ডেস্ক রির্পোট:- ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য পুনর্গঠিত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)। ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর বিগত সাত মাসে ভবন সংস্কার, প্রসিকিউশন টিম গঠন ও তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগের পাশাপাশি বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
ট্রাইব্যুনালে এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত অভিযোগের সংখ্যা ৩৩০টি। চলমান তদন্ত কার্যক্রম (কমপ্লেইন্ট রেজিস্টার অনুসারে) চলছে ৩৯টির। তদন্তের প্রাথমিক সত্যতার আলোকে আনীত বিবিধ মামলা (আইসিটি বিডি মিস.কেইস) ২২টি। এসব মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আসামি করা হয়েছে ১৪১ জনকে। আসামিদের মধ্যে ৫৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়াও আইসিটি থেকে জারিকৃত ওয়ারেন্ট রয়েছে এমন পলাতক অভিযুক্ত রয়েছেন ৮৭ জন।
যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, তাদের মধ্যে বেসামরিক ব্যক্তি ৭০ জন, পুলিশ ৬২ জন এবং সামরিক ৯ জন।
যেভাবে চলছে তদন্ত কার্যক্রম
বৃহস্পতিবার (১০ এপ্রিল) পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য মতে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি বিশেষায়িত সংস্থা হিসেবে কাজ করছে। সমন্বয়ক, সহ-সমন্বয়কসহ তদন্ত সংস্থার মোট তদন্ত কর্মকর্তার বর্তমান সংখ্যা ২৪ জন। তদন্ত সংস্থার সব সদস্যই পুলিশ বাহিনী থেকে প্রেষণে বা চুক্তিভিত্তিক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন।
পুনর্গঠিত তদন্ত সংস্থা দায়িত্ব গ্রহণ করে ২০২৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর। এ পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিমে চিফ প্রসিকিউটরসহ মোট ১৭ জন প্রসিকিউটর রয়েছেন। আইনের বিধান অনুসারে, প্রসিকিউটররাও তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করতে পারেন।
ট্রাইব্যুনালের উক্ত জনবল নিয়ে এ পর্যন্ত ১ হাজার অধিক ব্যক্তির সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে। ভিডিও এবং ডিজিটাল সাক্ষ্য সংগ্রহ (১ হাজারের অধিক ভিডিও ক্লিপস), পর্যালোচনা, ভেরিফিকেশন এবং জিওলোকেশন যাচাইয়ের কাজ চলমান রয়েছে।
জেলা পর্যায়ে তদন্ত পরিচালনার উদ্দেশ্যে একাধিকবার পরিদর্শন করা হয়েছে। ঢাকা, নরসিংদী, হবিগঞ্জ, সিলেট, রাজশাহী, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বগুড়া, রংপুর, চট্টগ্রাম, লক্ষ্মীপুর, নড়াইল, সাতক্ষীরা, খুলনা, যশোরসহ ১৫টি জেলায় কর্মকর্তারা গিয়েছেন।
গুম বিষয়ক তদন্ত কার্যক্রমে ঢাকা শহরের তিনটি এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও বগুড়া জেলায় তিনটি গুমের কেন্দ্র (আয়নাঘর, হাসপাতাল, এলআইসি ইত্যাদি বিভিন্ন কোড নামে পরিচিত) পরিদর্শন ও সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। তদন্তকাজে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে বিশ্ববিদ্যালয়-মাদ্রাসা পর্যায়ে এ পর্যন্ত গণশুনানি গ্রহণ করা হয়েছে চারটিতে (নর্থ সাউথ, নর্দান, বিইউবিটি ও যাত্রাবাড়ি মাদ্রাসা)। এতে মোট আট শতাধিক শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও সাধারণ মানুষ অংশ নিয়েছেন।
তদন্ত শেষ বা প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে চার মামলার
মামলাগুলো হলো, আইসিটি বিডি মিস কেস নং ০৮/২০২৪ (আশুলিয়া লাশ পোড়ানোর ঘটনা), আইসিটি বিডি মিস কেস নং ০১/২০২৫ (চাঁনখারপুল হত্যাকাণ্ডের ঘটনা), আইসিটি বিডি মিস কেস নং ০৭/২০২৫ (রামপুরা কার্নিশে ঝুলে থাকা গুলির ঘটনা), আইসিটি বিডি মিস কেস নং ০২/২০২৪ (শেখ হাসিনা)।
এ বিষয়ে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, এসব মামলায় স্বল্পতম সময়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হতে পারে। তদন্ত প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক গৃহীত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আনুষ্ঠানিক বিচার প্রক্রিয়া শুরু হবে।
তবে সব অভিযোগের তদন্ত কার্যক্রম শেষ করার ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ দেখছে প্রসিকিউশন টিম। তারা মনে করছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ বিষয়ক জটিল তদন্তকাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, দক্ষ এবং বিশ্বস্ত তদন্ত কর্মকর্তার প্রকট অভাব। যার ফলে স্বল্প জনবল দিয়ে তদন্ত কার্যক্রম চলমান; প্রশাসনের অভ্যন্তরে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রতি অনুগত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবস্থান এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের অসহযোগিতা সাক্ষ্য-প্রমাণাদি গ্রহণের প্রক্রিয়াকে সময়সাপেক্ষ করে তোলে। পলাতক আসামিদের গ্রেফতারে জটিলতা রয়েছে। দেশের বাইরে যারা পালিয়ে গিয়েছে তাদের ফিরিয়ে আনার আইনত এবং কূটনৈতিক প্রক্রিয়া রয়েছে, যা সময়সাপেক্ষ।
বিগত সরকার পতনের পর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্যপ্রমাণ বিনষ্ট করা হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা এবং প্রসিকিউশন টিমের ওপরে সরাসরি প্রাণঘাতী বোমা হামলার চেষ্টা বা ষড়যন্ত্র হয়েছে। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের পলাতক সুবিধাভোগীরা বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে তদন্ত কার্যক্রম এবং বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা চলমান রয়েছে। এর মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব বা মিস ইনফরমেশন ছড়ানো, তদন্ত কর্মকর্তা বা প্রসিকিউটরদের নামে মিথ্যা অপবাদ প্রদান, বিদেশি লবিস্ট ফার্ম এবং আইনজীবীদের মাধ্যমে মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর বক্তব্য প্রদান করছে বলেও অভিযোগ প্রসিকিউশন টিমের।
পলাতকদের গ্রেফতারের বিষয়ে যা ভাবছে প্রসিকিউশন টিম
পলাতক আসামিদের গ্রেফতার করার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর রয়েছে। তবে কিছু ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল থেকে ওয়ারেন্ট বের হওয়ার তথ্য আগেই আসামির কাছে চলে যাওয়ায় আসামি পালিয়ে যাওয়ার মতো কিছু ঘটনা ঘটেছে। দেশের বাহিরে যারা পালিয়ে গিয়েছে তাদের ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ। এখানে আইনগত এবং কূটনৈতিক দুটি ধাপেই কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।
বিদেশে পলাতক আসামি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারি করার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ করা হয়েছে, যা বর্তমানে ইন্টারপোলের নিজস্ব পদ্ধতির মধ্যে প্রক্রিয়াধীন আছে। দ্বিতীয় ধাপে আরও ১০ জন পলাতক আসামির বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করার জন্য ইন্টারপোলের কাছে অনুরোধ জানাতে আজ পুলিশের মহাপরিদর্শক বরাবর আবেদন দিয়েছে প্রসিকিউশন।
গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্যপ্রমাণ বিনষ্ট করার অপচেষ্টা
প্রসিকিউশন বলছে, বিগত সরকার পতনের পর আজ্ঞাবহ (সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের) ব্যক্তিরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্যপ্রমাণ বিনষ্ট করার চেষ্টা করেছে। থানা, হাসপাতালসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানের দলিলপত্রাদি পুড়িয়ে বা লুকিয়ে নষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে। বিভিন্ন অপরাধমূলক স্থাপনার আকার আকৃতি, দেয়াল ইত্যাদি ভেঙে এবং বিকৃত করে প্রমাণ লুকানোর চেষ্টা করা হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তারা এগুলো ট্রেস করে পুনরুদ্ধার করতে কাজ করছেন। বিভিন্ন ডিজিটাল এভিডেন্স, যেমন ভিডিও, অডিও, ইন্টারনেট ডাটা ইত্যাদি ডিলিট করা বা ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তারা সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডিলিট হওয়া সব তথ্য-প্রমাণাদি রিকভারি এবং রিস্টোর করার কাজ করে চলেছেন।
তদন্ত এবং বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টার অভিযোগ
প্রসিকিউশন টিমের অভিযোগ, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের পলাতক সুবিধাভোগীরা বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে তদন্ত কার্যক্রম এবং বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা চলমান রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিয়মিতভাবে তদন্ত কার্যক্রম এবং প্রসিকিউটরদের সম্পর্কে গুজব বা মিস ইনফরমেশন ছড়ানোর মাধ্যমে বা মিথ্যা অপবাদ প্রদানের মাধ্যমে জনমনে বিশেষত শহীদ পরিবারদের বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা করা হয়েছে।
তদন্ত কার্যক্রম এবং বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার জন্য বিদেশি লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স (সাবেক টুইটার)-এ সমন্বিত এবং পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এছাড়া বিপুল অর্থ ব্যয়ে ব্রিটেনের বিখ্যাত আইনজীবী ফার্ম ডটি স্ট্রিট চেম্বারকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর অভিযোগ আনয়ন করানোর জন্য।ট্রিবিউন