ফের দিল্লির ছকে বাংলাদেশ

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় শনিবার, ২৪ মে, ২০২৫
  • ৩৬ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- দিল্লির সাউথ ব্লক গেল ৯ মাসের মধ্যে সবচেয়ে আনন্দের সময় কাটিয়েছে গত বৃহস্পতিবার। হাসি ফুটেছে পতিত আওয়ামী-সেক্যুলার শিবিরেও। প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরে দাঁড়াতে চান- এমন খবরে ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির মধ্যে যতটা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা গেছে, ততধিক উল্লাস দেখা গেছে ভারতীয় লবিতে। ভারতীয় মিডিয়া উচ্ছ্বাসে মেতেছে। পরিষ্কার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে- বাংলাদেশের রাজনীতি আবারও ভারতের প্রভাব বলয়ে ঢুকে পড়তে যাচ্ছে।

চব্বিশের অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে টানা ১৭ বছরের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ হারায় ভারত। তা পুনরুদ্ধারে বাংলাদেশকে নিয়ে নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু প্রতিবেশী দেশটি। ভারতীয় গেম প্ল্যানের অংশ হিসেবেই বিভিন্ন ইস্যুতে ড. ইউনূস সরকারের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। বিব্রত ও বিরক্ত হয়ে তিনি ক্ষমতা ছাড়লেই প্ল্যান-বি বাস্তবায়নে নামবে দিল্লি। প্রতিবিপ্লবের মাধ্যমে বিশ্বস্ত সেবাদাস শেখ হাসিনাকে ফেরাতে ব্যর্থ হয়ে নতুন কৌশল নেয় ভারত ও ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ। দিল্লির ছকে এ দেশের রাজনীতি নতুন করে প্রভাবিত করার অপতৎপরতা শুরু হয়। সবচেয়ে উদ্বেগের জায়গা হলো, দেশের রাজনীতিক, সেনাবাহিনী ও সরকারের একটি অংশ ওই ছকে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেছে।

ভূরাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে পড়া ভারত যেকোনো মূল্যে ঢাকায় আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে বহুমুখী কৌশল নেয়। ভারতবিরোধী কঠোর অবস্থানের কারণে দিল্লি ড. ইউনূসকে তাদের জন্য বড় হুমকি হিসেবে দেখছে। ফলে তাদের এজেন্ডার শীর্ষে রয়েছে ঢাকায় ইউনূসমুক্ত সরকার। এই এজেন্ডা বাস্তবায়নে নানাভাবে শক্তি জোগাচ্ছে পতিত ফ্যাসিবাদ ও তার দোসররা। আবার বুঝে বা না বুঝে ফাঁদে পা ফেলেছে গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের কোনো কোনো রাজনৈতিক দলও। এসব দল ও সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক বয়ান এবং ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনে বিস্ময়কর সাজুয্য দেখা যাচ্ছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পক্ষগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব ও বিভাজনের সুযোগও কাজে লাগাচ্ছে দিল্লি।

এদিকে সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার অবস্থানে অনড় রয়েছেন। তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কারকাজে সহযোগিতার পরিবর্তে অরাজক পরিস্থিতি অব্যাহত রাখলে তিনি পদত্যাগ করবেন। ড. ইউনূস তার সহকর্মী উপদেষ্টাদের কাজকর্ম গুছিয়ে নিতে বলেছেন। আবার রাজনৈতিক দলগুলোকে বিকল্প খুঁজে নেওয়ার বার্তা পাঠানো হয়েছে। তবে এর মধ্যে এনসিপির সঙ্গে বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে। ফলে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম কিছুটা প্রলম্বিত হতে পারে। ড. ইউনূস দেশের স্বার্থে আরো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা নিরসন না হওয়া পর্যন্ত তিনি দৈনন্দিন সরকারি কাজ চালিয়ে যাবেন।

এদিকে প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করবেন না বলে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব গতকাল যে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন, তার ওই স্ট্যাটাস কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মুছে দিয়েছেন। জানা গেছে, সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশেই তিনি স্ট্যাটাসটি মুছে ফেলে নতুন আরেকটি স্ট্যাটাস দেন। পরিবেশ ও বন উপদেষ্টা গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচনের সময়সীমার বিষয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটি ড. ইউনূসের সর্বশেষ অবস্থানের বহিঃপ্রকাশ বলে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা সূত্রে জানা গেছে।

এ ছাড়া আজ প্রধান উপদেষ্টার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার যে কথা ছিল, তা তিনি আর দিচ্ছেন না। পরবর্তী পরিস্থিতির কারণে ভাষণ দেওয়ার জন্য তিনি আরো সময় নিতে চাইছেন বলে জানা গেছে। তবে আজ উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি সভা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই সভার সিদ্ধান্তের আলোকে প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে বসতে পারেন। ওই বৈঠকে সরকারের সার্বিক অবস্থান তুলে ধরা হবে।

বিএনপির একটি সূত্র আগামী রমজানের আগে (ফেব্রুয়ারির মধ্যে) নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাদের অনাপত্তির বার্তা প্রধান উপদেষ্টার কাছে ইতোমধ্যে পাঠিয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর আমির ফেব্রুয়ারির মধ্যে এমনকি এপ্রিলেও নির্বাচনে তাদের আপত্তি না থাকার কথা আগেই জানিয়েছেন।

গত বৃহস্পতিবার মন্ত্রিপরিষদের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ প্রশ্নে ৪৮ ঘণ্টা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার কথা জানিয়েছিলেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র আমার দেশকে নিশ্চিত করে। আজ বিকাল নাগাদ সেই ৪৮ ঘণ্টার সময় শেষ হতে যাচ্ছে। অবশ্য বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পদত্যাগের ওই হুমকির খবর রাজনৈতিক অঙ্গনে ছড়িয়ে পড়ায় সরকারপক্ষের শক্তিগুলো বিভিন্ন মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদের বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করে। ওই বার্তায় তারা প্রধান উপদেষ্টাকে সরে না যাওয়ার অনুরোধের পাশাপাশি সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে বলে যমুনা সূত্রে জানা যায়। এমনকি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের জন্য যে দলটি সরকারকে চাপে রাখার ঘোষণা দিয়েছিল, সেই বিএনপির সহযোগী সংগঠন ছাত্রদল ও দলটির নেতা ইশরাক হোসেনের কর্মীরা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে শাহবাগের অবস্থান ও যমুনার সামনের অবস্থান কর্মসূচি স্থগিত করে। বিভিন্ন রাজনৈতিক মহলের বার্তা ও প্রতিক্রিয়ার পরও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগের বিষয়ে অনড় অবস্থানে রয়েছেন। তবে রাজনৈতিক মহল ও উপদেষ্টা পরিষদের পক্ষ থেকে ইউনূসকে শান্ত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এ লক্ষ্যে সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের প্রভাবশালী সদস্য ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের যোগাযোগ চলছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে।

সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পক্ষগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব ও বিভাজনের সুযোগ নিয়ে ফ্যাসিবাদীদের পুনর্বাসনের কৌশল নিয়েছে ভারতীয় পৃষ্ঠপোষকতার একটি বিশেষ মহল। অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন দলের মধ্যে বামধারার ভারতপন্থি অংশটি এক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। এরা সরকার ও সেনবাহিনীকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে। একাধিক রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টাও এর ফাঁদে পড়েছেন। তারা ‘তথাকথিত’ দাবি-দাওয়ার নামে সরকারের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করে ড. ইউনূসের প্রশাসনকে ব্যর্থ প্রমাণ করার চেষ্টা করছে। গত বৃহস্পতিবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মাদ ইউনূস এসব ঘটনায় হতাশা প্রকাশ করে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়ার ইচ্ছার কথা জানান। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পর এনসিপির আহবায়ক নাহিদ ইসলাম জানান, ড. মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগের কথা ভাবছেন। এরপর বিভিন্ন মহলে এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, গত ১৩ মে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার পর থেকে নতুন পরিকল্পনা নিয়ে পথ চলতে শুরু করে গণঅভ্যুত্থানের পক্ষে থাকা রাজনৈতিক দলের ভেতরকার ভারতপন্থি অংশগুলো। তাদের আশা ছিল নির্বাচনের মাধ্যমে কোনো না কোনো প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগকে ফেরত আনা যাবে। কিন্তু দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ায় সে সম্ভাবনা ফিকে হওয়ায় তারা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এরপর সরকারের ওপর নানাভাবে চাপ সৃষ্টির কৌশল নেয়। ইন্ধন জোগায় রাজনৈতিক দলগুলোকে। তাদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে রাজপথে বিভিন্ন দল ও সংগঠনের কর্মসূচি জ্যামিতিক হারে বাড়াতে থাকে। এর মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একজন উপদেষ্টার বিতর্কিত মন্তব্যের পর সরকারকে প্রকাশ্যে যেসব রাজনৈতিক দল ও শক্তি সমর্থন দিয়ে আসছিল, তার বড় একটি অংশও নিজেদের গুটিয়ে নেয়। এ সুযোগে ভারতপন্থি অংশটি নতুন করে মাঠে আরো সক্রিয় হয়ে ওঠে বলে গোয়েন্দা সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে।

অভিযোগ রয়েছে, দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির ওপরও অঅিখিভএদের একটি অংশ ভর করেছে। ক্ষুদ্র এ অংশটি দুই উপদেষ্টার পদত্যাগ চেয়ে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ঘিরে বিএনপির অবস্থান গ্রহণের সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করে। যদিও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব চাইছিলেন শুধু ইশরাক হোসেনের মেয়র পদের বিষয়টি ফয়সালা পর্যন্ত অবস্থান করতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হত্যাকে কেন্দ্র করে ক্যাম্পাস ছেড়ে শাহবাগের মতো ব্যস্ততম সড়কে এসে দুদিন অবস্থান কর্মসূচি পালনের পেছনে বামপন্থি চক্রটি বড় ধরনের ভূমিকা পালন করে বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে।

জানা গেছে, ওই অংশ বিএনপিকে এও বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের ওপর ‘চাপ’ প্রয়োগ করা হলে তারা দ্রুত নির্বাচন দিয়ে সরে যাবে। ভারতপন্থি অংশটির মূল লক্ষ্য নতুন করে দিল্লির ছকে এ দেশের রাজনীতি প্রভাবিত করা। এজন্য দলগুলোর মধ্যে বিভেদ ও বিভাজন বাড়ানোর কৌশল নেওয়া হয়।

এর মধ্যে নির্বাচন ও জাতীয় নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট কিছু বিষয়ে সেনাপ্রধানের বক্তব্য গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর সরকারের মধ্যে অস্বস্তি বাড়তে থাকে। উপদেষ্টা পরিষদের অনেক সদস্যসহ বিশ্লেষকরা মনে করেন, সেনাপ্রধান এখতিয়ারবহির্ভূত বক্তব্য রেখেছেন। সেনাপ্রধানের এ বক্তব্য প্রকাশের পর ভারতপন্থি অংশটি নানা ধরনের প্রোপাগান্ডা ছড়াতে থাকে। এমনকি বৃহস্পতিবার রাত থেকে সেনা সদস্যদের নামে ভুয়া চিঠিও ছড়িয়ে দেওয়া হয়। অবশ্য গতকাল আইএসপিআর থেকে বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়, এসব গুজব। জনগণের প্রতি আহবান জানানো হয় এ ধরনের মিথ্যা প্রচারণায় কান না দিতে। একই সঙ্গে ভারতের গণমাধ্যম প্রচারণা চালাতে থাকে ড. ইউনূসের সরকারের বিরুদ্ধে ক্যু করেছেন সেনাপ্রধান। এ ছাড়া কয়েকজন জেনারেলকে নিয়ে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আওয়ামী লীগের পলাতক নেতাকর্মীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে।

এদিকে প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করতে চাচ্ছেন এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে পরশু রাত থেকে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্র পরিচালনায় সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশিত ‘সহযোগিতা না পাওয়া’ ও নানামুখী প্রতিবন্ধকতার কথা উল্লেখ করে ড. ইউনূসের পদত্যাগের হুমকি রাজনৈতিক অঙ্গনে পৌঁছে গেলে নড়াচড়া শুরু হয়। গণঅভ্যুত্থান সমর্থিত কয়েকটি দল কিছুদিন ধরে নানা ইস্যুতে সরকারের ওপর অব্যাহত চাপ প্রয়োগ করে এলেও তাদের মনোভাবে কিছুটা নমনীয়তা দেখা যায়। জুলাই আন্দোলনের পক্ষের দলগুলোর বড় একটি অংশ নিজেদের মধ্যে বিভেদ ভুলে নতুন করে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আলোচনা শুরু করে। একাধিক দল ও জোট জরুরি বৈঠক করে সরকারকে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেও সরকারের পক্ষে তাদের অবস্থান জানান দিচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য কীভাবে আবারো জোরদার করা যায়, তা নিয়ে বিভিন্ন দলের সঙ্গে আলোচনা চলছে।

এদিকে গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে বন ও পরিবেশ উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ ঘোষণা করলেও একাধিক দায়িত্বে সরকার বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। তবে ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যেই নির্বাচন হবে। তার একদিনও এদিক-সেদিক হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

ড. ইউনূসের পদত্যাগ নিয়ে প্রতিক্রিয়ায় রিজওয়ানা হাসান বলেন, এখন কিছু কিছু গুরুদায়িত্ব আছে, সেগুলো পালনের সঙ্গেও তো মাসের একটা সম্পর্ক থাকতে পারে। আমাদের তিনটি মোটা দাগের দায়িত্বÑ সংস্কার, বিচার ও ইলেকশন। তিনটিই কঠিন দায়িত্ব। ‌শুধু ইলেকশন করার জন্য আমরা দায়িত্বটা নেইনি।

গতকাল রাজধানীতে অপর এক অনুষ্ঠানে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছেন মন্তব্য করে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, অনেকেই আমাদের সমালোচনা করেন, অথর্ব বলেন। সমালোচনা করবেন, ঠিক আছে তবে বাইরে এসব ভালো ইমপ্রেশন দেয় না। ইমেজ (ভাবমূর্তি) ক্ষুণ্ণ হয়।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বৃহস্পতিবার রাতে এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, নর্থ ও দিল্লি জোটভুক্ত হয়ে যে কুমির ডেকে আনছেন, তা আপনাদেরই খাবে। আপনারা তাদের একজন নন। আপনাদের শুধু সাময়িকভাবে কাজে লাগানো হয়েছে। তবে তিনি আপনাদের বলতে কাকে বুঝিয়েছেন, তা স্পষ্ট করেননি।

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য জয়নুল আবদিন ফারুক গতকাল প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে ড. ইউনূসকে ১৮ কোটি মানুষের প্রতিনিধি উল্লেখ করে তারা প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ চান না বলে জানান। তবে তিনি নিরাপত্তা উপদেষ্টাসহ তিন উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করেন।

প্রধান উপদেষ্টাকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, আপনি নন্দিত হয়ে এসেছেন কিন্তু নিন্দিত হয়ে যাবেন না। তাহলে আমরা কষ্ট পাব। আমরা শুনতে পাচ্ছি আপনি নাকি পদত্যাগ করতে চাচ্ছেন। এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এজন্য কারা দায়ী? আপনাদের ভেতরের লোকজন এ অস্থিরতা তৈরি করছে। তাদের ছাঁটাই করুন। এর জন্য বিএনপি দায়ী নয়।

মান-অভিমান ভুলে দায়িত্ব পালন করতে প্রধান উপদেষ্টা ও সেনাপ্রধানকে আহবান জানিয়ে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক গতকাল এক অনুষ্ঠানে বলেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশের অভিভাবকের দায়িত্ব নিয়েছেন। আমাদের সেনাপ্রধান দেশের স্তম্ভ। আপনারা বক্তিগত মান-অভিমানের কারণে মানুষের স্বপ্ন ফিকে হতে দেবেন না।

বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, এভাবে আলটিমেটাম ও টাইমফ্রেম বেঁধে দিয়ে দেশকে সামনে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না। সহনশীল অবস্থায় আসুন। প্রত্যেকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করুন। ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় মতভেদ ভুলে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অংশীজন বিএনপি, জামায়াত, ছাত্র-জনতা এবং হেফাজতসহ সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সবাইকে উদারতা ও দায়িত্বশীল আচরণের পরিচয় দিতে হবে।

দার্শনিক, মানবাধিকারকর্মী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফরহাদ মজহার শুক্রবার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে লিখেছেন, প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করে ভুল করেছেন। পদত্যাগ করা হবে তার ব্যর্থতা ও আত্মঘাতী। কোনো দল বা গোষ্ঠীর চাপে বিভ্রান্ত না হয়ে জনগণের ওপর আস্থা রাখতে ড. ইউনূসের প্রতি আহবান জানান জুলাই অভ্যুত্থানে সক্রিয় থাকা এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নয়, রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ড. ইউনূসকে নির্বাচিত করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাকে অবশ্যই খুনিদের বিচার করতে হবে। নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়নের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশ গঠন করার প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে।

তিনি স্ট্যাটাসে সেনাবাহিনীর সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝির অবসান প্রত্যাশা করে বলেন, দিল্লি ও মিয়ানমারসহ শত্রু দেশের বিরুদ্ধে লড়ে জেতার ক্ষমতাসম্পন্ন শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন করতে হবে।

প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব গতকাল এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগ করবেন না। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ক্ষমতা প্রয়োজন নেই কিন্তু বাংলাদেশের জন্য, বাংলাদেশের শান্তিপূর্ণ ডেমোক্রেটিক ট্রানজিশনের জন্য ড. ইউনূস স্যারের দরকার আছে।

কেবিনেটকে আরো গতিশীল হতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকারকে আরো বেশি ফাংশনাল হতে হবে। উপদেষ্টাদের আরো বেশি কাজ করতে হবে। সরকারকে এখন থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আরো নিবিড়ভাবে আলোচনায় বসতে হবে। নিয়মিত বসে এবং বিভিন্ন বিষয়ে তাদের মতামত চাইতে হবে। কোনো ধরনের বিচ্ছিন্নতা কাম্য নয়। পাশাপাশি সেনাবাহিনীও রাজনীতিতে নাক গলাতে পারবে না। তবে সেনাবাহিনীকে প্রাপ্য সম্মান দেখাতে হবে, আস্থায় রাখতে হবে। সেনাবাহিনী প্রশ্নে হুট করে কিছু করা যাবে না, হঠকারী কিছু করা যাবে না। ইনক্লুসিভনেসের নাম করে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনও চাওয়া যাবে না। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আমাদের গর্ব এবং আস্থার জায়গা। সেটা কেউ ভঙ্গ করবে না। অবশ্য পরে তিনি স্ট্যাটাসটি মুছে ফেলেন এবং বিষয়টি নিয়ে সংবাদ পরিবেশন না করার অনুরোধ করেন।

চলমান রাজনৈতিক টানাপোড়েনকে ইঙ্গিত করে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া গতকাল ফেসবুক পোস্টে বলেছেন, দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। আমাদের ১/১১-এর পুনরাবৃত্তি হতে দেওয়া উচিত নয়।

ড. ‍মুহাম্মদ ইউনূসকে শক্ত হাতে হাল ধরার অনুরোধ জানিয়ে নতুন রাজনৈতিক দল আপ বাংলাদেশ-এর আহবায়ক আলী আহসান জুনায়েদ ফেসবুক পোস্টে বলেন, জুলাই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। ছাত্র-জনতা আপনার সঙ্গে থাকবে। জুলাইয়ের অসমাপ্ত বিপ্লবকে পূর্ণতা দেওয়া ছাড়া আমরা থামতে পারি না। আমরা মৃত্যুভয়ে কাতর নই। আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় পাই না।

এদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদের এক বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল সন্ধ্যায় ফেসবুক স্ট্যাটাসে এনসিপি নেতা সারজিস আলম লিখেছেন, বিএনপির সালাহউদ্দিন ভাই বলেছেন, ‘চলমান সংকট সমাধানের একমাত্র পথ নির্বাচনি রোডম্যাপ দেওয়া।’ এই মুহূর্তে বিএনপি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল। সে হিসেবে তাদের কাছে আমাদের এবং বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। তাদের দায়বদ্ধতাও সবচেয়ে বেশি। সমাধানের একমাত্র পথ হিসেবে যখন নির্বাচনি রোডম্যাপের কথা বলা হয়, তখন জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করা সাধারণ জনগণ আশাহত হয়, শহীদ পরিবারের সদস্যরা আশাহত হয়, আহত যোদ্ধারা আশাহত হয়। কোটি মানুষ যে আকাঙ্ক্ষাকে সামনে রেখে ৫ আগস্টে জীবনের মায়া না করে রাজপথে নেমে এসেছিল, তাদের স্বপ্নভঙ্গ হয়।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ চাইনি। ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ চেয়েছি। উনি যদি রোডম্যাপ দেওয়ার পরিবর্তে নিজে পদত্যাগ করতে চান, তাহলে সেটা ওনার নিজস্ব চয়েস হতে পারে। বাট আমরা ওনার পদত্যাগ চাইনি। সরকারের নিরেপেক্ষতা ক্ষুণ্ণ হওয়ায় আমরা পদত্যাগ চেয়েছি নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানের। আমরা পদত্যাগ চেয়েছি দুজন ছাত্র উপদেষ্টার। এখন কেন তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) দায়িত্ব পালন করতে চান না, সেটা ওনার নিজস্ব ব্যাপার। একান্ত তিনি যদি দায়িত্ব পালন করতে না চান, রাষ্ট্র বসে থাকবে না, জাতি বসে থাকবে না। জাতি তার বিকল্প খুঁজে নেবে। পৃথিবীতে কেউ অপরিহার্য নয়। এখন রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়, আবেগতাড়িত হয়ে কাজ করার বিষয় নয়, আবেগের বিষয় নয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মাহাবুব উল্লাহ বলেন, ড. ইউনূস যদি পদত্যাগ করেন, সেটা জাতীয় বিপর্যয়ের কারণ হবে। অনেকে মনে করছেন সামরিক শাসন বা সে ধরনের কিছু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জায়গাটা পূরণ করা হবে। সেটা হলে তা গণতন্ত্র, দেশ, এমনকি সামরিক বাহিনীর জন্যও মঙ্গলজনক হবে না।

এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, যে ঐক্য ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছিল, সেই ঐক্যটা এখন ভেঙে পড়েছে। আর এই ঐক্য ভেঙে যাওয়ার ফলে প্রশ্ন আসবেÑ এর সুবিধাভোগী কে? এর সুবিধাভোগী হবে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতীয় আধিপাত্যবাদ আর সুবিধাভোগী হবে পতিত আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ আর ভারতীয় আধিপাত্যবাদ একে অপরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধনে জড়িয়ে রয়েছে।

তিনি বলেন, দেশের রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে মনে করলেও তারা বুঝে বা না বুঝে যে কাজটি করছে, সেটা আধিপত্যবাদের প্রত্যাবর্তনেরই একটি রাস্তা করে দিচ্ছে। একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, আবার আধিপত্যবাদের প্রত্যাবর্তন হলে তা বাংলাদেশের জন্য কবর রচনার ঘটনা ঘটবে। খুবই ভয়াবহ ব্যাপার হবে। দেশে রক্তের বন্যা বয়ে যেতে পারে। গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।

তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, এ ব্যাপারে কেন আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে বিএনপি, যাদের মধ্যে অনেক পুরোনো, অভিজ্ঞ ও বয়স্ক নেতৃত্ব রয়েছেনÑ তারা পরিণতিটা কেন হিসাব করছেন না? এটা ভেবে আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব হতাশা বোধ করছি। আমি আবারও বলছি, এখন প্রয়োজন একটি জাতীয় সমঝোতা ও জাতীয় ঐক্য। সামরিক বাহিনী ও সিভিল ফোর্সের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হলে তা আধিপত্যবাদের পক্ষেই যাবে।

দেশের এই পরিস্থিতির জন্য ভারতের হাত থাকার ইঙ্গিত করে এই শিক্ষাবিদ বলেন, এর পেছনে যে ভারতীয় আধিপত্যবাদ কলকাঠি নাড়ছে, সেটা সন্দেহাতীতভাবেই বলা যায়। তারা বাংলাদেশে বসেই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। আধিপত্যবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠায় নানা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। তারা যেকোনো সময় যেকোনো অঘটন ঘটাতে পারে। তাদের কৌশল হচ্ছে ছোট ছোট অঘটন ঘটিয়ে মানুষের মতকে বিষিয়ে তুলে বড় ধরনের ঘটনা ঘটানো।আমার দেশ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions