বিচারের আশায় তাকিয়ে আছেন শতাধিক পঙ্গু

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় শনিবার, ২৪ মে, ২০২৫
  • ২৪ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- সাতক্ষীরা জেলার দেবহাটা ইউনিয়নের বিএনপির ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন আব্দুর রউফ। বিএনপির রাজনৈতিক দলের পদ-পদবি থাকায় নাশকতার অভিযোগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিকল্পিতভাবে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে কথিত ‘ক্রসফায়ার’ নামে পায়ে গুলি করে। পঙ্গু জীবন-যাপনের পরও একের পর এক নাশকতার মামলার আসামি করা হয় তাকে। ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে সাতক্ষীরাজুড়ে প্রতিপক্ষ বা ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কথিত ‘ক্রসফায়ার’ নামে অসংখ্য ঘটনা সাজায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নাশকতা দমনের নামে সাতক্ষীরা জেলায় এমন শতাধিক ভুক্তভোগী এখন পঙ্গুর জীবনযাপন করছেন। স্থানীয়রা বলছেন, সাতক্ষীরা জেলা বিএনপি-জামায়াতের সমর্থক অধ্যুষিত এলাকা। আওয়ামী লীগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিএনপি-জামায়াত নিধন মিশন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অনেক নিরীহ প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পায়ে গুলি করে পঙ্গু করার পদ্ধতিকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘নি ক্যাপিং’। এটি নির্যাতনের সহিংস একটি পদ্ধতি; এমনকি বিচারবহির্ভূত শাস্তি হিসেবেও গণ্য হয়। নি ক্যাপিং নির্যাতনের এমন ভয়াবহতা; যেখানে কারো হাঁটুর উপরে কিংবা পাশে পরিকল্পিতভাবে গুলি বা আঘাত করা হয়। ‘ক্রসফায়ার’ না দিয়ে আংশিকভাবে অক্ষম করে দেয়া হয়। এতে ভুক্তভোগী সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্ববরণ করেন, যা বেআইনি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন।

ভুক্তভোগী আব্দুর রউফ জানান, তার গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার পারুলিয়া গ্রাম। এক যুগের বেশি সময় ধরে পঙ্গু জীবন পার করছেন তিনি। এক পায়ে ভর করে কোনোরকম দিন চলছে। তিনি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ২০১৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর মধ্যরাতে তাকে বাড়ি থেকে তুলে নেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গাড়িতে করে নেয়া হয় স্থানীয় সখিপুর কলেজ মাঠে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাঁটুর নিচে গুলি করে পুলিশ। এরপর থেকেই তার জীবনে শুরু হয় ছন্দপতন। আগে কোনো মামলা না থাকলেও রাজনীতি সংশ্লিষ্টতাই কাল হয় তার। তিনি বলেন, জীবন সাজাতে অনেক স্বপ্ন ছিল। এভাবে তার স্বপ্ন পাল্টে যাবে, ঘুনাক্ষরেও টের পাননি। যে কলেজ মাঠে আব্দুর রউফকে গুলি করা হয়, কিভাবে গুলি করা হয় সেই বর্ণনা দিয়ে চোখের পানি মুছতে থাকেন তিনি।

তিনি বলেন, ঘটনার পর ছয়জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরো এক থেকে দেড় হাজার জনকে আসামি করে মামলা করেন দেবহাটা থানার তৎকালীন এসআই বছির উদ্দীন। অভিযোগে বলা হয়, বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা আগ্নেয়াস্ত্র, ককটেল, লাঠিসোটা ও দা নিয়ে যৌথবাহিনীর ওপর আক্রমণ করে। আত্মরক্ষায় পাল্টা গুলি ছোড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। দুষ্কৃতিকারীদের গুলিতে দুইজন গুলিবিদ্ধ হন; এ ছাড়া নিজেদের করা বিস্ফোরণে আরো দু’জন মারা যান। সেদিন আব্দুর রউফের ভাগ্নে তৎকালীন ছাত্রদল নেতা রিয়াজুল ইসলামকেও একই জায়গায় ডেকে নিয়ে গুলি করা হয়। সেই থেকে রিয়াজুলও স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন।

প্রাণে বেঁচে ফিরলেও, এখনো সেই ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন রিয়াজুল। তার দাবি, ২০১৩ সালের আগ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা ছিল না। শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হওয়ার কারণে, সাজানো বন্দুকযুদ্ধে তিনিও নি ক্যাপিংয়ের শিকার। অর্থাৎ পায়ে গুলি করে সেটি অকেজো করা হয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিচারবহির্ভূত এমন কর্মকাণ্ডে কেউ মুখ খোলার সাহস পাননি। উল্টো ভুক্তভোগীদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী এবং নাশকতাসহ রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ তোলা হয়।

