দেয়ালে নতুন বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় রবিবার, ১৯ জানুয়ারী, ২০২৫
  • ৯ দেখা হয়েছে

মাহবুব আলম:- জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের আলোচিত বিষয়গুলোর অন্যতম গ্রাফিতি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকে সীমিত পরিসরে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দেয়ালচিত্র বা গ্রাফিতি আঁকতে দেখা যায়। রংপুরে পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদের মৃত্যুর পর গ্রাফিতিতে উঠে আসে তাঁর বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার অসীম সাহসী লড়াইয়ের চিত্র। তারপর একে একে মুগ্ধ, ফাইয়াজসহ ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শহীদদের মুখোচ্ছবি ও লড়াইয়ের ময়দানের লড়াকু মুহূর্তের চিত্র।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে গ্রাফিতি আঁকার কর্মসূচি দেওয়া হলে এই গ্রাফিতি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। গ্রাফিতি হয়ে ওঠে আন্দোলনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

গ্রাফিতি এমন একটি শিল্প, যার মাধ্যমে ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানুষের মনোভাব শান্তিপূর্ণ ও শৈল্পিকভাবে প্রকাশ করা যায়। নিজের চিন্তার প্রকাশ ও অন্যের ভেতরে তা ছড়িয়ে দেওয়ার গুরুত্বপূর্ণ শিল্পধারা গ্রাফিতি।
শুধু দেয়াল নয়, বিভিন্ন ওয়েবসাইট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এই গ্রাফিতি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্রাফিতি শিল্পী ব্যাংকিম বলেছিলেন, আপনার কাছে যদি লড়াইয়ের কোনো হাতিয়ার না থাকে, তবে গ্রাফিতি হয়ে উঠতে পারে একমাত্র অস্ত্র। সত্যি সেই অস্ত্রে শাণিত এক বিপ্লবগাথা হয়ে উঠেছে জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে।

৫ আগস্ট, ৩৬ জুলাই চূড়ান্ত বিজয়ের পর রংতুলিতে ফুটে ওঠে আন্দোলনের চিত্র ও আন্দোলনের জন-আকাঙ্ক্ষা।
তাইতো ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, সাতক্ষীরাসহ দেশের সর্বত্র দেয়ালে, ফ্লাইওভারে আঁকা হয় গ্রাফিতি। শত শত তরুণ-তরুণী, এমনকি শিশু-কিশোররা এই গ্রাফিতি অঙ্কনে অংশ নেয় দলবদ্ধভাবে। তারা তাদের কচি হাতে একদিকে যেমন বিজয়ের মুহূর্তগুলোকে তুলে ধরেছে; অন্যদিকে তারা তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়েছে গ্রাফিতিতে। এঁকেছে নতুন বাংলাদেশের, আগামীর বাংলাদেশের অর্থাৎ ওদের স্বপ্নের বাংলাদেশের চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে গ্রাফিতির মাধ্যমে। এতে একদিকে যেমন উঠে এসেছে প্রতিবাদ ও স্বৈরাচারের প্রতি তীব্র ঘৃণা; অন্যদিকে নগরীর জরাজীর্ণ অপরিচ্ছন্ন দেয়ালের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে বহুগুণ।
আর তাইতো পাঠ্যপুস্তকে যুক্ত হয়েছে গ্রাফিতি। এরই মধ্যে সেরা গ্রাফিতিগুলোকে নিয়ে ‘দি আর্ট অব ট্রায়াম্ফা’ নামে একটি আর্ট বুক প্রকাশিত হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতাদের এই আর্ট বুক উপহার দেওয়ার পর তাঁরা আবেগে আপ্লুত হন। শুধু তা-ই নয়, তাঁরা তাঁদের দেশে এই আর্ট বুক তাঁদের ভাষায় ক্যাপশন দিয়ে প্রকাশ করেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে তরুণ বিপ্লবীদের আঁকা গ্রাফিতি পরিদর্শন করে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাৎক্ষণিকভাবে গ্রাফিতি নিয়ে একটি আর্ট বুক প্রকাশের নির্দেশ দেন। এরই সফল বাস্তবায়ন ‘দি আর্ট অব ট্রায়াম্ফা’ প্রকাশ।

এসব দেয়ালচিত্র বা গ্রাফিতিতে সৃজনশীল হৃদয়গ্রাহী স্লোগান, কবিতা, বিপ্লবের চেতনা ও বৈষম্যবিরোধী বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষার শিল্পিত প্রতিফলন ঘটেছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় দেশবাসীর সমর্থন আদায়ে শিল্পের মাধ্যমে মুক্তির বার্তা পৌঁছে দেন গ্রাফিতি আঁকিয়ে তরুণ-তরুণীরা।

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দেয়ালচিত্র তথা গ্রাফিতি আঁকা হয়েছে, স্লোগান হিসেবে উঠে এসেছে—‘গাহি সাম্যের গান, যেখানে এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান’, ‘আজ থেকে মুছে ফেল সংখ্যালঘু তত্ত্ব, সবাই মোরা বাংলাদেশি এটাই চির সত্য’।

‘মহাকালের সাক্ষী হলো বাংলাদেশের নাম, যুদ্ধ করে জীবন দিয়ে বিজয় নিয়ে এলাম’, ‘বিকল্প কে? আমি তুমি আমরা’। ‘শেখ মুজিব ঘোড়ার ডিম……….’।

দেয়ালচিত্রগুলোতে উঠে এসেছে গণ-আন্দোলনে শহীদদের প্রতিচ্ছবি। শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর সঙ্গে সঙ্গে উঠে এসেছে সমাজ, রাষ্ট্র সংস্কার, ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ করা, ফ্যাসিবাদের অবসান, বাকস্বাধীনতা, প্রকৃতি, পরিবেশ, শব্দদূষণ, পরিবেশদূষণ, নদীদূষণ ও সব ধরনের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও প্রতিবাদের অগ্নিবর্ষণ।

গ্রাফিতিতে বাদ যাননি সেই রিকশাচালক, যিনি ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে সমর্থন দিয়ে তাঁর নিজ রিকশার সিটে দাঁড়িয়ে স্যালুট জানিয়েছিলেন হাত উঁচিয়ে। তাঁর ছবি রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন দেয়ালে এঁকেছে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা এঁকেছে সেই সব রিকশাচালক ভাইয়ের ছবি, যাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আহত ছাত্র-জনতাকে পৌঁছে দিয়েছেন হাসপাতালে। এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভাষা। এ ক্ষেত্রে বেশির ভাগ স্থানে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল, সুকান্ত ভট্টাচার্য ও হেলাল হাফিজের শরণাপন্ন হয়েছে শিক্ষার্থীরা। দেয়ালে দেয়ালে লিখেছে, ‘ভেঙে ফেল কারার ঐ লোহ কপাট……এখন যৌবন যার……’। লিখেছে, আমার দেশের ভাগ্য আমরা পরিবর্তন করবো। আমাদের দেশ আমাদেরই গড়ে নিতে হবে। স্বাধীনতা এনেছি যখন, সংস্কার করি। বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার আদিবাসী সুরক্ষার দায়িত্ব সবার।

দেয়ালে গ্রাফিতির এমন স্লোগানই বলে দেয় কেমন বাংলাদেশ প্রত্যাশা করে এই প্রজন্ম। একটা সমন্বয়ের সমাজের চিত্রই যেন উঠে এসেছে দেয়ালচিত্রে। দেয়ালগুলো যেন নতুন দিনের ইশতেহার হয়ে উঠেছে, যে ইশতেহারে বলা হয়েছে—বৈষম্য থাকবে না, ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ থাকবে না, কথা বলা যাবে নির্ভয়ে। তেমন বাংলাদেশের জন্যই তো লড়ে গেছেন আবু সাঈদ, ফাইয়াজ, মুগ্ধরা। এর মধ্য দিয়ে আমাদের শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতার পরিচয়ও পাওয়া গেছে। পাওয়া গেছে, চিন্তা-চেতনার গভীর উপলব্ধি। সেই সঙ্গে পাওয়া গেছে, নতুন বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। কালের কন্ঠ,লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions