চিকিৎসায় বিদেশে যাচ্ছে বিপুল অর্থ

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ৩ এপ্রিল, ২০২৫
  • ৫৭ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতার পালাবদলের পর ভারত ভিসা সীমিত করায় দেশের রোগীদের বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা অনেকটা কমেছে। এতে অনেক রোগী এখন দেশেই চিকিৎসা নিচ্ছে।

খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই সুযোগে দেশের স্বাস্থ্য খাতে চিকিৎসাসেবায় আস্থার সংকট কাটানোর ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে উন্নতমানের হাসপাতাল তৈরি ও চিকিৎসাসেবার সক্ষমতা বাড়ালে রোগীদের বিদেশমুখিতা কমবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, বাংলাদেশিরা বিদেশে চিকিৎসার জন্য বছরে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি। তবে বেসরকারি হিসাব মতে, এই খরচ আরো অনেক বেশি।

বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার ক্ষেত্রে যে অর্থ ব্যয় হচ্ছে, তার ন্যূনতমও ব্যাংকের মাধ্যমে যাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ। তিনি বলেন, ‘বিদেশে চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যাংকের যে অর্থ যাচ্ছে, তা প্রকৃত চিত্রের নগণ্য পরিমাণ।
অনেকেই মানি এক্সচেঞ্জারের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা কিনছে। ব্যাংক থেকে নিলে সেই হিসাব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে থাকছে। আবার মানি এক্সচেঞ্জারগুলো সঠিক হিসাব না দিলে তা থাকছে না। অন্যদিকে মানুষ এনডোর্স করা অর্থের বেশি নিয়ে যায়।
আরেকটি বিষয় হলো, ক্রেডিট কার্ডে খরচের খাত বলা হয় না। বাস্তবে ব্যয় সরকারি হিসাবের চার-পাঁচ গুণ বেশি হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।

তিনি বলেন, বিদেশে স্বাস্থ্য খাতের ব্যয়গুলোকে চিহ্নিত করার মতো কার্যকর কোনো ব্যবস্থা এখনো গড়ে ওঠেনি বাংলাদেশে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য খাতের ব্যয়গুলোর কোনো হিসাব ব্যাংকের কাছে থাকে না। আবার এসংক্রান্ত অনুমোদনের পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া বেশ জটিল।
ফলে অনেকেই ডলার সংগ্রহ করছেন কালোবাজার, মানি এক্সচেঞ্জার বা অনানুষ্ঠানিক মাধ্যমে। এতে অবৈধ হুন্ডির বাজার আরো শক্তিশালী হচ্ছে।

তবে বিশ্বমানের হাসপাতাল তৈরির সুযোগ বাংলাদেশ কতটা কাজে লাগাতে পারবে, তা নির্ভর করছে স্বাস্থ্য খাতে সরকারের সামর্থ্য বাড়ানো ও সাশ্রয়ী মূল্যে মানসম্পন্ন চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার ওপর।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের ভিসা বন্ধ আশীর্বাদ হিসেবে ধরে চিকিৎসা সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি। স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার, অবকাঠামো উন্নয়ন ও প্রযুক্তিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশকে মেডিক্যাল হাব হিসেবে গড়ে তোলার এখনই সময়।

সম্প্রতি বিদেশে চিকিৎসা নিয়েছেন এমন চারজন রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁদের ভাষ্য, বাংলাদেশে চিকিৎসার খরচ বেশি, রোগ নির্ণয় যথাযথ হয় না, চিকিৎসকরা রোগীর কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন না এবং অপ্রয়োজনীয় ওষুধ দিয়ে থাকেন। এসব কারণে দেশের চিকিৎসায় তাঁদের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে।

মোহাম্মদপুর এলাকার নীরব আহমেদ জানান, মেরুদণ্ডের সমস্যা নিয়ে তাঁর একমাত্র ছেলে বর্তমানে থাইল্যান্ডে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তিনি জানান, দেশের উন্নত বেসরকারি হাসপাতালে এর চিকিৎসা থাকলেও বিদেশের তুলনায় খরচ অনেক বেশি।

রাজধানীর দারুসসালাম এলাকার বাসিন্দা সুজিৎ নন্দী লিভারের সমস্যার চিকিৎসা করাতে কয়েকবার বিদেশে গেছেন। সবচেয়ে বেশি গেছেন ভারতে। প্রতিবারই আড়াই থেকে তিন হাজার ডলার খরচ হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের চিকিৎসাব্যবস্থার সঙ্গে বিদেশের চিকিৎসাব্যবস্থার কিছু পার্থক্য রয়েছে। বিদেশে ডায়াগনোসিস (রোগ নির্ণয়) ভালো, ডাক্তাররা রোগীদের সমস্যার কথা সময় নিয়ে শোনেন, আচরণ ভালো। বাংলাদেশে চিকিৎসাব্যবস্থায় এসবের পরিবর্তন আনতে পারলে রোগীরা বিদেশমুখী হবে না।

এ ব্যাপারে অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, বিদেশমুখী প্রবণতা কমাতে এ পর্যন্ত সরকার থেকে কোনো উদ্যোগ বা পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি। বরং স্বাস্থ্য খাতকে বিদেশনির্ভর করে ফেলা হয়েছে। এতে রোগীদের দেশের চিকিৎসার প্রতি আস্থা কমার পাশাপাশি বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করানোয় আস্থা তৈরি হয়েছে।

বিদেশে চিকিৎসা ব্যয় বছরে ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি : প্রতিবছর কতজন মানুষ বিদেশে চিকিৎসা নিতে যায়, এর সঠিক পরিসংখ্যান নেই। কারণ চিকিৎসা ভিসা অপরিহার্য শুধু বিদেশে অস্ত্রোপচার করাতে। এ ছাড়া মেডিক্যাল বোর্ডের সুপারিশ, চিকিৎসার যাবতীয় কাগজ জমা দেওয়ার প্রসঙ্গ থাকায় অনেকে ভ্রমণ ভিসায় বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করাচ্ছে।

সম্প্রতি পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআরআই) ও বিশ্বব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ‘ক্রস বর্ডার ডেটা ফ্লো : আ বাংলাদেশ পারসপেক্টিভ’ শীর্ষক কর্মশালায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর জানান, বাংলাদেশিরা বিদেশে চিকিৎসার জন্য বছরে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি।

সম্পতি ‘চিকিৎসাসেবায় বিদেশমুখিতা : আমাদের উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, ২০২৩ সালে চার লাখ ৪৯ হাজার ৫৭০ জন বাংলাদেশি স্বাস্থ্যসেবার জন্য বিদেশ ভ্রমণ করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৪৮ শতাংশ বেশি।

বিদেশে চিকিৎসা নেওয়া শীর্ষ দশে বাংলাদেশ : বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) বিজ্ঞানী আহমদ এহসানূর রহমান বলেন, এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বের যেসব দেশ থেকে বেশি রোগী চিকিৎসার জন্য অন্য দেশে যায়, এমন ১০টি দেশের মধ্যে শীর্ষ ইন্দোনেশিয়া। এই তালিকার ১০ নম্বরে বাংলাদেশ। অন্য দেশগুলো হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইতালি, জার্মানি, লেসোথো, দুবাই ও লিবিয়া।

বাংলাদেশ থেকে বিদেশমুখী রোগীদের ৫১ শতাংশ যায় ভারতে। থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে যায় ২০ শতাংশ করে। যুক্তরাজ্যে রোগী যাওয়ার হার ৩ শতাংশ। ২ শতাংশ করে যায় জাপান ও মালয়েশিয়ায়। ১ শতাংশ করে যায় চীন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে।

আহমদ এহসানূর রহমান বলেন, আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ভারতে চিকিৎসা নিতে যায়, এই তালিকায় প্রথমে আছেন ব্যবসায়ীরা, দ্বিতীয় স্থানে বেসরকারি চাকরিজীবীরা, তৃতীয় স্থানে দিনমজুররা। এরপর রয়েছেন সরকারি চাকরিজীবী, শিক্ষক, গৃহিণী, চিকিৎসক। অন্যদের মধ্যে রয়েছেন সাংবাদিক, পুলিশ, শিক্ষার্থী, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, প্রকৌশলী, প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্য।

তিনি বলেন, আটটি দেশে যাওয়া রোগীদের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিদেশে মানুষ মূলত চেকআপের জন্য বেশি যায়। তবে ভারতে ২০টির বেশি কারণে বাংলাদেশি রোগীরা চিকিৎসা নিতে যায়। এর মধ্যে রয়েছে হৃদযন্ত্রসংশ্লিষ্ট ও চোখের ছানিজনিত অস্ত্রোপচার। তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে রয়েছে যথাক্রমে কিডনি রোগ ও ক্যান্সার চিকিৎসা।

সরকারের পরিকল্পনা : প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তদের মধ্যে বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার একটা সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। আমরা এই প্রবণতা কমাতে উদ্যোগ নিয়েছি। তবে এর সুফল মাত্র ছয় মাসে পাওয়া সম্ভব নয়।’

ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘মূলত চারটি সমস্যা নিয়ে রোগীরা বেশি বিদেশি যাচ্ছে। এর মধ্যে ক্যান্সার সমস্যা, অঙ্গ প্রতিস্থাপন ও হার্টের রোগ অন্যতম। হার্টের চিকিৎসায় ব্যবস্থা যথেষ্ট উন্নত হয়েছে। অন্যগুলোর উন্নতিতে দু-তিন বছর সময় লাগবে। আমরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুরু করেছি। মানুষ যে যে কারণে বিদেশে যায়, সেগুলো চিহ্নিত করে বাংলাদেশে বিশেষায়িত হাসপাতাল অথবা বিএমইউ (বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) যেখানে যেটা প্রযোজ্য, সে জায়গায় অবকাঠামো ও জনবল প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা শুরু করেছি। এগুলোর ফল পেতে সময় লাগবে।’

বিদেশমুখী প্রবণতা বাড়ার কারণ : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. মুশতাক হোসেন বলেন, রোগীরা বিদেশে যারা যাচ্ছে, বেশির ভাগই জটিল ও গুরুতর রোগের কারণে। সরকারি পর্যায়ে মানসম্পন্ন প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা গেলে জটিল রোগের হার কমে আসবে। একই সঙ্গে রোগীদের বিদেশমুখী প্রবণতাও কম আসবে।

তিনি বলেন, স্বাস্থ্য খাতে পুঁজির বিনিয়োগ ঠিকমতো হয়নি। বিনিয়োগ হয়েছে ঢাকাকেন্দ্রিক। দেশের ৯৫ শতাংশ অস্ত্রোপচার হয় ঢাকায়। সারা দেশে অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা থাকলে পরিস্থিতি এমন হতো না। যেহেতু প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য নয়, অনেকে শুরুতে চিকিৎসা করাতে চান না। যখন পরিস্থিতি বেগতিক হয়, খরচও বেড়ে যায়, তখন জায়গাজমি বেচে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যায়। কারণ দেশের পাঁচতারা হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যয় বিদেশের তুলনায় অনেক বেশি।কালের কণ্ঠ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions