শহীদুল্লাহ ফরায়জী:- জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের রক্তাক্ত ঢেউ, মায়ের আহাজারি, বুলেটের তাণ্ডব এবং রাজপথ প্রকম্পিত মিছিলের স্পর্ধা, আবার আমাদের চেতনার মানচিত্রে প্রতিফলিত হবে আসন্ন জুলাই-আগস্টে। সর্বনাশা ফ্যাসিবাদের অনিবার্য পতন কোনো একক ব্যক্তির কৃতিত্ব নয়, এর কেন্দ্রে সমগ্র জাতি। সুতরাং এই অভ্যুত্থানের আখ্যান অনেক বড় এবং বিস্তৃত, যা অগণন মানুষের আত্মদান ও বীরত্বের কীর্তি-গাথায় ইতিহাসের দেয়ালে খোদাই হয়ে আছে।
এই রক্তস্নাত গণ-অভ্যুত্থানের এক অভূতপূর্ব বৈশিষ্ট্য ছিল নারীদের বিস্ময়কর ও সাহসী অংশগ্রহণ, যা রাষ্ট্রক্ষমতার কাঠামোকে কাঁপিয়ে দেয়। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ছিল গণতন্ত্র ও নৈতিকতার পক্ষের এক অনমনীয় প্রতিরোধ, যেখানে নিপীড়নের মুখোমুখি হয়ে জনগণ রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিকানার দাবি উচ্চারণ করেছিল। এটি শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক বিক্ষোভই ছিল না, বরং ছিল এক নৈতিক জাগরণ। যার ভাষা ছিল প্রতিবাদী, প্রতীক ছিল লাল রক্ত, আর প্রেরণা ছিল ভবিষ্যতের জন্য এক মুক্ত-জবাবদিহিমূলক প্রজাতন্ত্র গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা।
এই অগ্নিগর্ভ গণ-অভ্যুত্থান রাষ্ট্রের ক্ষমতার কাঠামোতে একটি মৌলিক প্রশ্ন ছুড়ে দেয় ক্ষমতা এবং রাষ্ট্র কার? এই প্রশ্ন শুধু প্রাসঙ্গিকই নয়, বরং প্রথমবর্ষে এসে তা আরও তীব্র ও দার্শনিকভাবে গভীরতর হয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানটির অভিপ্রায় ছিল বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণ। মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল একটি রাজনৈতিক-নৈতিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনগণের সার্বভৌম ইচ্ছাই হবে রাষ্ট্রশক্তির উৎস। কোনো সামরিক বা আমলাতান্ত্রিক ডি-ফ্যাক্টো ক্ষমতার বিরুদ্ধে জনগণের সার্বভৌমত্ব এবং সিভিলিয়ান সুপ্রিমেসি প্রতিষ্ঠিত হবে। এই অভ্যুত্থান তাই শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক বিজয় নয়, বরং একটি নৈতিক বিনির্মাণ। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান এক অভূতপূর্ব ঘটনা, যা শুধুমাত্র রাজনৈতিক বাস্তবতাকে বদলে দেয়নি, বরং জাতির নৈতিক আত্মপরিচয়ের ভিতে এক দার্শনিক কাঁপুনি এনেছে। রাষ্ট্র ও জনগণের সম্পর্ক, ক্ষমতার উৎস-সীমা, দায়িত্ব- এই প্রশ্নগুলোকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে এই অভ্যুত্থান। তাই এর স্মরণ শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং তা নাগরিক দায় ও নৈতিক এক কর্মসূচিরও সূচনা।
জুলাই অভ্যুত্থান ছিল সেই প্রতিরোধ, যা ক্ষমতার ভাঙা আয়নায় জনগণের প্রকৃত মুখচ্ছবি প্রতিফলিত করেছে। এই অভ্যুত্থান আমাদের আবারও মনে করিয়ে দেয় রাষ্ট্রের মালিকানা জনগণের, প্রশাসন, সেনা কিংবা আমলাতন্ত্রের নয়। সুতরাং ফ্যাসিবাদবিরোধী ২৪-এর জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রথম বার্ষিকী পূর্তি উপলক্ষে, একে দার্শনিকভাবে দেখা ও এর বাস্তবায়নযোগ্য রূপরেখা কিংবা প্রস্তাবনা তুলে ধরার গুরুত্বকে নৈতিক কর্তব্য হিসেবে বিবেচনা করছি। প্রস্তাবনাগুলো হলো-
১) ১০ই এপ্রিলকে ‘প্রজাতন্ত্র দিবস’ বা Republic Day ঘোষণা করা, যা প্রজাতন্ত্রের স্মারক হিসেবে মুক্তিকামী মানুষকে যুগে-যুগে অনুপ্রেরণা যোগাবে।
২) ফ্যাসিবাদ উৎখাতে ইতিহাসের নির্মম গণহত্যার বিপরীতে, গণমানুষের সংগ্রামী চরিত্রকে চিরঞ্জীব ও চিরজাগ্রত রাখার লক্ষ্যে ৫ই আগস্টকে ‘ফ্যাসিবাদ পতন’ বা ‘গণ-অভ্যুত্থান দিবস’ বা ‘Anti-fascist Day’ ঘোষণা করা।
৩) গণতন্ত্রের লক্ষ্যে ছাত্র-জনতার আত্মদান এবং অসীম সাহসিকতাকে অবিস্মরণীয় করে রাখতে, ঢাকার সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান অথবা শেরেবাংলা নগরে ‘গণতন্ত্র চত্বর’ বা ‘Liberty Square’ প্রতিষ্ঠা করা।
৪) জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা ও বিস্ময়কর সাহসিকতায় যারা জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদেরকে রাষ্ট্রীয় খেতাব প্রদান করা।
৫) জুলাই গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে মিউজিয়াম বা সংগ্রহশালা স্থাপন করা।
৬) আবু সাঈদ, মুগ্ধ-সহ সকল বীর শহীদের স্মরণে সারা দেশব্যাপী পতাকা মিছিল, আলোচনা সভা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা।
৭) মৃত্যুকে উপেক্ষা করে যারা অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছেন, গণ-অভ্যুত্থানে আহতদের এবং দুঃসাহসিক সংগ্রামে নারীদের সংবর্ধনা প্রদান করা।
৮) গ্রাফিতি, রক্তের দাগ, প্রতিবাদী চিত্র এগুলো নিছক শিল্প নয়, বরং এক ঐতিহাসিক ভাষা। গ্রাফিতির উচ্চমানের ফটোগ্রাফিক সংরক্ষণ ও ডিজিটাল এক্সিবিশন, গুরুত্বপূর্ণ দেয়ালকে ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে সংরক্ষণ করা।
৯) বিদ্যালয় ও কলেজ পর্যায়ে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধ বিষয়ক বাধ্যতামূলক পাঠ্যক্রম প্রবর্তন করা। ছাত্ররা যেন ‘৫ই আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান’-এর ইতিহাসের পাশাপাশি হিটলারের পতন, স্পেনের ফ্রাঙ্কোর শাসন ও গণ-আন্দোলনের জয়গাথা জানতে পারে। বিতর্ক, নাটক ও ‘নাগরিক ভূমিকা পালনের’ মতো শিক্ষণীয় কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত হবে।
১০) একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম চালু করা, যেখানে নাগরিকরা সরকারের প্রতিশ্রুতি ট্র্যাক করতে পারবেন, স্বৈরাচারী প্রবণতা রিপোর্ট করতে পারবেন এবং জনগণের কাছে প্রশাসনের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারবেন। এটি উন্মুক্ত তথ্যভিত্তিক হবে এবং সুশীল সমাজের সহায়তায় পরিচালিত হবে।
১১) বিশ্ববিদ্যালয় ও নাগরিক সংগঠনের সহায়তায় “গণতন্ত্র ল্যাব” গড়ে তোলা, যেখানে ফ্যাসিবাদ, নিপীড়ন ও সমাজে গণতান্ত্রিক চেতনার অবক্ষয় নিয়ে গবেষণা হবে। স্কুলের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে গণমাধ্যম বিশ্লেষণ, ভুয়া খবর শনাক্তকরণ প্রশিক্ষণ, গণজাগরণে প্রযুক্তির ব্যবহার ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত হবে।
১২) প্রতি বছর ৫ই আগস্টকে ঘিরে এক সপ্তাহব্যাপী ‘গণতন্ত্র ও স্মৃতি উৎসব’-এর আয়োজন করা, যেখানে থাকবে নাটক, চলচ্চিত্র, কবিতা, চিত্রশিল্প, গণসংগীত, মুক্ত আলোচনা এবং শহীদদের পরিবার নিয়ে সাক্ষাৎকার। এটি শুধু স্মৃতিচারণ নয়, বরং নাগরিক ঐক্যের এক সৃজনশীল প্রকাশ হবে।
১৩) দেশব্যাপী শহীদদের স্মরণে স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় ও খোলা প্রাঙ্গণে স্মৃতি-গাছ (Peace Trees) রোপণ করা। প্রতিটি গাছের সঙ্গে থাকবে একজন শহীদের নাম ও একটি উদ্ধৃতি যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নৈতিকভাবে জাগ্রত রাখবে।
১৪) প্রতি বছর ৫ই আগস্ট দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস, আদালত এবং (নির্বাচনের পর সংসদে) গণতন্ত্র রক্ষার নাগরিক শপথ পাঠ করা। এতে করে জনগণ সক্রিয়ভাবে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অংশীদার হতে পারবে।
১৫) ১লা জুলাই থেকে ৫ই আগস্ট পর্যন্ত (সর্বমোট ৩৬ দিন, বা July ৩৬”) সংঘটিত দৈনিক ঘটনাবলীর স্মরণ ও কর্মসূচির জাতীয় পর্যায়ের নির্ঘণ্ট প্রণয়ন। প্রতিটি দিনের জন্য, সেই দিনের মূল ঘটনা সংক্ষেপে স্মরণ করে সরকার ও নাগরিক-সংগঠন কর্তৃক কার্যক্রম গ্রহণ করা।
একটি জাতির কল্পনা গঠিত হয় প্রতীক, স্থাপত্য, স্মৃতি ও শোকের মাধ্যমে। এই অভ্যুত্থানের স্মারক, সংগ্রহশালা ও মিউজিয়ামগুলো হতে পারে সেই Imagined Community-এর প্রতীক।
এসব সৌধ ও কাঠামো শুধু ইতিহাসের অমর স্মৃতির আশ্রয়স্থল হিসেবে নয় বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মানবতার প্রতি গভীর সহানুভূতি, অঙ্গীকার ও ন্যায়বিচারের বার্তা প্রদান করবে।
হেগেল বলেছিলেন ‘ইতিহাস হচ্ছে- স্বাধীনতার বিকাশের প্রক্রিয়া।’ এই অভ্যুত্থান হেগেলীয় সেই ধারা অনুসারে আমাদের জাতীয় ইতিহাসে একটি মুক্তির সন্ধিক্ষণ। এটি একটি ঐরংঃড়ৎরপধষ উরধষবপঃরপ যেখানে নিপীড়নের থিসিস, জনতার প্রতিরোধের অ্যান্টিথিসিস এবং ভবিষ্যতের প্রজাতন্ত্রের সম্ভাব্য সিন্থেসিস গড়ে উঠবে।
জুলাই অভ্যুত্থানকে স্মরণ করা মানে, শুধু অতীতকে দেখার চেষ্টা নয়, বরং বর্তমানকে নৈতিকভাবে নির্মাণ করার তাগিদ। এবারের প্রথম বর্ষপূর্তি যেন কেবল স্মৃতিচারণ না হয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য যেন এক সক্রিয় রাজনৈতিক ও নৈতিক কর্মসূচি হয়ে ওঠে। হান্না আরেন্ট স্মৃতি এবং রাজনৈতিক দায়িত্বের প্রশ্নে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন ’ Remembering is the beginning of responsibility.
স্মৃতি কেবল অতীতচর্চা নয়, বরং তা ভবিষ্যতের নৈতিক নকশা নির্মাণের ভিত্তি। স্মৃতি হচ্ছে- রাজনৈতিকভাবে দায়িত্ব নেয়ার সূচনা। জুলাই অভ্যুত্থান শুধুই একটি আন্দোলন নয়, এটি এক Ongoing process of ethical awakening.
শহীদদের রক্ত আমাদের কাছে এক দর্শনীয় দায় তৈরি করেছে আমরা কীভাবে রাষ্ট্র, সমাজ এবং নাগরিকতা ধারণ করি, তা নতুনভাবে চিন্তা করতে হবে। প্রস্তাবনাগুলো নৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক তিন স্তরেই বিবেচনায় নিতে হবে। যদি প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়িত হয়, তবে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান শুধু ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, গণ-অভ্যুত্থান হবে এক চলমান প্রতিজ্ঞা।
লেখক: গীতিকবি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
faraiæees@gmail.com