ডেস্ক রির্পোট:- সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ শত শত জাতিগত বাঙালি মুসলিমকে ‘অবৈধ অভিবাসী’ আখ্যা দিয়ে প্রক্রিয়াগত আইন মানা ছাড়াই বাংলাদেশে বিতাড়ন করেছে। তাদের অনেকেই বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর ভারতীয় নাগরিক। ২০২৫ সালের মে মাস থেকে হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার জাতিগত বাঙালি মুসলিমদেরকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার অপারেশন তীব্র করেছে। বিশেষত আইনি কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া ভারতে প্রবেশ বন্ধ করার জন্য এটা করা হয়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ দীর্ঘ এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলেছে। তারা ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়া এভাবে বেআইনিভাবি লোকজনকে অন্য দেশে ঠেলে দেয়া অবশ্যই বন্ধ করতে হবে সরকারকে।
পরিবর্তে খেয়ালখুশিমতো আটক ও দেশ থেকে বের করে দেয়ার বিরুদ্ধে যথাযথ সুরক্ষামুলক ব্যবস্থা প্রতিজনের জন্য নিশ্চিত করতে হবে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক পরিচালক ইলেন পিয়ারসন বলেন, ভারতীয় নাগরিকসহ দেশ থেকে বাঙালি মুসলিমদের খেয়ালখুশিমতো বের করে দেয়ার মাধ্যমে ভারতে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার বৈষম্যে ইন্ধন দিচ্ছে। তাদের দাবি যে তারা কেবল অনিয়মিত অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ করছে। এ কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ তারা প্রক্রিয়াগত অধিকার, দেশীয় আইন এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডকে উপেক্ষা করছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, জুনে এসব বিষয়ে ১৮ জন ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নেয় হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। এর মধ্যে আছেন ৯টি ঘটনায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা ও তাদের পরিবার। এর মধ্যে আছেন ওইসব ভারতীয় নাগরিক, যাদেরকে বাংলাদেশে জোর করে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল, পরে তারা ভারতে ফিরেছেন। এছাড়া আছেন যেসব ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে তাদের পরিবারের সদস্য। ওই আটক ব্যক্তিরা এখনও নিখোঁজ।
এ নিয়ে ৮ই জুলাই হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের অনুসন্ধান সম্পর্কে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি লেখে। তবে তারা কোনো জবাব দেয়নি। রিপোর্টে আরও বলা হয়, ভারত সরকার এখনো বিতাড়িতদের কোনো সরকারি সংখ্যা জানায়নি। তবে বাংলাদেশের বর্ডার গার্ড জানিয়েছে, ৭ মে থেকে ১৫ জুনের মধ্যে ভারত ১৫ শতাধিক মুসলিম নারী-পুরুষ ও শিশুকে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে। তার মধ্যে প্রায় ১০০ জন মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থী। আটক এসব মুসলিমের বেশির ভাগই দরিদ্র শ্রমিক। আসাম, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, ওড়িশা ও রাজস্থানের বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে পুলিশ সেই মুসলিমদের আটক করে সীমান্তরক্ষীদের হাতে তুলে দিচ্ছে। সীমান্তরক্ষীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা আটক ব্যক্তিদের নাগরিকত্ব যাচাই না করেই মারধর ও হুমকি দিয়ে বাংলাদেশে ঠেলে দিচ্ছে। পরে প্রমাণিত ভারতীয় নাগরিকদের অনেককেই ফের দেশে নিতে হয়েছে। এ অভিযান শুরু হয় এ বছর এপ্রিলে জম্মু ও কাশ্মীরে হিন্দু পর্যটকদের ওপর বন্দুকধারীদের হামলার পর। এরপর পুলিশ মুসলিমদের হয়রানি শুরু করে, নাগরিকত্ব দাবি অগ্রাহ্য করে, ফোন, নথি ও ব্যক্তিগত জিনিসপত্র বাজেয়াপ্ত করে। ফলে তারা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ হারায়।
আসামের বাসিন্দা ৫১ বছর বয়সী সাবেক শিক্ষক খায়রুল ইসলাম জানান, ২৬ মে বিএসএফ তার হাত বেঁধে মুখে কাপড় গুঁজে ১৪ জনের সঙ্গে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠায়। তিনি বলেন, আমি বাংলাদেশে যেতে অস্বীকার করলে বিএসএফ কর্মকর্তা আমাকে পেটায়। চারবার রাবার বুলেট ছোড়ে। দুই সপ্তাহ পর তিনি ভারতে ফিরতে সক্ষম হন। বিজেপি নেতারা বহুবার বাংলাদেশের অভিবাসীদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে অভিহিত করেছেন এবং একই শব্দ ব্যবহার করে ভারতের মুসলিমদেরও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হেয় করেছেন। মে মাসে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রাজ্যগুলোকে নির্দেশ দেয় ৩০ দিনের মধ্যে ‘অবৈধ অভিবাসী শনাক্ত ও বিতাড়ন’ করতে এবং প্রত্যেক জেলায় আটককেন্দ্র গড়ে তুলতে। এরই মধ্যে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের কাছে ২৩৬০ জনের নাম পাঠিয়েছে নাগরিকত্ব যাচাইয়ের জন্য।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৮ই মে ভারতকে চিঠি দিয়ে এই ‘পুশ-ইন’ বা গণবিতাড়নকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ আখ্যা দেয় এবং জানায়, তারা কেবল নিশ্চিত বাংলাদেশি নাগরিকদের সঠিক প্রক্রিয়ায় নেবে। এছাড়াও ভারতীয় কর্তৃপক্ষ প্রায় ১০০ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আসাম থেকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয় এবং আরও ৪০ জনকে মিয়ানমারের সমুদ্রসীমায় লাইফ জ্যাকেট পরিয়ে ভাসিয়ে দেয়। তাদেরকে বলে, সাঁতরে তীরে পৌঁছাতে। মিয়ানমার বিষয়ক জাতিসংঘের স্পেশাল র্যাপোর্টিউর টম অ্যানড্রুজ বলেন, এটা ভয়াবহভাবে আইনের লঙ্ঘন। তিনি একে মানবিকতার পরিপন্থী ও আন্তর্জাতিক ‘নন-রিফাউলমেন্ট’ নীতির লঙ্ঘন বলে উল্লেখ করেছেন।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া কাউকে আটক বা বিতাড়ন করা মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন। সরকারকে অবশ্যই বিতাড়নের কারণ জানানো, আইনগত প্রতিনিধিত্বের সুযোগ, আপিলের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি নিরাপত্তা বাহিনীর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের অভিযোগ তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি দিতে হবে এবং আটক ব্যক্তিদের খাবার, চিকিৎসা, আশ্রয় ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের (নারী, শিশু, বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী) জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখতে হবে।
ইলেন পিয়ারসন বলেন, ভারত সরকার অবৈধ অভিবাসন রোধের নামে হাজারো অসহায় মানুষকে ঝুঁকিতে ফেলছে। মুসলিমদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক নীতি প্রয়োগ করে তারা ভারতের দীর্ঘদিনের শরণার্থী রক্ষার ইতিহাসকে ধ্বংস করছে। ইন্টারন্যাশনাল কোভ্যানেন্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস এবং ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন অন দ্য ইলিমিনেশন অব অল ফর্মস অব রেসিয়াল ডিসক্রিমিনেশনের অধীনে প্রতিজন মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা আছে ভারতের। একই সঙ্গে বর্ণ, গোত্র, জাতীয়তা, বংশগত পরিচয়ের ভিত্তিতে কোনো মানুষকে নাগরিকত্ব বঞ্চিত করা প্রতিরোধ করার বাধ্যবাধকতা আছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া যেকোনো ব্যক্তিকে ভারতের আটক ও তাকে বহিষ্কার করা মৌলিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন। এক্ষেত্রে তাদেরকে পুরোপুরি আইনি প্রক্রিয়া মেনে চলা উচিত। কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে যে, নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা এবং সীমান্তরক্ষীরা যেন অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ না করে। যারা শক্তির অপব্যবহার করেছে বলে অভিযোগ আছে, তাদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বহীন তদন্ত করতে হবে। যারা এর জন্য দায়ী হবেন তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ শৃংখলা ভঙ্গের শাস্তি দিতে হবে অথবা বিচার করতে হবে। যেসব মানুষকে বহিষ্কারের জন্য আটক রাখা হয়েছে তাদেরকে পর্যাপ্ত খাবার, আশ্রয় ও মেডিকেল সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। নারী, শিশু, বৃদ্ধ এবং পঙ্গুসহ প্রান্তিক পর্যায়ে থাকা মানুষদের বিষয়ে দৃষ্টি দিতে হবে সরকারকে।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষের দাবি, তারা বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে প্রবেশ করা লোকজনকে বিতাড়ন করছে। যদিও বিতাড়িতদের মধ্যে কয়েক ডজন বলেছেন তারা বাংলাদেশি নাগরিক, অনেকেই জোর দিয়ে বলেছেন তারা নন। প্রক্রিয়াগত আইন না মানায় বহু ভারতীয় নাগরিক- যাদের বেশির ভাগই বাংলা ভাষাভাষী মুসলিম, অবৈধভাবে তারা বিতাড়িত হয়েছেন। বাংলাদেশ সরকার বারবার বলেছে, ভারতের এ একতরফা পদক্ষেপ বিদ্যমান প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া লঙ্ঘন করছে এবং ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানিয়েছে যেন তারা ‘আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী স্বচ্ছ, যাচাইযোগ্য প্রক্রিয়া’ অনুসরণ করে এসব ঘটনা মোকাবিলা করে। বিতাড়িতদের মধ্যে কমপক্ষে ৩০০ জন আসাম রাজ্যের বাসিন্দা। সেখানে ২০১৯ সালে বিতর্কিত ও ত্রুটিপূর্ণ নাগরিকত্ব যাচাই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গিয়েছে এবং প্রায় ২০ লাখ মানুষকে নাগরিকত্বের তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়। বাকি বিতাড়িতদের অনেকেই বাংলা ভাষাভাষী মুসলিম। তারা কাজের সন্ধানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য থেকে গুজরাট, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, ওড়িশা ও দিল্লিতে গিয়েছিলেন।
আসামের ত্রুটিপূর্ণ নাগরিকত্ব যাচাই প্রক্রিয়া
আসামে দীর্ঘদিন ধরে যেসব বাঙালিকে ‘অ-আদিবাসী’ বা ‘অ-প্রকৃত’ বাসিন্দা সন্দেহ করা হয়, তারা পক্ষপাতদুষ্ট নাগরিকত্ব যাচাই প্রক্রিয়ার শিকার হয়ে আসছেন। ১৯৬৪ সাল থেকে নাগরিকত্ব সংক্রান্ত বিষয়গুলো নির্ধারণ করছে ফরেনার্স ট্রাইবুনালস- যা আধা-বিচারিক আদালত হিসেবে কাজ করে। রাজ্য সরকারের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত এসব ট্রাইবুনাল ১,৬৫,৯৯২ জনকে ‘অবৈধ অভিবাসী’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব ট্রাইবুনালের কাজকর্ম অস্বচ্ছ।
প্রায়শই বাংলা ভাষাভাষী মুসলিমদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক এবং প্রক্রিয়াগত অধিকার লঙ্ঘনকারী তারা। একবার কোনো ট্রাইবুনাল কাউকে নির্দোষ ঘোষণা করলেও, আবার একই বা ভিন্ন ট্রাইবুনালে তার বিরুদ্ধে মামলা করা যায়। এমনকি নথিতে নামের বানান সামান্য অমিল, লিখিত বিবৃতিতে কিছু তথ্য বাদ পড়া, বা সাক্ষ্যে ছোটখাটো অসঙ্গতি থাকলেও নাগরিকত্ব দাবি খারিজ হয়ে যেতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে মানুষকে নিজের বক্তব্য উপস্থাপনের সুযোগও দেয়া হয় না। তাদের অনুপস্থিতিতেই রায় দিয়ে দেয়া হয়। আসামের আইনজীবীরা বলছেন, এটি মূলত হয় কারণ সীমান্ত পুলিশ যথাযথ তদন্ত করে না এবং ভুক্তভোগীদের সময়মতো নোটিশ দেয় না। ১৯৮৫ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০১৯ পর্যন্ত এ ধরনের প্রক্রিয়ায় ৬৩,৯৫৯ জনকে ‘বিদেশি’ ঘোষণা করা হয়েছে।
২০১৯ সালের আগস্টে আসামে পরিচালিত ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনস (এনআরসি) নামক বিতর্কিত ও বৈষম্যমূলক যাচাই প্রক্রিয়া থেকে ১৯ লাখেরও বেশি মানুষ বাদ পড়েন- অনেকেই যারা বহু বছর, এমনকি সারাজীবন ভারতে বসবাস করেছেন আছেন তারাও। বাদ পড়াদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হয় ফরেনার্স ট্রাইবুনালের মাধ্যমে। মে মাসে আসামের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী হিমান্ত বিশ্ব শর্মা স্বীকার করেন, কর্তৃপক্ষ ৩৩০ জন সন্দেহভাজন ‘অবৈধ অভিবাসী’কে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে রাজ্য ফরেনার্স ট্রাইবুনাল ছাড়াই মানুষকে বিতাড়ন করবে, এমনকি তাদের নাম যদি এনআরসি তালিকায় থাকে তবুও। তিনি বলেন, পুশব্যাক চলতেই থাকবে এবং বিদেশি শনাক্তকরণের প্রক্রিয়া, যা এনআরসি-র কারণে থেমে ছিল, আবার দ্রুত শুরু হবে। এবার যদি কাউকে বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, আমরা তাকে ট্রাইবুনালে পাঠাব না; সরাসরি ঠেলে দেব। প্রস্তুতি চলছে।
যদিও তিনি আশ্বাস দেন যে যাদের নাগরিকত্ব সংক্রান্ত আপিল ট্রাইবুনাল বা আদালতে মুলতবি আছে, তাদের বিতাড়ন করা হবে না, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে যে অনেক মুলতবি আপিল থাকা সত্ত্বেও লোকজনকে আটক করে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। বারপেটা জেলার ৫১ বছর বয়সী এক দিনমজুরকে ২০১৪ সালে তার অনুপস্থিতিতে রায় দিয়ে ‘অবৈধ অভিবাসী’ ঘোষণা করা হয়, যদিও তার পরিবারের বাকিরা নয়। তার আপিল সুপ্রিম কোর্টে মুলতবি, তবুও ২৪ মে কর্তৃপক্ষ তাকে আটক করে। দুই দিন পর গভীর রাতে বিএসএফ তাকে বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়ে জোর করে পাঠিয়ে দেয়। তিনি বলেন, আমি মৃত মানুষের মতো বাংলাদেশে ঢুকলাম। ভেবেছিলাম তারা (বিএসএফ) আমাকে গুলি করে মেরে ফেলবে, কেউ জানবেও না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁটার পর তিনি ও আরও পাঁচজন স্থানীয় গ্রামবাসীদের সহায়তায় একটি নদী দ্বীপের মাধ্যমে ভারতে ফেরত আসেন। তিনি দাবি করেন, ভারতীয় বিএসএফ সৈন্যদের উপস্থিতিতে তারা প্রবেশ করলেও কেউ তাদের আটকায়নি। তার আইনজীবী বলেন, এটি সুপ্রিম কোর্টের আদেশের স্পষ্ট লঙ্ঘন। আইনজীবী বলেন, আদালতের আদেশ যাচাইয়ের কোনো পদ্ধতি ছিল না। তিনি জামিনের কোনো শর্ত লঙ্ঘন করেননি।
খায়রুল ইসলামকেও অবৈধভাবে বাংলাদেশে পাঠানো হয়, যদিও তার নাগরিকত্ব সংক্রান্ত মামলা সুপ্রিম কোর্টে মুলতবি। ২০১৬ সালে ফরেনার্স ট্রাইবুনাল তাকে অবৈধ অভিবাসী ঘোষণা করে। ২৩ মে রাতে স্থানীয় পুলিশ মরিগাঁও জেলার বাড়ি থেকে তাকে তুলে নিয়ে যায়। তিনি জানান, তিনি দুই দিন ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ‘নো-ম্যানস-ল্যান্ড’-এ কাটিয়েছেন। তার স্ত্রী বলেন, এক বাংলাদেশি সাংবাদিকের তোলা ভিডিও দেখে তিনি জানতে পারেন তার স্বামী বাংলাদেশে রয়েছেন।
প্রক্রিয়াগত অধিকার লঙ্ঘনের ফলে আসামের বহু পরিবার এখন অসহায়। কারবি আংলং জেলায় ২৩ মে রাতে পুলিশ ৪৫ বছর বয়সী এক ব্যক্তিকে আটক করে। তার পরিবার জানায়, কোনো কারণ জানানো হয়নি। পরিবারটি জানায়, জানুয়ারি ২০২৪-এ ফরেনার্স ট্রাইবুনাল তার পক্ষে রায় দিয়েছিল। কিন্তু তারা যখন ট্রাইবুনালে যান, জানতে পারেন এপ্রিল মাসে তার অনুপস্থিতিতেই নতুন রায় দিয়ে অবৈধ অভিবাসী ঘোষণা করা হয়েছে। পরিবারটি তার অবস্থান জানে না এবং জুনে গৌহাটি হাইকোর্টে আবেদন করেছে।
২৪ মে বারপেটায় পুলিশ মালেকা খাতুনকে (৬৭) আটক করে। তার ছেলে ইমরান আলী খান বলেন, আমি জানি না কীভাবে তাকে ফেরত আনব। তিনি জানান, মালেকা খাতুন চলাফেরায় অক্ষম এবং দৃষ্টিশক্তি দুর্বল। একা অবস্থায় ২৭ মে রাত ৩টার দিকে বিএসএফ তাকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়। ২৯ মে তিনি বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলার কিছু গ্রামবাসীর ফোন ব্যবহার করে ছেলেকে ফোন করেন। তিনি জানান, প্রায় ছয় বছর তিনি কোকরাঝাড় আটককেন্দ্রে কাটিয়েছেন। ২০২৪ সালে জামিনে মুক্তি পান। নয় ভাইবোনের মধ্যে একমাত্র তাকেই অবৈধ অভিবাসী ঘোষণা করা হয়। তার মামলাও গৌহাটি হাইকোর্টে চলছে।
২৫ মে বারপেটায় ৪৪ বছর বয়সী আরেকজনকে আটক করে পরদিন বাংলাদেশে পাঠানো হয়। তার ছেলে জানান, ৩০ মে তিনি বাংলাদেশের জামালপুর জেলা থেকে ফোন করেন, বিএসএফ তাকে বলেছিল, যদি সীমান্ত পেরিয়ে ফেরত আসতে চেষ্টা করে, গুলি করবে। তার ছেলে জানান, তার বাবা তিন দিন হেঁটে রাস্তায় শুয়ে ছিলেন। পরে একটি মসজিদে আশ্রয় পান। পরিবারের একমাত্র সদস্য হিসেবে তাকেই অবৈধ অভিবাসী ঘোষণা করা হয়েছে। তার মামলাও গৌহাটি হাইকোর্টে আপিলাধীন। আসামের আইনজীবীরা বলছেন, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে বহু মানুষকে নির্বিচারে আটক করা হয়েছে। আইনজীবী আমান ওয়াদুদ বলেন, নাগরিকত্ব যাচাইয়ের জন্য একটি সঠিক আইনি প্রক্রিয়া আছে, যেখানে উৎস দেশকে নাগরিকত্ব নিশ্চিত করতে হয়। কিন্তু এখানে মানুষকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, আর কেউ জানে না তারা কোথায় আছে।
২৭ মে ওয়াদুদ ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে অভিযোগ দায়ের করলেও এখনো কোনো সাড়া পাননি। ৫ জুন, ১০০-র বেশি কর্মী, আইনজীবী ও শিক্ষাবিদ ভারত সরকারকে উন্মুক্ত চিঠিতে আহ্বান জানান যে, আসামে এসব বিতাড়ন বন্ধ করতে হবে, কারণ এগুলো জীবন ও সমতার অধিকার লঙ্ঘন করছে। তারা লিখেছেন, পুশব্যাকের ফলে মানুষ চরম বিপদের মুখে পড়ছে। কারণ এতে তারা বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীদের গুলির মুখে বা অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে গ্রেপ্তারের ঝুঁকিতে পড়ছে।
বাংলা ভাষাভাষী মুসলিম অভিবাসী শ্রমিকদের লক্ষ্য করে দমননীতি
বিজেপি-শাসিত কয়েকটি রাজ্য দরিদ্রতায় বসবাসরত বাংলা ভাষাভাষী মুসলিম অভিবাসী শ্রমিকদের ওপর দমননীতি বাড়িয়েছে, তাদের নাগরিকত্ব যাচাই না করেই। মহারাষ্ট্রে, কর্তৃপক্ষ পশ্চিমবঙ্গ (যা বাংলাদেশের সীমানা সংলগ্ন) থেকে আসা অভ্যন্তরীণ অভিবাসীদের আটক ও বাংলাদেশে পাঠিয়েছে। মুম্বইয়ে অন্তত সাতজন পশ্চিমবঙ্গের শ্রমিককে আটক ও বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছিল, যাদের ফিরিয়ে আনা হয় শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার তাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করার পর। ৩৪ বছর বয়সী নাজিমউদ্দিন শেখ, পশ্চিমবঙ্গের এক রাজমিস্ত্রি, পাঁচ বছর মুম্বইয়ে কাজ করার পর ৯ জুন আটক হন এবং বাংলাদেশে পাঠানো হয়। তিনি বলেন, পুলিশ তার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে মোবাইল ফোন নিয়ে নেয় এবং নাগরিকত্ব প্রমাণকারী নথি ছিড়ে ফেলে। এরপর তাকে আরও শতাধিক লোকের সঙ্গে বিএসএফ বিমানে করে ত্রিপুরা (বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন) নিয়ে যায়।
তিনি বলেন, আমরা ভারতীয় বললেও (বিএসএফ) শুনছিল না। বেশি কথা বললে তারা মারছিল। পিঠ ও হাতে লাঠি দিয়ে আঘাত করেছিল। আমাদের মারধর করে বলছিল, আমরা যেন নিজেদের বাংলাদেশি বলি। নাজিমউদ্দিন শেখ জানান, তাকে আটজনের সঙ্গে বাংলাদেশে ঢুকতে বাধ্য করা হয়। বাংলাদেশের এক গ্রামে পৌঁছে স্থানীয়রা তাকে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগে সাহায্য করে এবং সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিবি) কাছে নিয়ে যায়। ১৫ জুন, বিজিবি তাকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে ফিরিয়ে দেয়। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোর সমালোচনা করে বলেন, বাংলা ভাষায় কথা বলা কি অপরাধ? এভাবে আপনি বাংলা ভাষাভাষী সবাইকে বাংলাদেশি বলে প্রমাণ করছেন, লজ্জা হওয়া উচিত।
গুজরাটে, এপ্রিল-মে মাসে সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী, আহমেদাবাদের চান্দোলা লেক ও সিয়াসাত নগর এলাকায় কর্তৃপক্ষ ১০,০০০-এর বেশি স্থাপনা-বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ ধ্বংস করেছে কোনো প্রক্রিয়া ছাড়াই। কর্তৃপক্ষ দাবি করে, এগুলো ছিল ‘অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীদের’ বসতি। এসব ভাঙচুর ২০২৪ সালের নভেম্বরে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায় লঙ্ঘন করে, যেখানে স্পষ্টভাবে বলা আছে, ভাঙচুরের আগে প্রয়োজনীয় আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে।
জুনে জাতিসংঘ মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা এসব ভাঙচুরের নিন্দা করে বলেন, জাতীয় নিরাপত্তা বা বিদেশি নাগরিকত্ব কখনোই কোনো আইনি সুরক্ষা ছাড়া জোরপূর্বক উচ্ছেদের অজুহাত হতে পারে না।
এই অভিযানের অংশ হিসেবে আহমেদাবাদে ৮৯০ জনকে আটক করা হয়, যার মধ্যে ২১৯ জন নারী ও ২১৪ জন শিশু। তাদের শহরের রাস্তায় চার কিলোমিটার হাঁটিয়ে প্রকাশ্যে শোভাযাত্রা করানো হয়। গুজরাট কর্তৃপক্ষ জানায়, তারা রাজ্যজুড়ে প্রায় ৬,৫০০ জনকে আটক করেছে এবং সতর্ক করে দেয়, যে কেউ অনুপ্রবেশকারীদের আশ্রয় বা সহায়তা দেবে, কঠোর শাস্তির মুখে পড়বে।
৩ মে, পশ্চিমবঙ্গ অভিবাসী শ্রমিক কল্যাণ বোর্ডের সভাপতি ও সংসদ সদস্য সমীরুল ইসলাম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে চিঠি দিয়ে লেখেন, ‘বহু ক্ষেত্রে, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা বাসিন্দাদের গুজরাটে বৈধ পরিচয়পত্র থাকা সত্ত্বেও আটক করা হচ্ছে। আরও ভয়াবহ হলো, সম্পূর্ণ বাংলা ভাষাভাষী বসতিগুলো লক্ষ্য করে হামলা চালানো হচ্ছে, পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, যার ফলে গুরুত্বপূর্ণ নথি ধ্বংস হচ্ছে এবং পরিবারগুলো জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হচ্ছে।’