প্রত্যক্ষদর্শী জহুরা খাতুন বলেন, পুলিশ ট্রাক থেকে নামিয়ে পায়ে গুলি করে, হাঁটুর নিচে গুলি করলে পড়ে যায় আব্দুল রউফ ও তার ভাগ্নে। আমরা হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করি। ওই দিন এখানে কোনো আক্রমণের ঘটনা ঘটেনি। তিনি বলেন, পায়ে গুলি করার বিষয়টি তার সাথে আরো অনেকেই দেখেছেন। প্রত্যক্ষদর্শী মাহফুজা খাতুন জানান, একজনকে মাঠের মধ্যে পায়ে গুলি করে, আরেকজনকে পাশেই গুলি করে পুলিশ। ওই দিন এখানে পুলিশের ওপর কোনো হামলা হয়নি। তার মানে সেদিন সখিপুর কলেজ মাঠে কোনো নাশকতার ঘটনাই ঘটেনি। বরং সাজানো নাটকে সুস্থ-সবল দু’জন ব্যক্তির জীবন বিপন্ন করা হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা তিনজন প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশের করা নাশকতার সেই মামলায় সাক্ষী ২৮ জন। এদের মধ্যে নিরপেক্ষ তিনজন, বাকি সাক্ষী পুলিশ ও চিকিৎসক। মামলার নথি ধরে নিরপেক্ষ তিন সাক্ষীর সাথে কথা হয় নয়া দিগন্তের সাথে।

নিরপেক্ষ সাক্ষীদের বক্তব্য এবং মামলায় তাদের জবানবন্দীর মধ্যে কোনো মিল নেই। তাদের দাবি, মনগড়া কথা লিখে শুধু সই নেয়া হয়েছে। অন্য দিকে, পুলিশের এজাহার ও তদন্ত প্রতিবেদনেও রয়েছে গরমিল। এজাহারে দু’জনের মৃত্যু ও দু’জন গুলিবিদ্ধের কথা বলা হলেও, তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি। এরপর আর প্রশ্ন থাকে না ঘটনার নাটকীয়তা নিয়ে।

আরেক ভুক্তভোগী সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার গড়ানবাড়িয়া এলাকার রুহুল আমীন। এক দশক আগেও স্বাভাবিক জীবন ছিল তার, ছিলেন কৃতী ফুটবলারও। রুহুল আমিনের এক পা কেড়ে নেয়া হয়েছে কথিত ‘ক্রসফায়ার’ নামের সাজানো নাটকে।

২০১৫ সালের ২৫ জুলাই সন্ধ্যায় বাড়িতেই অবস্থান করছিলেন রুহুল আমিন। হঠাৎ বাড়ি ঘিরে ফেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাকে জোর করে থানায় নেয়া হয়। তিনি বলেন, কয়েক ঘণ্টা থানায় রাখে পুলিশ। এরপর রাতে বিলের মধ্যে নিয়ে যায়। সেখানে প্রথমে ফাঁকা গুলি ছোড়ে। এরপর তার পায়ে গুলি করে। তিনি বলেন, তখন মনে হয়েছিল পুলিশ তাকে হত্যা করবে। পরে বেঁচে থাকলেও পঙ্গু হাসপাতালে তার পা কেটে ফেলতে হয়।

তৎকালীন সরকারি দলের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে পুলিশ এতটাই বেপরোয়া ছিল যে, পায়ে গুলি করার পর তাকে হাসপাতালে নেয়া হলেও চিকিৎসা দেয়া হয়নি। অবশেষে পঙ্গু হাসপাতালে তার পা কেটে ফেলতে হয়।

এ ঘটনায় দেবহাটা থানার তৎকালীন এসআই মনিরুল ইসলাম বাদি হয়ে একটি মামলা করেন। অভিযোগের ধরনটা একই। বলা হয়, ঘোনাপাড়া এলাকায় জাকির মেম্বারের হ্যাচারির সামনে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা গোপন মিটিং করছিল। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে গুলি ও বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় তারা। সেখানে ১০-১২ মিনিট গোলাগুলির পর রুহুল আমীনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় গ্রেফতার করে পুলিশ।

মামলার সাক্ষী শামসুর রহমান গাজী বলেন, আমি আওয়ামী লীগ করতাম। কিন্তু আমি ঘটনার কিছুই জানি না। পুলিশ রাত ৩টার দিকে ডেকে নিয়ে সাক্ষী করে। এ ঘটনায় আরেক সাক্ষী মাহমুদ হক লাভলু বলেন, প্রথম শুনলাম আমি সাক্ষী। অন্য কাউকে না করে আপনাকে কেন সাক্ষী বানাবে? তিনি বলেন, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি তিনি। সাক্ষী হওয়ার ১০ বছর পর জানলেন তিনি সাক্ষী। অথচ পুলিশ এজাহারে লিখেছে মাহমুদও ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন এবং তার সামনেই রামদা, লোহার রড ও বোমার অংশবিশেষ উদ্ধার করা হয়।

আরেক সাক্ষী মমীন গাজীকে দেখানো হয়, সেদিন মধ্যরাতে তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। এ ক্ষেত্রেও বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন।

রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য রুহুল আমিনকে গুলি করে পঙ্গু বানানোর পর সেটি ধামাচাপা দেয়ার এই কৌশল ধোপে টিকবে না। জেনেও পুলিশ মিথ্যা নাটক সাজিয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, মামলায় নিরপেক্ষ সাক্ষীর ১০ জনই স্থানীয় আওয়ামী লীগের পদধারী নেতা, যাদের অনেকেই এখন পলাতক।

ক্রসফায়ার কিংবা বন্দুকযুদ্ধের নামে স্বার্থসিদ্ধির মিছিল ঘিরে ধরেছিল পুরো সাতক্ষীরা জেলাকে। ২০১৪ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগে থেকে শুরু হওয়া এই ঘটনাগুলো এতটাই ব্যাপক আকার ধারণ করে যে, সেখানে এক ধরনের ত্রাসের রাজত্ব চলছিল আওয়ামী লীগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর।

২০১৩ থেকে ১৬ এই তিন বছরে সাতক্ষীরায় প্রায় শতাধিক বন্দুকযুদ্ধের তথ্য জোগাড় করা হয়। এসব বন্দুকযুদ্ধে পা হারানোর ঘটনা অন্তত ৫০টি। বিচারবহির্ভূত এমন কর্মকাণ্ড তৎকালীন জেলা প্রশাসন জানলেও কোনো টুঁ শব্দ করেনি। অভিযোগ রয়েছে এসব ঘটনায় উল্টো উৎসাহ যুগিয়েছে প্রশাসন।

গুম কমিশনের সদস্য ও মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন এসব ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন। তিনি বলছেন, ওই সময়ে প্রশাসনের সব কর্মকাণ্ডেই দলীয় লেজুরবৃত্তির প্রবণতা ছিল। শুধু তা-ই নয়, বন্দুকযুদ্ধে পঙ্গু বানানো একেকজনের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দিয়ে কোণঠাসা করা ছিল তাদের নিয়মিত কাজ।

এই যেমন আব্দুল মজিদ সরকার, কলারোয়া থানার তুলসিডাঙ্গা এলাকার বাসিন্দা মজিদ সরকার পেশায় কৃষক ছিলেন। কিন্তু ১০ বছর ধরে পঙ্গু জীবন বয়ে বেড়াচ্ছেন। তিনি বলেন, গাড়ি বহরে হামলা মামলায় তাকে মিথ্যা আসামি করে পুলিশ। পরে পালিয়ে যশোরে গেলেও আমাকে গ্রেফতার করা হয়।

২০১৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতারের পর নেয়া হয় অজ্ঞাত স্থানে। ওই দিন রাতেই একটি মাইক্রোবাসে কয়েকজন সাদা পোশাকধারীর হাতে তুলে দেয় শার্শা থানা পুলিশ। পরে উপজেলার কাজীরহাট কলেজের পাশে নিয়ে পায়ে গুলি করে। তিনি ঘটনার বর্ণনা করে বলেন, চোখ-হাত বাঁধা, গাড়ি থেকে নামাল। এরপর পায়ে স্প্রে করল এবং দুইজন শক্ত করে ধরে, পায়ে গুলি করে। পরে ফাঁকা গুলি করে নাটক সাজায়।

আব্দুল মজিদের মামলাতেও সেই একই নাটক। বন্দুকযুদ্ধে পঙ্গু করে দেয়ার পর সাজানো মামলায় ১৫ জনকে সাক্ষী বানায় পুলিশ, যাদের মধ্যে নিরপেক্ষ সাক্ষীরা ঘটনা দেখেননি বলে জানিয়েছেন।

৫ আগস্ট পট পরিবর্তনের পর ভুক্তভোগীদের অনেকেই ন্যায়বিচারের জন্য সোচ্চার হয়েছেন। এরই মধ্যে জেলার তৎকালীন পুলিশ সুপার মঞ্জুরুল কবির, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শামীম হাসান, হোসাইন শওকত ও ইকবাল হোসেনসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলাও করেছেন।

সচরাচর মামলার নথিতে বাদি ও তদন্ত কর্মকর্তার ফোন নম্বর দেয়া থাকে। তবে সাতক্ষীরার নাশকতার এই মামলাগুলোতে ফোন নম্বর নেই। সেটিও বিশেষ কারণে। পরিচয় গোপন রেখে পুলিশেরই একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নিজেদের আড়াল করতেই এমন কৌশল। যে কারণে মামলা সংশ্লিষ্ট তৎকালীন কোনো কর্মকর্তার বক্তব্যও নেয়া সম্ভব হয়নি।

নি ক্যাপিংয়ের মতো নির্মম এসব ঘটনায় আইনি পদক্ষেপ কী হতে পারে, জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, একটি জনপদে পরিকল্পিতভাবে প্রতিপক্ষ দমনে এমন ঘটনা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে হার মানিয়েছে। তবে যে বা যারা এই নির্মম ঘটনা ঘটিয়েছেন, তাদের কেউ এখনো আইনের আওতায় আসেনি। তিনি বলেন, এই মামলাগুলো ট্রাইব্যুনাল আলাদাভাবে বিচার কার্যক্রম শুরু করবে। এমন ঘটনা শতাধিকেরও বেশি।নয়াদিগন্ত

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions