ডেস্ক রির্পোট:- এবার পার্বত্য চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে অস্থিরতা তৈরির ষড়যন্ত্র শুরু করেছে ভারত। এই কাজে লাগানো হচ্ছে জেএসএস, ইউপিডিএফ আর কেএনএফের অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের। দেশবিরোধী এই প্রকল্প সফল করতে পরিকল্পনা সাজানো হয়েছে তিন ভাগে।
প্রথম ভাগে জেএসএস আর ইউপিডিএফের অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের মধ্যে বিভেদ ছড়িয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে কথিত ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু করা। এরই মধ্যে এই সংঘাতে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকরা বাঙালিদের জড়িয়ে নেওয়া।
সবশেষ উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে একপক্ষকে দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্যাম্পেইন শুরু করানো। যেখানে বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকায় অস্থিরতার চিত্র ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় করে দেখানোসহ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার প্রাধান্য পাবে। ক্যাম্পেইনের শিরোনাম হবে পার্বত্য এলাকায় ইউএন মিশন পাঠানোর দাবি। আর এসব প্রক্রিয়া শুরু হবে বিজু উৎসবের পর থেকেই। পুরো এই কর্মকাণ্ডের সমন্বয় করছেন আওয়ামী লীগের পলাতক জনপ্রতিনিধিরা। সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া একাধিক অস্ত্রধারীর স্বীকারোক্তিসহ পার্বত্য এলাকা নিয়ে কাজ করা একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা এসব পরিকল্পনার তথ্য পেয়েছে।
জুলাই বিপ্লবে তাঁবেদার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশকে নিয়ে একের পর এক নতুন ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে ভারত। এই ষড়যন্ত্রের সবশেষ সংস্করণ পার্বত্য অঞ্চল তথা রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলা। ভারত ও মিয়ানমারের সীমানাঘেঁষা দুর্গম পাহাড়ি এই অঞ্চলটি নিয়ে ভারতের ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে দেশ স্বাধীনের পর থেকেই। পাহাড়ে বসবাস করা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের একাংশকে ভুল বুঝিয়ে অধিকারের প্রশ্নে বিভ্রান্ত করে সন্ত্রাসের পথে নিয়ে যায় ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’। অস্ত্র এমনকি সীমান্ত এলাকায় সরাসরি আশ্রয় ও প্রশিক্ষণ দিয়ে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্ত করে তারা।
শুরু থেকে এসব সন্ত্রাসীর মোকাবিলায় কঠোর অবস্থান নেয় বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী। সেনাবাহিনীর অব্যাহত অভিযানে কোণঠাসা হয়ে পড়ে শান্তিবাহিনী হিসেবে পরিচিত পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম সশস্ত্র সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি বা জেএসএস। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে কথিত শান্তি চুক্তির নামে পাহাড়ে সেনাবাহিনীর কার্যক্রম সীমিত করার ষড়যন্ত্র সফল করে ভারত। কথিত ওই চুক্তির কারণে দুর্গম এলাকাগুলো থেকে ২৩৯টি সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়। এতে ফের সংগঠিত হয় পাহাড়ি অস্ত্রধারীরা।
একটি সংগঠন ভেঙে এখন ৫টি সংগঠন তাদের সশস্ত্র তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। এগুলো হলো- জেএসএস (সন্তু), জেএসএস (সংস্কার), ইউপিডিএফ, ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ও কেএনএফ। আর এই সুযোগ লুফে নিতে শুরু করেছে ভারত। জুলাই বিপ্লবের প্রতিশোধ নিতে শুরুতে সংখ্যালঘু কার্ড খেলে তাতে ব্যর্থ হয়ে পাহাড়ে অস্থিরতা তৈরির পুরোনো কৌশল নতুন করে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করছে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’।
গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য——
পার্বত্য এলাকায় কাজ করা একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য বলছে, মূলত জেএসএস, ইউপিডিএফ ও কেএনএফের সামরিক শাখার নিয়ন্ত্রণ যারা করেন, তারা কেউ বর্তমানে বাংলাদেশে নেই। জেএসএসের অস্ত্রধারী ক্যাডারদের মধ্যে সুভাস চাকমা ওরফে জার্নাল বাবু, সুবল চাকমা ওরফে আশিষ বাবু, জ্ঞান চাকমা ওরফে কার্জন চাকমা, প্রণতি বিকাশ চাকমা, পরিণতি চাকমা ও অভিযান চাকমা অন্যতম। এছাড়া ইউপিডিএফ ক্যাডারদের মধ্যে সজিব চাকমা, উজ্জ্বল স্মৃতি চাকমা, রঞ্জন মণি চাকমা, রজন বসু ও শ্রাবণ চাকমা অন্যতম। এদের সবাই ভারতের মিজোরাম ও ত্রিপুরায় অবস্থান করে এদেশে থাকা সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে অপারেশন পরিচালনা করছে।
গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিজু উৎসবকে কেন্দ্র করে সন্ত্রাসীরা সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে পার্বত্য এলাকায় ঢোকার পরিকল্পনা করছে। সর্বজনীন এই উৎসবের সুযোগে সংগঠিত হয়ে বড় ধরনের নাশকতা করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। বর্তমানে সীমান্ত এলাকাগুলোতে বিশেষ করে রাঙামাটির সাজেক, উদয়পুর, মারিষা বান্দরবানের দোপানিছড়া, রুমা খাগড়াছড়ির লোগাং, পানছড়ি, জপুই এলাকায় অস্ত্রের মজুত বাড়ানো হয়েছে।
সমতলে রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে সেনাবাহিনীর ব্যস্ততা বেড়েছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) তৎপরতাও আগের মতো নেই। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অপতৎপরতা শুরু হয়েছে। এছাড়া কেএনএফ প্রধান নাথান বমকেও এখন ভারতের মিজোরামে রাখা হয়েছে। সেখান থেকে তাকে হল্যান্ড পাঠানোর প্রস্তুতি চূড়ান্ত করেছে ভারত। হল্যান্ড থেকে বাংলাদেশে ইউএন মিশন পাঠানোর আপিল ও ক্যাম্পেইন চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর।
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য——-
পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক গবেষক নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও দর্শন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. ছালেহ শাহরিয়ার বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামকে দেখতে হলে ভারতের সেভেন সিস্টারকে নিয়ে একসঙ্গে দেখতে হবে। এখানে শুধু ভারতেরই নয়Ñ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইসরাইল ও জাপানের আলাদা আলাদা স্বার্থ জড়িত, যা জিও পলিটিক্যাল ‘হট স্পট’ হিসেবে চিহ্নিত।
এখানে অস্থিরতা তৈরি হলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রভাব পড়বে খুব সহজে। অন্তর্বর্তী সরকারের রাজনৈতিক কৌশল আর বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাবে সমতলে অস্থিরতা তৈরিতে সুবিধা করতে না পেরে এবার পার্বত্য চট্টগ্রামকে টার্গেট করেছে ভারত। এটা শুধু গোপনে নয়, প্রকাশ্যেই করা হচ্ছে। ভারতীয় মিডিয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে প্রচার করা উসকানিমূলক তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করলেই এই অভিযোগের সত্যতা মিলবে।
ভারতের এই ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হলে শুধু প্রশাসনিক নয়, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত থাকতে হবে। সেখানে বসবাস করা বাঙালি ছাড়াও ১৮টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষকে আস্থায় নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে সরকারকে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের বক্তব্য——
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শহীদ উল্লাহ চৌধুরী জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামের এই সংকট আপাতদৃষ্টিতে সশস্ত্র সংগঠনগুলোর আধিপত্যের লড়াই মনে হলেও এটি মূলত আধিপত্যবাদী শক্তির ষড়যন্ত্রের অংশ, যা এই অঞ্চলের মানুষের জনজীবনকে বিপন্ন করার পাশাপাশি অনগ্রসর এলাকার উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির স্বপ্নকেও বাধাগ্রস্ত করছে। ৫ আগস্টের বিপ্লবকে বাংলাদেশে নিজেদের পরাজয় হিসেবে ধরে নিয়েছে ভারত। আর এই পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের নিয়ন্ত্রিত শক্তিকে কাজে লাগানোর অপচেষ্টা করছে।
শহীদ উল্লাহ চৌধুরী বলেন, নাথান বম যে ক্যাম্পেইন করার কথা বলছে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীও সেই একই দাবি তুলছে প্রকাশ্যে। ভারতীয় মিডিয়া যে সুরে কথা বলছে, পাহাড়ি উগ্রবাদী সংগঠনগুলো একইভাবে অপতৎপরতা চালাচ্ছে। এই অবস্থার উন্নতি করতে হলে পার্বত্য এলাকায় সেনা তৎপরতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। তবে শান্তিচুক্তির কারণে সেনা তৎপরতা বাড়ানো একটি জটিল প্রক্রিয়া। এ ক্ষেত্রে অন্যান্য বাহিনীর তৎপরতা বাড়ানো এমনকি নতুন করে বিশেষায়িত আধা সামরিক বাহিনী তৈরি করে পাহাড়ে নিয়োজিত করে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যেতে পারে। আমারদেশ