ডেস্ক রির্পোট:- দেশে গত বছরের শেষ পাঁচ মাসে এক হাজার ৫৬৫ জন খুন হয়েছে। এতে প্রতি মাসে গড়ে খুন হয়েছে ৩১৩ জন। এ সময় হামলাকারীদের ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো অস্ত্রে দেড় সহস্রাধিক মানুষ আহত হয়। পুলিশ সদর দপ্তর, হাসপাতাল ও হতাহতের পরিবার সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
চলতি বছরের শুরুতেও এই অপরাধমূলক ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। চলতি জানুয়ারি মাসের ২৫ দিনে দেশে প্রতিদিন একাধিক ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে বলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে।
দেশের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিষয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। পুলিশের সব ইউনিটপ্রধানকে এ ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অভিযান চালিয়ে অনেক অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’
সূত্র বলছে, চলতি মাসের গত ২৫ দিনে দেশে প্রতিদিন একাধিক ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে। এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক সহিংসতা, চাঁদাবাজি, ছিনতাই ও ডাকাতি। এসব ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা হলেও বেশির ভাগ অপরাধী অধরা।
তারা আরো অপরাধে জড়াতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।
সর্বশেষ গত শুক্রবার এক দিনেই তিনটি চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এর মধ্যে মধ্যরাতে রাজধানীর মিরপুরের দিয়াবাড়ী সিটি বস্তিতে মো. মিলন নামের এক পোশাককর্মীকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
একই দিন রাত সাড়ে ৯টায় খুলনা নগরের তেঁতুলতলা মোড় এলাকায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অর্ণব কুমার সরকারকে প্রকাশ্যে গুলি ছুড়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।
এর আগে ওই দিন দুপুরে চট্টগ্রামের রাউজানে জুমার নামাজ আদায়ে যাওয়ার সময় সন্ত্রাসীদের গুলিতে জাহাঙ্গীর আলম (৫৫) নামের এক ব্যবসায়ী নিহত হন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এভাবে প্রতিদিন রাজধানী বা ঢাকার বাইরে চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন এলাকায় নদী, খাল-বিল, মাঠ, ঝোপ-জঙ্গল থেকে অজ্ঞাতপরিচয় লাশ উদ্ধারের ঘটনা ঘটছে। একই সঙ্গে চুরি-ছিনতাই, দস্যুতা ও ডাকাতির মতো অপরাধমূলক ঘটনা বেড়েছে।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবে নির্বিচারে মানুষ হত্যা ও বিভিন্ন অপরাধমূলক ঘটনা বেড়ে যাওয়া মানে সমাজে চরম বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। তাঁদের মতে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীগুলোর ব্যর্থতার কারণেই মূলত এসব ঘটছে। এটা নিয়ন্ত্রণ করে জনমনে শান্তি ফেরাতে হবে।
হত্যার নেপথ্যের কারণ বিশ্লেষণে পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে, পূর্বশত্রুতা, রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, সম্পত্তির লোভ ও সম্পর্কের টানাপড়েনের মতো ঘটনার জেরে হত্যার ঘটনা বাড়ছে। এমনকি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করেও কুপিয়ে হত্যার মতো ঘটনা ঘটছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের গত এক বছরের তথ্য বলছে, দেশে ২০২৪ সালে তিন হাজার ৪৩২ জন বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ খুন হয়েছে। এর মধ্যে পেশাজীবীর সংখ্যা বেশি। গত আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে এক হাজার ৫৬৫ জন খুন হয়। এর আগের সাত মাসে খুন হয় এক হাজার ৮৬৭ জন। এই হিসাবে প্রতি মাসে গড়ে ২৬৭ জন খুন হয়।
পুলিশের অন্য এক তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চার মাসে দেশে ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনায় ৭৯৬টি মামলা হয়েছে। আগের বছর ২০২৩ সালে একই সময়ে এই অপরাধে মামলা হয় ৪৯৪টি। একই সময়ে অপহরণের ঘটনায় ৩০২টি মামলা হয়। ২০২৩ সালের এ সময় এসব অভিযোগে মামলা হয় ১৬০টি।
পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ সাধ্যমতো কাজ করছে। কিন্তু কিছু সামাজিক অপরাধের কারণেই খুনের পরিসংখ্যান বাড়ছে।
পুলিশ ও আদালতের অপরাধবিষয়ক তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ১ নভেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এক মাসে রাজধানীর ৫০টি থানা এলাকায় অন্তত ৩৪ জন ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে মামলা করেছে। মেয়র হানিফ উড়ালসেতুতে গত ১৮ ডিসেম্বর কামরুল হাসান নামের একজন ছিনতাইকারীদের ধারালো অস্ত্রে খুন হন। এর আগে ১৫ ডিসেম্বর হাবিব উল্লাহ নামের একজন মগবাজার এলাকায় ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন। আহত হয়েছেন অনেকে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার রাতে কামরাঙ্গীর চর বেড়িবাঁধ এলাকায় সজল রাজবংশী নামের এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে টাকাসহ ৭০ ভরি স্বর্ণালংকার ডাকাতির অভিযোগ পাওয়া যায়।
একই সঙ্গে চাঁদাবাজির ঘটনাও বাড়ছে। গত ১০ জানুয়ারি রাতে চাঁদা না পেয়ে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের সামনে ব্যবসায়ী এহতেশামুল হককে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে নিউ মার্কেট থানায় মামলা হয়।
রাজধানীতে খুন, ছিনতাই, ডাকাতিসহ অপরাধ বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার (ডিএমপি) মো. সাজ্জাত আলী বলেন, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী তৎপর রয়েছে। অপরাধ করে পার পাওয়ার সুযোগ নেই।
খুনের ঘটনা বাড়ছে
দেশে সাম্প্রতিক ১৫টি হত্যার ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১১টি খুনে ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করা হয়। বাকি তিনটি গুলি করে হত্যা।
গত ২২ জানুয়ারি মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগে রুবেল নামের এক যুবককে ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল জাদুরানী বাজারের একটি বটগাছে দুই হাত বেঁধে ঝুলিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। গত ২০ জানুয়ারি রাজধানীর পল্লবীতে বাবু নামের একজনকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। গত ১ জানুয়ারি কিশোর-তরুণ অপরাধীরা মালপত্র ছিনিয়ে নিতে না পেরে হাসিবুল ইসলাম নামের একজনকে কুপিয়ে হত্যা করে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. মুনতাসীর মারুফ বলেন, নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পেছনে দায়ী বা জড়িত ব্যক্তিদের মনোসামাজিক বিশ্লেষণধর্মী গবেষণার অপ্রতুলতা রয়েছে। দেশে সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে মানুষের হত্যাপ্রবণতার কারণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়াবলি নির্ণয়ে এ ব্যাপারে নির্মোহ, পক্ষপাতহীন গবেষণা প্রয়োজন। কারণ অপরাধ সংঘটনে ও সহিংসতা বিস্তারে ব্যক্তির চেয়ে সমাজ বেশি দায়ী।
অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষক অধ্যাপক ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, মানুষের প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির মিল না হলে প্রতিশোধপ্রবণ হয়ে ওঠে। পাওয়া-না পাওয়ার দ্বন্দ্বেও মানুষ আগ্রাসী ও হিংস্র হয়ে হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। তাই সামাজিক-পারিবারিক অস্থিরতা দূর করে স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে রাষ্ট্র, সমাজ ও নাগরিকদের নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে হবে । কালের কণ্ঠ