাহিনীর মানবিক কার্যক্রম আরও বিস্তৃত করা দরকার। প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর নেতৃস্থানীয় নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে সমাজকে ভিতর থেকে পরিবর্তনের সুযোগ করে দিতে হবে।
🔶সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি
পাহাড়ি সমাজে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না ঘটলে কেবল অবকাঠামো দিয়ে সমাধান আসবে না। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা, কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধেও সামাজিকভাবে আন্দোলন দরকার। স্থানীয় পুরোহিত, ধর্মগুরু, সমাজপতি—এদের মধ্যে নারীর মর্যাদা নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
🔶 মেয়েরা এখন ভয় নয়, সম্মান চায়
পার্বত্য চট্টগ্রামের মেয়েরা এখন আর ঘরে বসে থাকা নীরব অবলম্বন নয়। তারা এখন নিজের পথ নিজে খুঁজে নিতে চায়। তারা ভয় নয়, সম্মান চায়। চাঁদাবাজির জন্য ব্যবহার নয়, উন্নয়নের অংশীদার হতে চায়। তারা হস্তশিল্প করতে চায়, শিক্ষকতা করতে চায়, সমাজকে নেতৃত্ব দিতে চায়।
🔶শেষ কথা
এই সমাজ, এই রাষ্ট্র আর সময় যেন বুঝে নেয়—পাহাড়ি নারীর জীবন দখল নয়, সহায়তা চায়। নির্যাতন নয়, উন্নয়ন চায়। সশস্ত্র দমন নয়, আত্মনির্ভরতা চায় পাহাড়ি নারী। এই দাবিকে শুধু শোনা নয়—বাস্তবায়ন করতে হবে, যাতে প্রতিটি পাহাড়ি মেয়ের চোখে আলোর প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে।পার্বত্যনিউজ