শিরোনাম

আওয়ামী আমলে নিয়োগ পাওয়া মানহীন শিক্ষকদের কী হবে

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৪ জুলাই, ২০২৫
  • ৬০ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে দেশের সর্বত্রই ছেয়ে ছিল অনিয়ম-দুর্নীতিতে। আর এই দুর্নীতির বড় ঢেউ লেগেছিল দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। স্বৈরাচার সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে দেশের সর্বোচ্চ এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক নিয়োগে চরম অনিয়ম-দুর্নীতি, দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতির যেন মহোৎসব ঘটে। যোগ্য ও মেধাবীদের বাদ দিয়ে তুলনামূলক কম মেধাবী বা মানহীন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিরাটসংখ্যক এই মানহীন শিক্ষকের বোঝা নিয়ে ধুঁকছে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলো। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সূত্রমতে, ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ১৪ বছরে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ৮ হাজার ৭৯ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়, যার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ আছে।

সূত্রমতে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী ন্যূনতম যোগ্যতা থাকলে কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করলেই যে কাউকে নিয়োগ দিতে পারেন। মেধাবীদের শিক্ষক নিয়োগের কোনো নিশ্চয়তা নেই। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে দলীয় প্রভাব, স্বজনপ্রীতি বা মোটা অঙ্কের আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে পছন্দের লোকদের নিয়োগ দেওয়া হয়। অনেক সময় নিয়োগের শর্ত বা যোগ্যতাও শিথিল করা হয়। দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, বিভাগীয় চেয়ারম্যান, সিন্ডিকেট সদস্যসহ নিয়োগ বোর্ড-সংশ্লিষ্টরা মিলেমিশে এসব দুর্নীতি করেন।

এতে একদিকে যেমন মেধাবীরা তাদের কাঙ্ক্ষিত চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোরও দক্ষ শিক্ষক হাতছাড়া হয়। দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের নৈতিকতা এবং তাদের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত গ্রাজুয়েট তৈরির সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্ট মহলে। তাছাড়া এসব দলীয় প্রভাবে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকরাই পরে পতিত স্বৈরাচারী সরকারের সহযোগী হিসেবে নানা ভূমিকা রাখেন। এমনকি গত বছরের জুলাই-আগস্টে সংগঠিত ছাত্র আন্দোলনে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রকাশ্য বিরোধিতা এবং গণহত্যার নির্দেশদাতা স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পক্ষে তৎপরতা চালানোর খবর পাওয়া যায়।

৫ আগস্ট পরবর্তী পরিস্থিতিতে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এসব দলবাজ ও মেধাহীন শিক্ষকদের নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে নতুন করে ভাবনা শুরু হয়েছে। এরইমধ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে।

শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, আওয়ামী লীগের সময়ে ঢুকে পড়া মানহীন শিক্ষকদের মান যাচাই এবং দুর্নীতি-অনিয়ম তদন্ত করতে একটি কমিশন করা জরুরি। একই সঙ্গে মানহীন শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ ছাড়া আগামীতে মেধাবী শিক্ষক নিয়োগের নিশ্চয়তা পেতে একটি সার্বজনীন নীতিমালা জরুরি বলেও মন্তব্য করেন কেউ কেউ।

আওয়ামী আমলের মানহীন শিক্ষকদের বিষয়ে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক এসএমএ ফায়েজ বলেন, সব বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কোথাও কোনো অনিয়ম হয়েছে কি না সে বিষয়গুলো খতিয়ে দেখার দায়িত্ব তাদের।

ইউজিসির সর্বশেষ প্রকাশিত ৪৯তম বার্ষিক প্রতিবেদন (২০২২ সালের তথ্যের ভিত্তিতে ২০২৩ সালের অক্টোবরে প্রকাশ) সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত ও অঙ্গীভূত কলেজের শিক্ষক ব্যতীত ২৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের সংখ্যা ছিল মাত্র ৮ হাজার ৩২০ জন। এর মধ্যে অধ্যাপক দুই হাজার ৫২৪ জন, সহযোগী অধ্যাপক এক হাজার ৩৯৮ জন, সহকারী অধ্যাপক দুই হাজার ৭০৯ জন, প্রভাষক এক হাজার ৬৪৪ জন এবং অন্যান্য ৪৫ জন।

২০২২ সালে ৫৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে (অধিভুক্ত ও অঙ্গীভূত কলেজ/অধিভুক্ত ও অঙ্গীভূত মাদরাসা ব্যতীত) শিক্ষক সংখ্যা দাঁড়ায় ১৬ হাজার ৩৯৯ জন। এর মধ্যে অধ্যাপক ৫ হাজার ২২৭ জন, সহযোগী অধ্যাপক ৩ হাজার ৯৮ জন, সহকারী অধ্যাপক ৫ হাজার ৫৩৮ জন, প্রভাষক ২ হাজার ১৫৫ জন এবং অন্যান্য ৩৮১ জন। অর্থাৎ এই ১৪ বছরে ৮ হাজার ৭৯ জন শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছেন। এরপরও ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিপুলসংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ করা হয়।

শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির বিশেষ রেকর্ড সৃষ্টি করে প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। দলীয়করণ এবং উপাচার্যের পছন্দের ব্যক্তিকে শিক্ষক নিয়োগ দিতে শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল করার পাশাপাশি বিজ্ঞপ্তির অতিরিক্ত নিয়োগ করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে। এমনকি বিজ্ঞপ্তি ছাড়া এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি না থাকা প্রার্থীরাও নিয়োগ পেয়েছেন। সূত্র মতে, ২০০৯ সালে নিয়োগ পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সাড়ে ৮ বছর মেয়াদেই মোট ৯০৭ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। এসব নিয়োগে শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল, যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দেওয়া, ন্যূনতম যোগ্যতা পূরণ না করেই নিয়োগ পাওয়া এবং বিজ্ঞপ্তির চেয়ে অতিরিক্তসংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। একইভাবে পরবর্তী সময়েও শিক্ষক নিয়োগে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে।

যদিও ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম হয়ে থাকলে তা তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এ লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ সিন্ডিকেট ১৭ মার্চ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। আওয়ামী লীগের শাসনামলে কোনো শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতি সংক্রান্ত অনিয়মের অভিযোগ থাকলে তা লিখিত আকারে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে ওই তদন্ত কমিটি। তথ্য-প্রমাণসহ অভিযোগ দাখিলের শেষ সময় নির্ধারণ করা হয়েছে আগামী ২৫ জুলাই। অভিযোগ পাঠাতে হবে তদন্ত কমিটির সদস্য-সচিব ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার বরাবর। ২৬ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দফতরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রাক্তন শিক্ষক, প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি যথাযথ তথ্য উপস্থাপনের আহ্বান জানানো হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানিয়েছে, তদন্ত কার্যক্রমে গোপনীয়তা নিশ্চিত করা হবে এবং তথ্যদাতার পরিচয়ও সংরক্ষিত রাখা হবে। অভিযোগ যাচাই-বাছাই শেষে যথাযথ প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানানো হয়েছে।

জানা গেছে, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) মোট ৪০৮ জন শিক্ষকের মধ্যে পতিত আওয়ামী সরকারের আমলেই নিয়োগ পেয়েছেন ১৮২ জন। পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগ দিতে অনেক ক্ষেত্রে শর্ত শিথিল ও লংঘনের পাশাপাশি ব্যাপক আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ আছে। প্রার্থীদের রাজনৈতিক পরিচয় (আওয়ামীবিরোধী কিনা) নিশ্চিত করতে বাড়িতে গিয়েও খোঁজ-খবর নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে মেধার চেয়ে টাকা এবং কিছু ক্ষেত্রে অনৈতিক সম্পর্ককে প্রাধান্য দেওয়ার অভিযোগ আছে।

সূত্রমতে, বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষক নিয়োগে লিখিত পরীক্ষার নামে পছন্দের প্রার্থীদের বিশেষ সুবিধা, আগেই প্রশ্ন দেওয়া, ফলাফল প্রকাশ না করার ঘটনা ঘটে। অর্থনীতি বিভাগের একজন মেধাবী প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে না পারায় তৎকালীন একজন চেয়ারম্যানের পদত্যাগের ঘটনা ঘটে। পরে ওই প্রার্থী মামলা করে নিয়োগ পান। এছাড়া আরেকটি বিভাগে একজন শিক্ষক পদে নিয়োগ পাওয়ার পরও জামায়াত সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে যোগদানের সুযোগ দেওয়া হয়নি। ৫ আগস্ট-পরবর্তী তাকে ফের যোগদানের ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়টিতে দুর্নীতি তদন্তে কমিটি হলেও তাতে খুব বেশি গতি নেই বলে জানা গেছে।

জানা গেছে, ২০১৯ সালে ইবিতে পছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগ পাইয়ে দিতে এক শিক্ষকের ১৮ লাখ টাকা ঘুষ লেনদেনের ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়। একইভাবে চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েও চাকরি না দেওয়ার অভিযোগ ওঠে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) একজন অধ্যাপকের বিরুদ্ধে। ব্যাপক নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক শিরীন আখতারের বিরুদ্ধে। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহর সময়ে শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগে ভয়াবহ অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনা ঘটে।

একইভাবে প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অসংখ্য অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইউট্যাব) প্রেসিডেন্ট ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এবিএম ওবায়দুল ইসলাম বলেন, বিগত সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আমরা মানহীন শিক্ষক দেখেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও মানহীন শিক্ষক পেয়েছি। তিনি বলেন, এ সময় টাকার বিনিময়ে ও দলকে প্রাধান্য দিয়ে মানহীন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অবশ্যই এগুলোর তদন্ত হওয়া উচিত। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে এরইমধ্যে নিয়োগ ও অন্যান্য দুর্নীতি তদন্তে দুটি কমিটি করা হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

সূত্র জানায়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে ইউজিসির একটি নীতিমালা আছে। তবে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগই এসব নীতিমালা উপেক্ষা করে নিজেদের ক্ষমতাবলে শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে থাকে। পছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে অনেক সময় শর্ত শিথিল করা হয়। এভাবে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে শিক্ষক নিয়োগে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে।

এ বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর অধ্যাপক ও নওগাঁ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহা. হাছানাত আলী বলেন, বিগত সাড়ে ১৫ বছর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে সুনামি বয়ে গেছে। বিশেষ করে মেধাবীদের বাদ দিয়ে মেধাহীন বা তুলনামূলক কম মেধাবী, রাজনৈতিক বিবেচনা, অবৈধ আর্থিক লেনদেন বা বিভিন্ন মহলের চাপে সারা দেশে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে অসংখ্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নিয়োগ পাওয়া এসব শিক্ষকের উল্লেখযোগ্যসংখ্যকই তুলনামূলক কম মেধাবী।

ড. হাছানাত আলী বলেন, যে পদ্ধতিতে বর্তমানে শিক্ষক নিয়োগ করা হয় তাতে মেধাবী শিক্ষক নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। একেক বিশ্ববিদ্যালয়ে একেক পদ্ধতিতে শিক্ষক নিয়োগ হয়। কোথাও নামকাওয়াস্তে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে, আবার কোথাও শুধু মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হয়। শুধু ভাইভা নিয়ে মেধা যাচাই সম্ভব নয়। এজন্য একটা সার্বজনীন নীতিমালা থাকা জরুরি। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার পর ক্লাস অ্যাসেসমেন্টের মধ্য দিয়ে নিয়োগ দিলে দক্ষ ও মেধাবী শিক্ষক পাওয়া যেতে পারে।

এই শিক্ষাবিদ আরো বলেন, একমাত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের পর কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। এতে অনেকেরই বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেওয়ার যথাযথ যোগ্যতা থাকে না। তাই শিক্ষকদের জন্য আলাদা বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা জরুরি। তিনি আরো বলেন, বিগত সাড়ে ১৫ বছরে দুর্নীতির মাধ্যমে যেসব শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তাদের তো বাদ দেওয়া সম্ভব নয়, তাই তাদের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি। এজন্য প্রশিক্ষণ খাতে বাজেটে বরাদ্দ বাড়াতে হবে।

এ বিষয়ে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক এসএমএ ফায়েজ বলেন, ইউজিসির ‘হায়ার অ্যাডুকেশন এক্সিলারেশন অ্যান্ড ট্রান্সফরমেশন (হিট)’ প্রকল্পের আওতায় শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের সুযোগ আছে। আগ্রহী শিক্ষকরা এই প্রশিক্ষণ নিতে পারেন।

২০১৬ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রভাষক নিয়োগে পদে পদে অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র উঠে আসে। সংস্থাটি জানায়, ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করে দেখা গেছে যে, আটটি বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রভাষক নিয়োগে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। এ পদে নিয়োগে তিন থেকে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়েছে। পরবর্তী সময়ে এ দুর্নীতি ও লেনদেনের পরিমাণ আরো বেড়েছে বলে জানা গেছে।

টিআইবির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, নিয়োগের আগে থেকেই বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম শুরু হয়। নিয়োগ বোর্ড গঠন, সুবিধামতো যোগ্যতা পরিবর্তন বা শিথিল করা, জবাবদিহি না থাকার মাধ্যমে এই অনিয়মের শুরুটা হয়। কোনো কোনো শিক্ষক পছন্দের শিক্ষার্থীদের একাডেমিক পরীক্ষার ফল প্রভাবিত করেন এবং পরবর্তী সময়ে এদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ছাড়া বাজার করাসহ ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করে আগে থেকেই একাডেমিক পরীক্ষার সম্ভাব্য প্রশ্ন সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়। ক্ষেত্রবিশেষে নারী শিক্ষার্থীর একাংশের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে একাডেমিক পরীক্ষার নম্বর বাড়িয়ে দেওয়া, পরীক্ষার আগে প্রশ্ন জানানো ও পরবর্তী সময়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এসব অনিয়মের কারণে নিয়োগপ্রক্রিয়ায় নোট অব ডিসেন্টের সুযোগ থাকলেও সেটিকে গুরুত্ব না দিয়ে সিন্ডিকেট নিয়োগ চূড়ান্ত করে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে ঘুষ লেনদেনের পাশাপাশি দলীয়করণের কারণে শিক্ষক নিয়োগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন অনেক মেধাবী। বিভাগ বা অনুষদে শীর্ষ স্থান লাভ করেও ভিন্নমতের কারণে নিয়োগ না পাওয়ার বহু নজির পাওয়া গেছে।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ-দুর্নীতি প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহ ভিসি পদে থাকাকালে ২০১৭ থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত বেশিরভাগ দুর্নীতি হয়। তার সময়ে অন্তত অর্ধশত শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে দলীয় বিবেচনায়। এ ক্ষেত্রে বেশি যোগ্যদের সুযোগ দেওয়া হয়নি। নিয়োগ বোর্ড ও প্ল্যানিং কমিটিতে তিনি একাই একাধিক সদস্যের পক্ষে স্বাক্ষর করেন।

সূত্র মতে, কর্মকর্তার একটি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে সর্বোচ্চ বয়স ৩০ বছর দেওয়া হলেও নিয়োগ দেওয়া হয় ৩৮ বছর বয়সিকে। ভুয়া সার্টিফিকেট দিয়েও নিয়োগের অভিযোগ আছে। ব্যাকডেটেও অনেক নিয়োগ দিয়েছেন এই ভিসি।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ প্রসঙ্গে এক প্রফেসর বলেন, বিগত সাড়ে ১৫ বছরে প্রায় ৫ শতাধিক শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে। যার অধিকাংশই কম মেধাবী। আর্থিক লেনদেন, ভিসি, প্রো-ভিসি, ডিন ও রাজশাহী সিটির সাবেক মেয়রের আত্মীয়-স্বজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগ দিতে অনেক ক্ষেত্রে শর্ত শিথিল করা হয়েছে।

শিক্ষক নিয়োগে তৎকালীন রাবি উপাচার্য অধ্যাপক আবদুস সোবহান এবং প্রো—ভিসি অধ্যাপক চৌধুরী জাকারিয়ার দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রমাণ পাওয়ায় ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় রাবির সব ধরনের নিয়োগ স্থগিত করে। দীর্ঘদিন পর ওই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে মন্ত্রণালয়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) গত ১৫ বছরে বিজ্ঞাপিত পদের অতিরিক্ত নিয়োগ হয়েছে ১৪৫ শিক্ষক। এদের বেশিরভাগই আওয়ামীপন্থি বলে জানা গেছে। আবার অনেক নিয়োগের সিলেকশন বোর্ডও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। বোর্ডে বিভাগের অভিজ্ঞ শিক্ষকদের প্রাধান্য না দিয়ে অন্য বিভাগের শিক্ষকদের সদস্য করার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া এসব নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও ব্যক্তিস্বার্থ প্রাধান্য পেয়েছে বলেও জানা গেছে। উপাচার্যের পছন্দের প্রার্থীদের এগিয়ে রাখার নজিরও আছে। ফলে ক্ষেত্রবিশেষ যোগ্য প্রার্থী বিজ্ঞাপিত পদের অতিরিক্ত হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন।

সূত্রমতে, গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ থেকে ১৯ মার্চ ২০২৪ পর্যন্ত চবিতে উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন আওয়ামীপন্থি ৫ উপাচার্য। এদের মধ্যে মরহুম ড. আবু ইউসুফ বিজ্ঞাপিত পদের অতিরিক্ত নিয়োগ দিয়েছেন ৪ জন, মো. আনোয়ারুল আজিম আরিফ দিয়েছেন ৭০ জন, ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী ৩৭ জন ও ড. শিরীন আখতার ৩৪ জন। ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ড. মো. আলাউদ্দিনের সময় নিয়োগের তথ্য পাওয়া যায়নি।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ দুর্নীতি প্রসঙ্গে একজন সহকারী রেজিস্ট্রার জানান, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে সাড়ে ৫০০ শিক্ষক আছেন, যার প্রায় ৪০ শতাংশই নিয়োগ হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে। এসব শিক্ষক নিয়োগে ব্যাপক বৈষম্য ও দুর্নীতি হয়েছে।

শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি প্রসঙ্গে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. আবদুল লতিফ মাসুম বলেন, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের গত সাড়ে ১৫ বছরে শিক্ষায় অনেক আবর্জনা ঢুকে পড়েছে। কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই শিক্ষক ও ভিসি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়কে এসব আবর্জনামুক্ত করতে অবিলম্বে একটি কমিশন করা উচিত। না হলে নির্বাচিত সরকারের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আমার দেশ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions