ড. হাসানুজ্জামান চৌধুরী:- অত্যন্ত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে তোলা আদিবাসী দাবিটি আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়।কারণ হচ্ছে-১. এটা সত্যের ও ইতিহাসের চূড়ান্ত অপলাপ; ২. এটা বাংলাদেশের ২০ কোটি জনগণকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করার শামিল; ৩. এটা আমাদের এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র এবং এর সাংবিধানিক কাঠামোবিরোধী; ৪. এটা এখানকার আদিবাসী বাঙালি মুসলিম জনগোষ্ঠীকে হেয় করে বাইরে থেকে আগত অতি মুষ্টিমেয়ের জন্য বিশেষ অন্যায্য সুবিধা প্রদান করে; ৫. এটা বাংলাদেশের ঐক্য ও সংহতিবিরোধী; ৬. এটা দেশের সবচেয়ে সম্পদসমৃদ্ধ এক-দশমাংশ ভূগোলকে গুটিকয়েকের কুক্ষিগত করে দেওয়ার অন্যায় সিদ্ধান্ত পতিত ফ্যাসিবাদ কর্তৃক; ৭. এটা বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও ভৌগোলিক অখণ্ডত্বের বিরুদ্ধাচরণ; ৮. এটা সম্পূর্ণভাবে বৈষম্যের স্মারক; ৯. এটা হিন্দুস্তানি হিন্দুত্ববাদী আধিপত্যের মতলব হাসিল করার গূঢ় চক্রান্ত; ১০. এটা সর্বাবস্থায় বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ ও জনকল্যাণের বিপরীতে খাল কেটে কুমির আনা।
ইতিহাসের পাতায় যাওয়া যাক। সুদূর অতীত থেকেই সমগ্র চট্টগ্রাম অঞ্চল বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সে যুগে চট্টগ্রাম ছিল বাংলার হরিকল জনপদ নিয়ে গঠিত। এটি ছিল বরাবর বাংলাদেশের কন্টিগিউআস টেরিটোরি এবং অবশ্যম্ভাবীভাবে এর সুস্পষ্ট, সুসংবদ্ধ গঠন ও অবয়ব প্রদানকারী অঞ্চল।
রেকর্ডেড ইতিহাস এই যে, মাত্র ১৮৬০ সালের ২৬ জুনের ‘নোটিফিকেশন নাম্বার ৩৩০২’-এর ভিত্তিতে এবং একই সালের ১ অগাস্টের ‘রেইডস অব ফ্রন্টিয়ার অ্যাক্ট ২২ অব ১৮৬০’ অনুসারে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী তাগিদে চট্টগ্রামের পাহাড়প্রধান অঞ্চলকে স্বতন্ত্র পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলায় রূপ দেওয়া হয়।
এরপর ১৯০০ সালের ১ মে, ‘নোটিফিকেশন ১২৩ পিডি’ হিল ট্র্যাক্টস্ রেগুলেশন জারি করে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘বিচ্ছিন্ন এলাকা’য় (excluded area) পরিণত করে অযৌক্তিকভাবে সেখানে এ দেশের মূল জনগণ তথা বাংলাভাষী বা বাঙালির অবাধ গমনাগমন ও বসতি স্থাপনকে বিঘ্নিত করে ভূমিজ সন্তান (সান অব দ্য সয়েল) নয় এমন বহিরাগত ও বিদেশি এবং এদেশে অভিবাসী (ইমিগ্র্যান্ট) আরাকানি, লুসাই ও টিপ্পা উপজাতিদের ঠাঁই করে দেওয়া হয় (S. Mahmood Ali, ‘The Fearful State: Power People and Internal War in South Asia’, London and New Jersy: ZED Books, 1993)। ১৯৮৯ সালে এ প্রক্রিয়ায় আরো মারাত্মক ইন্ধন জোগানো হয় (৫ম খণ্ড: বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের অ্যাক্ট, বিল ইত্যাদি; বাংলাদেশ গেজেট, মার্চ ২, ১৯৮৯)।
অথচ চাকমারা বহিরাগত হয়েও সম্পূর্ণ মিথ্যাচার করে এখন নিজেদের পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমিপুত্র এবং বাস্তবে যারা এ দেশবাসী সেই বাঙালিদের বহিরাগত বলে ভারতীয় প্রভাবে এবং তাঁবেদার সরকারের নোংরা সহযোগিতায় পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন ও স্বাধীন করে ‘জুম্মল্যান্ড’ প্রতিষ্ঠার দাবি উঠিয়েছে। এই ‘জুম’ শব্দটি চাকমাদের ভাষার নয়, এটি কোলদের শব্দ।
এ ছাড়া জুম চাষ এখন পার্বত্য চট্টগ্রামে ১০ শতাংশেরও কম। আবার চাকমারা বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা এক ভাগের চার ভাগেরও কম, তথা দশমিক ২২ শতাংশ। তারা আরো ১২টি উপজাতির নাম ভাঙিয়ে বাস্তবে তাদের প্রতারিত করে বাংলাদেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও ভূ-কৌশলগত দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ এক-দশমাংশ ভূখণ্ডে পার্বত্য চট্টগ্রাম নামটি পর্যন্ত চিরতরে মুছে দিয়ে ‘জুম্মল্যান্ড’ এবং প্রকৃত প্রস্তাবে ‘চাকমাল্যান্ড’ কায়েম করতে চায়। কাজেই এটা স্পষ্ট, এটি একটি দেশীয় ষড়যন্ত্র প্রতিবেশী প্রভু রাষ্ট্রের সহায়তায়।
ইতিহাস বলে, এই বাংলাদেশে ১২০৪ থেকে ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধ—এই সুবৃহৎ কালে মুসলিম শাসন চালু ছিল ইংরেজ আগমনের আগে। এ উপমহাদেশে এবং একসময় বাংলাদেশেও মুঘল শাসন কায়েম হয় ১৫২৬ সালে ভারত প্রতিষ্ঠার পর।
মুঘল শাসন কায়েমের দেড় শতাব্দী কাল পরে চাকমারা আসে আজকের পার্বত্য চট্টগ্রামে এবং তৎকালের চট্টগ্রামে। মুসলমান সম্রাটদের অধীনে বাংলাদেশের সুলতান, নবাব ও সুবেদার দ্বারা শাসনকৃত রাজ্যে অঞ্চলের নিয়ন্ত্রক জমিদাররা পূর্বোক্ত উভয় পক্ষের কাছে পুরো অনুগত থেকেই জমিদারি চালাতেন ক্ষেত্রবিশেষে তারা রাজা উপাধি পেলেও।
১৩৪০ সালে সুলতান ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ চট্টগ্রামের বিরাটাংশ দখল করেন। ১৫৪২ সালে সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ এ অঞ্চল দখল করেন। আলাউদ্দিন হোসেন শাহের স্থানীয় শাসক ছিলেন খোদা বখশ খান। তার শাসনাধীন ছিল দক্ষিণ চট্টগ্রাম। এভাবে আরাকানের মুসলিম প্রভাবে এবং মুসলিম শাসনের অধীনে থাকতে থাকতে একসময় এখানে ঠাঁই নেওয়া চাকমা রাজারা মুসলিম ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি, ইসলামি পরিভাষা ও আরবি-ফারসি ভাষার দ্বারা প্রভাবিত হন এবং অনেকের মতে, মুসলমান হয়ে যান। আরাকানে থাকা অবস্থাতেই তাদের অনেকে মুসলমান ছিলেন।
ইতিহাস থেকে দেখা যায়, ১৭৩৭ সালে শের মস্ত খাঁ, ১৭৪০ সালে সোনা খাঁ, ১৭৪৯ সালে শের জব্বার খান, ১৭৬৩/৬৫ সালে নূরুল্লা খান, ১৭৭১ সালে ফতেহ খান, ১৭৭৬ সালে শের দৌলত খান, ১৭৮৩ সালে জান বখশ খান, ১৮০০ সালে তব্বার খান, ১৮০১ সালে জব্বার খান, ১৮১২ সালে ধরম বখশ খান প্রমুখ ছিলেন এতদঞ্চলের চাকমা রাজা। ১৮৭২ সালে হিন্দু গোপীনাথের পুত্র হরিশচন্দ্র রাজা হওয়ার পর থেকেই চাকমা সর্দার মহলে মুসলমানি নাম ও খেতাব ধারণ ছেড়ে দেওয়া হয়।
অবশ্য এই শেষোক্ত রাজার সময়ও রাজমাতা নিজে ধরম বখশ খাঁর কন্যা হিসেবে সমগ্র জীবনকাল চিকন বিবি নামে পরিচিত ছিলেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, চাকমা রাজদরবারে মোগলাই পোশাক ও নিয়ম-কানুন চালু ছিল; কুর্নিশ, নজর ও নিয়াজ চালু ছিল। রাজারা মৌলভি দিয়ে পাগড়ি পরতেন। রাজাদের ‘হুজুর’ ও রানিদেরকে ‘রানি সাহেবা’ ডাকা হতো। রানি বা রাজমাতাদের ‘বিবি’ও বলা হতো। চাকমা রাজদরবারে সালাম, খোদা, খানা, ওয়াক্ত, তালাক, কুটুম—এসব শব্দের প্রচলন ছিল। এখনো চাকমাদের মধ্যে অনেক মুসলিম শব্দ—আরবি-ফারসি শব্দ চালু আছে।
ঐতিহাসিক প্রফেসর ড. আলমগীর এম সিরাজুদ্দিন তার ‘Origin of the Raja’s of the Chittagong Hill Tracts’ শীর্ষক গবেষণা প্রবন্ধে (প্রকাশিত: Journal of the Pakistan Historical Society, Karachi : Vol. xix, Part 1, January 1971) দেখিয়েছেন, রাঙামাটির চাকমা রাজবাড়িতে রক্ষিত প্রত্ন নিদর্শনে চাকমা রাজা শের জব্বার খাঁর ব্যবহৃত সিল (রাবার স্ট্যাম্প) সংরক্ষিত আছে, যাতে লেখা রয়েছে-‘রোসাং, আরাকান, আল্লাহু রাব্বি ১১১১ শের জব্বার খান’। এ থেকে খুবই স্পষ্ট, শের জব্বার খাঁর সময়ে চাকমারা আরাকানের রোসাং অঞ্চলে বাস করত। শের জব্বার খাঁর সর্দারির সময়কাল উল্লিখিত সিল মোতাবেক ১১১১ মঘী, অর্থাৎ ১৭৪৯ খ্রিষ্ট সালে আরম্ভ হয়।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৭৬৫ সালে তার মৃত্যু হয় এবং সে সময় থেকে চট্টগ্রামের এতদঞ্চলে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সূত্রপাত হয়। সতীশ চন্দ্র ঘোষের ‘চাকমা জাতির ইতিহাস’ গ্রন্থে এবং সতীশ ঘোষের শিষ্য বিরাজ মোহন দেওয়ানের ‘চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে ও বিরাজ দেওয়ানের ‘পাকিস্তানের উপজাতি’ গ্রন্থে এসব তথ্যের স্বীকৃতি আছে।
আরো দেখুন: সিআর চাকমা, ‘যুগ বিবর্তনে চাকমা জাতি মধ্যযুগ’। ওপরের তথ্যাদি থেকে এটি খুবই স্পষ্ট বোঝা যায়, চাকমারা বাংলাদেশের ভূমিপুত্র নয়। তারা রোসাং, আরাকান বা উপমহাদেশের অন্য কোনো অঞ্চল বা আরো দূরের কোনো স্থান থেকে এসেছে। তারা নিঃসন্দেহে বহিরাগত।
পক্ষভুক্ত ইতিহাসবিদরা যা বলেন সেটাও বিচার্য। সতীশ ঘোষ চাকমাদের ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে ভূরি ভূরি মিথ্যার আশ্রয় নিলেও এ কথা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে, চাকমাদের আদি নিবাস পার্বত্য চট্টগ্রাম নয়, তারা বাইরে থেকে এসেছে; বাস্তবেও তা-ই (Bangladesh District Gazetteers, Chittagong Hill Tract, pp. 33-34)।
সতীশ ঘোষের শিষ্য বিরাজ মোহন দেওয়ান ‘চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত’ (রাঙামাটি: পার্বত্য চট্টগ্রাম, ১৯৬৯) গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন, ‘চাকমাদের পূর্বপুরুষরা যে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমিজ সন্তান নহে, তাহা স্পষ্ট।’ (পৃ. ৯৪)। সাংবাদিক জয়নুল আবেদীন ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম: স্বরূপ সন্ধানে’ (ঢাকা : ১৯৯৭) গ্রন্থে এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন।
কোনো কোনো চাকমা ইতিহাসবিদ নিজেদের আদি দেশ হিসেবে চম্পাপুরী কিংবা চম্পকনগর নামে যে রাজ্যের বর্ণনা তাদের লেখায় প্রদান করেন, সেটিও প্রমাণবিহীন বা বাস্তববর্জিত। কেননা ভারতে ও এর বাইরে অন্তত পাঁচটি স্থানের নাম চম্পাপুরী বা চম্পকনগর।
এগুলো হচ্ছে উত্তর বার্মা তথা শান, প্রাচীন মগ্ধ তথা আজকের বিহার, কালাবাঘা তথা আজকের আসাম, প্রাচীন মালাক্কা তথা আজকের মালয়, কৌচিন ও হিমালয়ের নিচে সাংগুপু নদীর তীর, অর্থাৎ আজকের দিনের ব্রহ্মপুত্র তীর। কিন্তু এগুলোর কোনোটিতেও চাকমাদের আদি অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। আসলে চম্পক, চম্পা—এসব শব্দের সঙ্গে চাকমা শব্দের খানিকটা মিল থাকায় চাকমারা কল্পনা মিশিয়ে আবিষ্কার করতে চান যে চম্পক বা চম্পানগর তাদের আদি বাসস্থান।
‘বর্তমান ভারতে এবং ভারতের বাইরে বহু চম্পাপুরী বা চম্পকনগরের নাম পাওয়া যায়। এজন্য এই নামটি নিয়ে বিভ্রান্তি থাকা স্বাভাবিক,’ বলেছেন অশোক কুমার দেওয়ান (‘চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার’, খাগড়াছড়ি, ১৯৯১, পৃ. ৩৫)।
চাকমারা কোথা থেকে এসেছে, তাদের আদি উৎপত্তি কোথায়, এ জাতির যাথার্থ্য—এসব ব্যাপারে কোনো ঐতিহাসিক স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি। এ ছাড়া চাকমা জাতির কোনো প্রামাণ্য গ্রন্থ নেই। এ জাতির প্রকৃত নামটি পর্যন্ত লুপ্ত হয়েছে। বিরাজ দেওয়ান তার গ্রন্থে এ সত্য মেনে নিয়েছেন। সুগত চাকমা নামে আরেক লেখক চাকমাদের আদি বাসস্থান নিয়ে সংশয়মুক্ত হতে পারেননি।
তিনি বলেছেন, ‘চাকমাদের বিশ্বাস সুদূর অতীতে তারা চম্পকনগর নামক একটি রাজ্যে বাস করত’ (‘পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি ও সংস্কৃতি’ রাঙামাটি, ১৯৮৩, পৃ. ১৭)) এদিকে সিআর চাকমা নামক আর একজন লেখক জানিয়েছেন, চতুর্দশ থেকে পতন শতক নাগাদ চাকমারা বার্মায় মার খেয়ে প্রাণ বাঁচাতে পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে প্রবেশ করে। (‘যুগ বিবর্তনে চাকমা জাতি মধ্য যুগ’ হাওড়া: লিলুয়া ১৯৮৮, পৃ. ৬৭)।
বস্তুত, চাকমাদের প্রামাণ্য ইতিহাস পাওয়া যায় না (দেবযানী দত্ত ও অনসূয়া বায় চৌধুরী, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম সীমান্তের রাজনীতি ও সংগ্রাম’, কলকাতা, ১৯৯৬, পৃ. ১১), তাদের সম্পর্কে গালগল্পই লভ্য হয়। বিরাজ দেওয়ান দেখিয়েছেন, চাকমা ভাষা আজকে বাংলা ও সংস্কৃতের মিশ্রণে চাকমা-বাংলায় রূপান্তরিত হয়েছে। শতকরা আশি ভাগ ক্ষেত্রে এ ভাষার শব্দ বাংলা-সংস্কৃতের মিশ্রণ। এটি বস্তুত বাংলার অপভ্রংশ। বিরাজের মতে, ‘কালের স্রোতে চাকমা ভাষা আজ বিলুপ্তির পথে।’
চাক ও চাকমারাও যে এক নয় এবং চাকদের ইতিহাসটুকু আত্মসাৎ করার জন্যই যে কোনো কোনো চাকমা ইতিহাসবিদ ও বুদ্ধিজীবী মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন, সে সত্যও বেরিয়ে এসেছে বিরাজ মোহন দেওয়ান, অশোক কুমার দেওয়ান, বঙ্কিমচন্দ্র দেওয়ান, দেবযানী দত্ত, অনুসূয়া রায় চৌধুরী প্রমুখের লেখা থেকে। অশোক দেওয়ান জানিয়েছেন, সতীশ ঘোষদের প্রদত্ত চাকমা জাতির এক হাজার পাঁচশ বছরের ইতিহাস প্রকাণ্ড মিথ্যা, প্রবঞ্চনা, বিভ্রম ও আজগুবি কাহিনিতে ভরা খিচুড়ি (অশোক দেওয়ান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫০-৭৬)। অশোক দেওয়ান মিথ্যা ইতিহাস পরিত্যাগ করে সত্য ইতিহাস অনুসন্ধানের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।
চাকমা লোকগাথা কী বলে—(১) চাকমাদের মধ্যে বহুল প্রচলিত দুটি পঙ্ক্তি হচ্ছে: ‘আদি রাজা শের মস্ত খাঁ/ রোয়াং ছিল বাড়ি/ তারপর শুকদেব রাজায় বান্ধে জমিদারি।’ এ থেকে মনে হয়, চাকমাদের আদি বাস ছিল উত্তর আরাকানের রোসাংয়ে (Roang/Rohang/Roshang)। (২) চাকমাদের অতি পরিচিত লোকগীতি হচ্ছে: ঘরত গেলে মগে খায়/ ঝারত গেলে বাঘে খায়/ বাঘে না খেলে মগে খায়/ মগে খেলে বাঘে খায়।’ এই লোকগীতি থেকে মনে হয়, চাকমারা আরাকানের মগদের কর্তৃক বিতাড়িত হওয়ার পর অস্তিত্ব রক্ষার্থে বাংলার চট্টগ্রামের পার্বত্যাঞ্চলে অর্থাৎ আজকের পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে আশ্রয় নেয়।
ঐতিহাসিক অধ্যাপক ড. আবদুল করিমও এ রকম মত পোষণ করেছেন যে, প্রাচীন মানচিত্রে পর্তুগিজ জোয়ান ডি ব্যারোজ চাকোমাস নামের এক অঞ্চল নির্দেশ করেছেন, যা রাইংক্ষ্যং ও সুবলং উপ-নদীদ্বয়ের উৎস অঞ্চলের পূর্বদিকে চীন পাহাড় এলাকায় অবস্থিত। এ থেকে প্রমাণিত হয়, উত্তর আরাকানে চাকমাদের আদি বাসভূমি ছিল (Dr. Abdul Karim, ‘The Map of Joan de Barros, Dated about 1550 AD, Journal of Asiatic Society of Pakistan, 1963, Vol. Vill, No. 2)।
লিউইন, হাচিনসন, উইলসন্স, পার্ন—তৎকালের এই ব্রিটিশ সিভিল সার্ভেন্টদের বক্তব্য অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম জেলা প্রশাসক টি এইচ লিউইনকে এ অঞ্চল-সম্পর্কিত বিষয়ে অথরিটি বিবেচনা করা হয়।
তিনি বলেন, ‘উপজাতীয়দের মধ্যে যারা আজকের দিনে চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে বাস করছে, তাদের অধিকাংশ প্রায় দুই পুরুষ আগে আরাকান থেকে এসেছে। এটি তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য আর ওইসব দলিলপত্রের মাধ্যমে প্রমাণিত, যেসব কিছু চট্টগ্রামের কালেক্টরেটের রেকর্ডে রয়েছে (T.H. Lewin, ‘The Hill Tracts of Chittagong and the Dwellers Therein’, pp. 28-29)।
টিএইচ লিউইন আরো জানান, তৎকালীন বার্মার (মিয়ানমার) কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ ব্যাপারে ইংরেজদের যোগাযোগের সবচেয়ে পুরোনো দলিল হচ্ছে দুটি পত্র। এর একটি বার্মার সম্রাট কর্তৃক এবং অন্যটি আরাকানের রাজা কর্তৃক ইংরেজ অধিকৃত চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধানের কাছে লিখিত। সম্ভবত ১৭৮৭ সালের ২৪ জুন পাওয়া গেছে। লিউইন তার গ্রন্থে চিঠি দুটি তুলে ধরেছেন (Lewin, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৮-২৯)।
হাচিনসন জানিয়েছেন, ‘এই উপজাতীয় মানুষেরা নিজেদেরকে দেশত্যাগী সেসব বিহারবাসীর বংশধর বলে মনে করে, যারা এই ভূখণ্ডে আরাকানি রাজাদের শাসনকালে বসতি তৈরি করেছে (Hutchinson, ‘An Account of Chittagong Hill Tracts’, Calcutta, 1906, p. 89)।’ উইলসন জানিয়েছেন, চাকমারা আরাকান অঞ্চল থেকে পালিয়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলে এসেছে (Wilsons, Narrative of the Burmesewar, p. 25)। বিআর পার্নও জানিয়েছেন, আরাকানের আক্রমণ ও লুটপাটের কালে সেখানকার রাজার সঙ্গে সঙ্গে পালিয়ে এ দেশে চলে আসে চাকমারা (Journal of Burma Research Society, ‘The King Bering’; page 44/48, Dt. 23.11.1933) ও ওপরের আলোচনা থেকে এটি পুরোপুরি প্রমাণিত যে, চাকমারা অন্য দেশ থেকে এখানে এসেছে। তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের আদি অধিবাসী নয়, ভূমিপুত্র তো নয়ই।
আরো লক্ষণীয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য উপজাতিও বহিরাগত। দ্বিতীয় উপজাতি মারমারা মিয়ানমার থেকে আরাকান হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে এসেছে। ‘মারমা’ শব্দটি ‘ম্রাইমা’, ‘মিয়ানমার’ এদের কাছাকাছি। আর এইচ এস হাচিনসন জানিয়েছেন, মারমা রাজা ১৭৫৬ সালে মুঘলদের দ্বারা মূল বার্মা থেকে বিতাড়িত হয়ে আরাকানে এবং সেখান থেকে প্রথমে তৎকালীন রামুতে, ঈদগড়ে, এরপর মাতামুহুরী এলাকায় এবং অবশেষে আজকের বান্দরবান শহরে আশ্রয় নেন (হাচিনসন, প্রাগুক্ত)। সুগত চাকমাও তার প্রাগুক্ত গ্রন্থে এই তথ্য দিয়েছেন। যো শব্দ থেকে উদ্ভূত মুরং। এরাও উত্তর বার্মা থেকে ১৮ শতকের শেষের দিকে চট্টগ্রামে আগমন করে। এরা আগে বার্মার আরাকান রাজ্যে বাস করত।
এখন এরা থাকে। বান্দরবানে (আবদুল হাফিজ, ‘পাকিস্তানের উপজাতি’, ঢাকা: পাকিস্তান পাবলিকেশন্স, ১৯৬৩, পৃ. ৪৫। সুগত চাকমা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৭। M. R. Shelley, ‘The Chittagong Hill Tracts of Bangladesh: The Untold Story’, Dhaka: Centre for Development Research, 1992, p. 83)। ত্রিপুরা উপজাতি যারা মূলত পার্বত্য খাগড়াছড়িতে থাকে, তারা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে আগমন করে পার্বত্য চট্টগ্রামে (সুগত চাকমা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৬)।
লুসাইরা যারা মূলত রাঙামাটির সাজেক এলাকায় বাস করে, তারা ভারতের মিজোরামের লুসাই পাহাড় অঞ্চল থেকে এ দেশে আসে ১৫০ বছর আগে (Shelley, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৭)। খুমীরা ১৭ শতকের শেষ দিক পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে আসার আগে মিয়ানমারের (বার্মার) আরাকানের অধিবাসী ছিল (T. H. Lewin, প্রাগুক্ত এবং Shelley, পৃ. ৫৮)।
বোমরা ১৮৩৮ সালের দিকে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে আশ্রয় নেয় এবং এখন থাকে বান্দরবান জেলার রুমা এলাকায়। ১৮ শতকের খুব সম্ভবত দ্বিতীয়ার্ধে ক্ষিয়াংরা আরাকানের উমাতানং পাহাড়ি অঞ্চল থেকে এসে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস শুরু করে। এখন তারা থাকে পার্বত্য রাঙামাটির কাপ্তাই ও চন্দ্রঘোনা অঞ্চলে (Shelley, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬২)। চাকরা সম্ভবত মিয়ানমারের সীমানায় চীনের ইউনান প্রদেশ থেকে আরাকান হয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছিল।
পাংখোরা ভারতের মিজোরামের লুসাই পাহাড় এলাকা থেকে এসেছে পার্বত্য চট্টগ্রামে (Shelley, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৪)। তনচইঙ্গারাও বাইরে থেকে এ দেশে এসেছে। তারা চাকমাদের উপশাখা হলেও এখন স্বতন্ত্র পরিচয় দেয়।
ওপরের আলোচনা থেকে এটি একেবারে স্পষ্ট, চাকমাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের কোনো উপজাতিই এ দেশের ভূমিপুত্র নয়, আদিবাসী নয়।
তারা বহিরাগত, অভিবাসী। কিন্তু এর পরও তারা বাঙালিদের, এ দেশের মূল অধিবাসীদের কীভাবে বহিরাগত বলে অত্যাচার, নিপীড়ন, সন্ত্রাস ও হত্যার শিকার করে তুলছে? কীভাবে তারা বাঙালিকে বহিষ্কার করছে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে? কীভাবে তারা খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, রাঙামাটি থেকে শত শত বাঙালি পরিবারকে উৎখাত করেছে এবং দখল করেছে তাদের জমি, বাগান, ব্যবসা-বাণিজ্য? কীভাবে তারা হত্যা করেছে শত শত বাঙালি মুসলিমকে, যারাই সত্য ও ইতিহাসের বিচারে ওই অঞ্চলের আদিবাসী। তাই আদিবাসী নয়, দাবিকারীদের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীই বলতে হবে এবং তাদের তিন জেলার বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার করতে হবে। এটাই বৈষম্যের অবসান ঘটানোর একমাত্র পথ।
লেখক : প্রফেসর (অব), রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়