রাঙ্গামাটি;- পাহাড়-পর্বত ও সবুজ বনজঙ্গলে ঘেরা অপরূপ সৌন্দর্যমন্ডিত পার্বত্য চট্টগ্রাম (রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান) বাংলাদেশের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
সমগ্র দেশের ভূখন্ডের এক-দশমাংশ এই পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের জন্য ভূরাজনৈতিক দিক দিয়ে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি অনাহরিত সম্পদের বিশাল ভান্ডার হিসেবেও সম্ভাবনাময়। তবে এত এত সমৃদ্ধময় অঞ্চলটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠি ধূলিসাৎ করে দিচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের পূর্বে ভারতের মিজোরাম, দক্ষিণে মিয়ানমারের আরাকান, উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা প্রদেশ এবং পশ্চিমে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অবস্থিত।
সরকার পিছিয়ে পড়া পুরো পার্বত্যাঞ্চলকে ঢেলে সাজাতে বেশ কয়েক দশক ধরে কোটি কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বরাদ্ধ দিলেও উন্নয়নের টাকা গিলছে এখানকার অবৈধ সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা।
পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি সম্প্রদায়গুলোর অধিকার আদায়ে স্বাধীনতার পরপরই পাহাড়িদের আঞ্চলিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে গড়ে উঠে সশস্ত্র সংগঠন ‘শান্তিবাহিনী’।
শান্তিবাহিনী জন্মলগ্ন থেকে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামে ত্রাসের রাজস্ব কায়েম করেছিলো। চাঁদাবাজি, খুন, গুমের মতো ঘটনা ঘটিয়ে পাহাড়কে অস্থির রাখতো। এ সশস্ত্র বাহিনীর হাতে অনেক নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যও খুনের শিকার হয়েছিলো।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা পরবর্তী একাধিক সরকার গোষ্ঠিটির সাথে শান্তির বারতা নিয়ে আলোচনা করতে চাইলেও তা ভেস্তে যায়। পরবর্তী আওয়ামীলীগ সরকারের শাসনামলে ১৯৯৭সালের ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) সাথে সরকারের একটি চুক্তি সই হয়েছিলো। যা ইতিহাসে ‘শান্তিচুক্তি’ বা পার্বত্য চুক্তি বলে অবহিত করা হয়। শান্তির জন্য চুক্তি করা হলেও শান্তি ফেরেনি পাহাড়ে।
পাহাড়ে শান্তি আনয়নে ৭২টি ধারা চুক্তিতে উল্লেখ ছিলো। সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা ছিলো এসব ধারা বাস্তবায়ন হলে পাহাড়ের স্থায়ী ফিরে আসবে।
স্থানীয় পাহাড়ি নেতৃবৃন্দদের অভিযোগ চুক্তির পূর্ণাঙ্গ ধারা আজও বাস্তবায়ন হয়নি। যে কারণে শান্তি ফিরেনি। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে বেশিরভাগ ধারা বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বাকী ধারাগুলো বাস্তবায়ন চলমান রয়েছে।
জানা গেছে, চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ২৫টি ধারা পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন, ১৮টি ধারা আংশিক বাস্তবায়ন এবং বাকী ২৯টি ধারা এখনো অবাস্তবায়ন রয়ে গেছে।
পার্বত্য শান্তিচুক্তির বিরোধীতার মধ্যে দিয়ে ১৯৯৮সালের ২৬ডিসেম্বর রাজধানী ঢাকায় এক কনফারেন্সের মধ্যে দিয়ে প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট’র (ইউপিডিএফ) জন্ম হয়েছিলো।
সন্তু লারমার পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) থেকে তরুণদের একটি দল বের হয়ে এসে তাদের হাত ধরে পাহাড়ের আঞ্চলিক এ সশস্ত্র সংগঠন ইউপিডিএফ প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
এ সশস্ত্র গোষ্ঠিটি প্রতিষ্ঠার পর স্ব-জাতির অধিকার আদায়ের কথা বলে আসলেও সংগঠনটির সশস্ত্র সদস্যরা খুন, গুম, চাঁদাবাজি করে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল করে তোলে।
এদিকে জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা প্রকাম সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) থেকে বেরিয়ে রূপায়ণ দেওয়ান এবং সুধাসিন্ধু খীসাদের নেতৃত্বে ২০০৭ সালে জন্ম নেয় ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি সংস্কার।’ যা পিসিজেএসএস সংস্কার বা এমএন লারমা গ্রুপে নামে পরিচিত।
ইউপিডিএফ প্রতিষ্ঠার ১৯ বছর পর তপন জ্যোতি চাকমার (বর্মা) নেতৃত্বে ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর খাগড়াছড়ি জেলা সদরের একটি কমিউনিটি সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ ঘটে ‘ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট গণতান্ত্রিক’ যা সংক্ষেপে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক নামে বেশ পরিচিতি পেয়েছে।
এরপর মগ লিভারেশন পার্টি (এমএলপি) বা মগ লিভারেশন আর্মি নামে আরও একটি সশস্ত্র সংগঠনের জন্ম হয় এবং সর্বশেষ নাথান বমের নেতৃত্বে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) বা সশস্ত্র গ্রুপ কুকি-চীন ন্যাশনাল আর্মি নামের সশস্ত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
সন্তু লারমার পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতির (পিসিজেএসএস) পক্ষ থেকে তাদের কোন সন্ত্রাসী দল নেই উল্লেখ করলেও শান্তি বাহিনীর বিকল্প হিসেবে তাদের সশস্ত্র সংগঠন জুম্ম লিভারেশন আর্মি সন্ত্রাসী কার্যক্রম চলমান রেখেছে।
পাহাড়ের প্রতিটি উন্নয়ন কাজ, উৎপাদিত কৃষি, মৎস্য, বনজ, টেলিযোগাযোগ সকল ক্ষেত্রে চাঁদা দিতে হচ্ছে এসব সশস্ত্র সংগঠনগুলোকে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাহাড়ের এসব সংগঠনগুলো পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকা চাঁদা আদায় করে থাকে। চাঁদা আদায়ের টাকা দিয়ে নিজেদের শক্তি জানান দিতে পাশ্ববর্তী রাষ্ট্র থেকে দুর্গম সীমান্ত পথ ব্যবহার করে কিনছে বছরে কোটি কোটি টাকার আধুনিক সব অস্ত্র।
গ্রুপগুলো নিজেদের আধিপত্য বিস্তার এবং চাঁদা আদায়ের এলাকা নিয়ন্ত্রণ নিতে এসব অবৈধ অস্ত্র দিয়ে এক অপরকে হত্যা করছে হরহামেশা। সবুজ, শান্ত পাহাড়কে অশান্ত করে তোলছে। তাদের গুলিতে অনেক নিরহী জনগণও প্রাণ হারাচ্ছে।
জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারী মাসে বাংলাদেশ-মিজোরাম সীমান্তবর্তী জেএসএসের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পগুলোতে এ পর্যন্ত ৭শতাধিক জেএসএস সদস্য সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছে বলে মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের একটি সূত্র জানিয়েছে।
সুত্র আরো জানিয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের জেএসএস সদস্যরা মিজোরামের চাকমা অধ্যুষিত এলাকায় বাড়ি-ঘর দোকানপাট ক্রয় করে ব্যবসা শুরু করেছে। এসবের আড়ালে সশস্ত্র প্রশিক্ষণার্থীদের আশ্রয়দান ও মিজোরাম থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করার চেষ্টা চালাচ্ছে তারা।
চলতি বছরের ২৪জানুয়ারি মিজোরামের এক সময়ের বিদ্রোহী সংগঠন মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের(এমএনএফ) একটি শাখা পিস একর্ড এমএনএফ রিটার্নিস এসোসিয়েশন (পামরা) গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে দাবী করে বাংলাদেশ-মিজোরাম সীমান্তে দুইটি জেলায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ৮টি সশস্ত্র প্রশিক্ষণ শিবির খুলেছে।
সম্প্রতি চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারী সাজেকে ভয়াবহ আগুনে দেড় শতাধিক রিসোর্ট পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এতে পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের একশো কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লাগার কথা বলা হলেও একটি সূত্র বলছে ইউপিডিএফ বেশ কিছুদিন আগে থেকে সাজেকের পর্যটন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে দশ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে আসছিলো।
চাঁদা না পাওয়ায় স্বশস্ত্র এ সংগঠনটি এ ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করছে নিরাপত্তা বাহিনী। বর্তমানে পুরো সাজেক ইউপিডিএফ’র নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
সশস্ত্র এ সংগঠনটি চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারী এককালীন ৫ কোটি এবং প্রতি মাসে ৩৪ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে না পেয়ে বেসরকারি মোবাইল অপারেটর রবির অন্তত ২১টি মোবাইল টাওয়ার নষ্ট করে দিয়েছে ইউডিডিএফ। এ ছাড়াও নির্ধারিত সময়ে চাঁদা পরিশোধ না করায় রাঙামাটি থেকে টাওয়ার ঠিক করতে যাওয়া এক শ্রমিককে তুলে নিয়ে গেছে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, টেলিযোগাযোগ সংস্থা রবিকে পাহাড়ে নেটওয়ার্ক সচল রাখার জন্য ইউপিডিএফকে প্রতিমাসে সত্তর লাখ টাকা চাঁদা দিতে হয়। আওয়ামীলীগ সরকার পতনের পর ইউপিডিএফ হঠাৎ করে বেসরকারি এ টেলিযোগাযোগ সংস্থাটি থেকে নিয়মিত চাঁদা পরিশোধের পাশাপাশি এককালীন পাঁচকোটি টাকা চাঁদা দাবি করে বসে।
এতে কোম্পানীটি চাঁদা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় সংগঠনটির সন্ত্রাসীরা দুই পার্বত্য জেলার ( খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি) রবি’র ২১টি টাওয়ারের লাইন কেটে দিয়েছে। মোবাইল টাওয়ার স্টেশনের ব্যাটারি লুট, জেনারেটর পুড়িয়ে দেয়। এতে ১০ কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে রবি ও তার অংশীদার কোম্পানিগুলো।
টাওয়ার পরিচালনাকারী কোম্পানির স্থানীয় একজন কর্মকর্তা বলেন, পাহাড়ের আঞ্চলিক স্বশস্ত্র দলগুলো মোবাইল অপারেটর কোম্পানীগুলোর কাছ থেকে প্রতিমাসে তিনকোটি টাকা চাঁদা আদায় করে থাকে।
গত বছরের ২০আগষ্ট মারমা লিভারেশন পার্টির সশস্ত্র সদস্যরা রাঙ্গামাটির রাজস্থলী উপজেলার বাঙ্গালহালিয়া এলাকায় চাঁদার দাবিতে এক ব্যবসায়ীকে মারধরের ঘটনায় স্থানীয় জনতা সেইদিন সশস্ত্র সংগঠনটির কার্যালয় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিলো। সংগঠনটি চাঁদা আদায়ের পাশাপাশি সন্তু লারমার পিসিজেএসএস’র সশস্ত্র সদস্যদের সাথে একাধিবার সংঘর্ষে জড়িয়ে ছিলো। এতে উভয় দলের বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছিলো।
সময়ের সবচেয়ে আলোচিত সশস্ত্র সংগঠন কুকি চীন ন্যাশনাল ন্যাশনাল আর্মি। সংগঠনটি প্রথমে পাহাড়ের ছোট ছোট বিলুপ্ত প্রায় জাতিগুলোর অধিকার আদায়ের কথা বলে জন্ম নিলেও পরবর্তীতে শক্তিশালী সশস্ত্র সংগঠনে রূপ নেয়।
বান্দরবানের পাহাড়ি এলাকায় গত বছরের এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৮ মাসে পাহাড়ি সন্ত্রাসী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মির অতর্কিত হামলায় ৭ সেনাসদস্য নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর)। শুধু তাই নয় সশস্ত্র সংগঠনটি গত বছরের ০২এপ্রিল বান্দরবান জেলার থানচিতে সোনালী ও কৃষি ব্যাংক ডাকাতি করেছিলো।
চলতি বছরের ১৯মার্চ রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার দুর্গম মিতিঙ্গাছড়ি এলাকায় কুকিচিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) ও সন্তু লারমার জুম্মা ন্যাশনাল আর্মি (জেএলএ) এর মধ্যে সংঘটিত এক বন্দুকযুদ্ধে ৪ জেএলএ সদস্য নিহত হয়েছে বলে কুকি চীন ন্যাশনাল আর্মির ফেসবুক পেইজে দাবি করা হয়েছে। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ ঘটনার কোন সত্যতা পাওয়া যায়নি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক লেখক ও গবেষক সাংবাদিক সৈয়দ ইবনে রহমত বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নে প্রদান বাধা সশস্ত্র সন্ত্রাস। দেশি-বিদেশি চক্রের পক্ষ থেকে অব্যাহতভাবে সন্ত্রাসীদের প্রশয়, উসকানি এবং সার্বিক সহযোগিতা প্রদানও পাহাড়ে শান্তির পথে অন্যতম অন্তরায়। তাই পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে সকল অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের হস্তক্ষেপ বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
সরকার এবং রাজনৈতিক দল ও নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে পাহাড়ের জনগোষ্ঠিগুলোর সঙ্গে বহুমাত্রিক এঙ্গেজমেন্ট বাড়িয়ে তাদের মধ্যে আস্থা তৈরি করতে হবে। বাঙালি-অবাঙালি জনগোষ্ঠির মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্যসমূহ দূর করে সকলকে একই মর্যাদা ও নিরাপত্তার নিশ্চিত করতে হবে। এসব উদ্যোগ গ্রহণ করা সম্ভব হলেই আশা করা যায় পাহাড়ে শান্তির স্বপ্ন বাস্তবে ধরা দেবে।