ডেস্ক রির্পোট:- ‘আমার একটা নদী ছিল’র মতো হৃদয়স্পর্শী আরেকটি গান হতে পারে, ‘চকরিয়ায় একটা সুন্দরবন ছিল’। এই বনের আয়তন ছিল সাড়ে ৪৫ হাজার একর; আসল সুন্দরবনের প্রায় ৭ ভাগের ১ ভাগ। এই বনেও ছিল কেওড়া, বাইন, সুন্দরীর মতো শ্বাসমূলীয় গাছপালা। বনে ঘুরে বেড়াত হরিণ, বানর, বাঘ। নদী-খালের নোনাজলে ছিল মাছ, কাঁকড়া, কুমির। এই চকরিয়া সুন্দরবনও দেশের একটি বিশাল জনপদকে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে বাঁচিয়ে দিত নিজের বুক পেতে। কিন্তু আজ আর কিছুই নেই।
কেন নেই, কীভাবে নেই, কারা ‘নেই’ করল সব—প্রশ্নগুলো মাথায় নিয়ে মাঠে নেমে জানা গেল, মানুষের হাতেই ধ্বংসের সূত্রপাত এ সুন্দরবনের। আর ধ্বংসের ষোলোকলা পূর্ণ করে অন্য কেউ নয়, দেশের মানুষ ও সম্পদ দেখভালের দায়িত্ব নেওয়া সরকারগুলো। নিজেদের সমর্থকগোষ্ঠী প্রভাবশালী লোকজনের কাছে ইজারা দিয়ে সেখানে চিংড়ি চাষের ব্যবস্থা করে উজাড় করা হয় আস্ত একটা সুন্দরবন। একটা দেশের সরকারের হাতে প্রকৃতি ধ্বংসের এমন ন্যক্কারজনক ঘটনার কথা আগে জানা গেলেও গত তিন মাসের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এখন সেখানে কী চলছে! দেখা গেছে, একসময় যে মাটিতে দৃঢ় শ্বাসমূল-ঠেসমূলের ওপর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ছিল ম্যানগ্রোভ গাছের গহিন বন; এখন সেখানে শুধুই নোনাপানির ঘের আর তার গভীরে ঘটে চলা অনিয়ম-দুর্নীতি এবং দখল-রাহাজানির এক কালো অধ্যায়।
উপকূলের এই দ্বিতীয় প্রহরীখ্যাত কক্সবাজারের চকরিয়া সুন্দরবনে প্রথম সরকারি কোপ পড়ে ১৯৭৮ সালে। দেশে চিংড়ি চাষ প্রসারের কথা বলে রামপুর মৌজায় প্যারাবনের (এই অঞ্চলের ম্যানগ্রোভ বন) বেশির ভাগ জমি ইজারা দেয় তখনকার বিএনপি সরকার। পরে ১৯৮৬ সালে এরশাদ সরকার আবার সেই ইজারা বাতিল করে নতুন করে দুই দফায় মোট ৭ হাজার একর বনভূমি ইজারা দেয়। ইজারাদারেরা নিজ নিজ অংশের বন উজাড় করে মাটি কেটে পাড় বেঁধে তৈরি করেন চিংড়িঘের। ২ থেকে ৫ ফুট গভীরতার সেসব ঘের এখনো আছে; কিন্তু যে উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল, তা প্রায় ভেস্তে গেছে। ঘের ব্যবস্থাপনার জন্য নীতিমালা করা হলেও তা রয়ে গেছে কাগজেই। ইজারাদারেরা কেউ চিংড়ি চাষ না করে নীতিমালা ভেঙে ঘেরগুলো অন্যদের কাছে সাবলিজ দিয়ে অর্থ আয় করছেন। ঘের ঘিরে গড়ে উঠেছে সন্ত্রাসী চক্র। সব আমলে ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে সন্ত্রাসীরা সেখানে ‘যা খুশি তাই’ করে চলেছে। সব অপকর্মের দোসর হয়ে ফায়দা লুটছেন মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। অনুসন্ধানকালে চকরিয়া চিংড়িঘেরের ১৫ জন ইজারাদার; সাবলিজ নেওয়া ৫০ জন চিংড়িচাষি; মৎস্য অধিদপ্তরের ১০ জন কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ঘেরসংশ্লিষ্ট অন্তত ১০ জনের সঙ্গে কথা হয়েছে ।
নীতিমালার পাত্তা নেই
চকরিয়া বন বিভাগের তথ্য অনুসারে, স্বাধীনতার পর চকরিয়া সুন্দরবনের আয়তন ছিল ২১ হাজার একর। এর মধ্যে সংরক্ষিত বনভূমি ছিল ১৮ হাজার ৫০০ আর রক্ষিত বনভূমি (মালিকানায় জেলা প্রশাসন, ব্যবস্থাপনায় বন বিভাগ) ছিল ২ হাজার ৫০০ একর। পরে মৎস্য অধিদপ্তরসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরকে হস্তান্তর করা হয় প্রায় সাড়ে ১২ হাজার একর। সেই হিসাবে কাগজে অবশিষ্ট বনভূমি থাকার কথা সাড়ে ৮ হাজার একর। তবে চকরিয়া সুন্দরবনের রেঞ্জ কর্মকর্তা মেহারাজ উদ্দিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বাস্তবে এখানে আর কোনো বনভূমি নেই। সব জবরদখল ও উজাড় হয়ে গেছে।’
মূলত মৎস্য অধিদপ্তরের কাছে হস্তান্তর করা বনভূমিতেই চিংড়ি চাষের পরিকল্পনা করা হয়। ১৯৭৮ সালে চকরিয়ার রামপুর মৌজায় চিংড়ি এস্টেটের কার্যক্রম শুরু হয়। ঘেরের ইজারা ও ব্যবস্থাপনা চলে দুটি আলাদা প্রকল্প ও অফিস আদেশের মাধ্যমে। পরে ঘের পরিচালনায় প্রথম নীতিমালা করা হয় ২০১১ সালে। ২০১৩ সালে সেটি সংস্কার করা হয়। নীতিমালায় বলা আছে, প্রকৃত চিংড়িচাষিরাই শুধু ইজারা পাবেন। অন্য কারও কাছে বর্গা, সাবলিজ বা বন্ধক দেওয়া যাবে না।
কিন্তু ইজারাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের তালিকা যাচাই করে দেখা গেছে, অধিকাংশই চিংড়ি চাষের সঙ্গে জড়িত নন এবং তাঁরা ক্ষমতাধর রাজনীতিক ও আমলা বা তাঁদের আশীর্বাদপুষ্ট লোকজন। তাঁদের বড় অংশের ঠিকানা কক্সবাজারের বাইরে ঢাকাসহ অন্যান্য অঞ্চলে। নীতিমালায় সাবলিজ দিলে ইজারা বাতিলের কথা স্পষ্টভাবে বলা থাকলেও গত ৩৯ বছরে কাউকে নোটিশ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। অথচ অনুসন্ধানকালে একজন মূল ইজারাদারকেও ঘেরে চিংড়ি চাষ করতে দেখা যায়নি। তবে এ রকম দু-চারজন আছেন বলে শোনা গেছে। হাতে গোনা এই কজন বাদে আর সবাই নিজ নিজ ঘের সাবলিজ দিয়েছেন। আর এসব ঘটছে মৎস্য অধিদপ্তরের নাকের ডগায়। অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে চিংড়িচাষিদের হাতেকলমে প্রশিক্ষণ প্রদান, উন্নত পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা থাকলেও সরেজমিনে এ ধরনের কোনো কার্যক্রম চোখে পড়েনি।
ইজারা পেয়েছেন কারা
নথি ঘেঁটে দেখা যায়, ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান সরকারের নির্দেশে ৩৯ জন প্রভাবশালী ব্যক্তিকে চিংড়ি চাষের জন্য চকরিয়া সুন্দরবনের প্রায় পাঁচ হাজার একর বনভূমি ইজারা দেয় মৎস্য অধিদপ্তর। তখন ১৭ জনকে ১৫০ ও ২২ জনকে ১০০ একর করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। পরের বছর একই উদ্দেশ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) আর্থিক সহযোগিতায় আরও ২ হাজার একর প্যারাবন ১১ একর করে ১১৯টি প্লটে ভাগের পর ১১৯ ব্যক্তিকে ইজারা দেওয়া হয়।
পরে ১৯৮৬ সালে এরশাদ সরকারের আমলে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (আইডিএ) প্রকল্পের আওতায় ৫ হাজার একরে আগের ৩৯ জনের ইজারা বাতিল করা হয় এবং ১০ একর করে ৪৬৭ প্লটে ভাগের পর ইজারা দেওয়া হয়। এর মধ্যে ৩২৫ ব্যক্তি ও ৪২টি প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন পায় ৪৫১টি প্লট। মামলা ও বিরোধের কারণে ১৬টি প্লটের ইজারা বাতিল অবস্থায় আছে। মৎস্য অধিদপ্তরের ৪৮ একরের প্রদর্শনী প্লটসহ ১০ একরের ঘের এলাকায় মোট ৪৬৮টি প্লট রয়েছে। প্রথম মেয়াদে ১০ বছর, দ্বিতীয় মেয়াদে ১৫ বছর আর তৃতীয় মেয়াদে ২০ বছরের জন্য ইজারা দেওয়া হয়। ইজারায় প্রতি একরের জন্য বার্ষিক রাজস্ব ধরা হয় ২ হাজার টাকা। পাঁচ বছর পরপর ২ শতাংশ হারে রাজস্ব বৃদ্ধির কথাও বলা আছে নীতিমালায়।
তালিকা ঘেঁটে দেখা যায়, ১০ একরের ৪৮ নম্বর প্লট ইজারা পেয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির ধর্মবিষয়ক সম্পাদক ও কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি সিরাজুল মোস্তফা। ১০৯ নম্বর প্লট ইজারা পেয়েছেন কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য ও বরইতলী ইউপি চেয়ারম্যান এ টি এম জিয়াউদ্দিন চৌধুরীর স্ত্রী ইয়াছমিন চৌধুরী জলি। ২২০ নম্বর প্লট পেয়েছেন কক্সবাজার জেলা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি প্রয়াত জালাল আহমেদ চৌধুরীর ছেলে এম রেজাউল করিম চৌধুরী। ৩৩৬ নম্বর প্লট কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সালাহ উদ্দিন আহমদ; ৩৩৩-৩৩৫ তিনটি প্লট ডুলাজাহারা ইউপির দুবারের চেয়ারম্যান ও চকরিয়া উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মো. মিজানুর রহমান চৌধুরী (খোকন মিয়া) ; ৩৩৯-৩৪১ তিনটি প্লট চিরিংগা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান এম সালাহ উদ্দিন; ৩২৭-৩২৯ প্লট তিনটি বিএনপির মাতামুহুরীর সাংগঠনিক উপজেলা সভাপতি জামিল ইব্রাহিম চৌধুরী।
১১ একরের ৩৪ নম্বর প্লট ইজারা পেয়েছেন সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক সংসদ সদস্য খোরশেদ আরা হক। ৪৩ নম্বর প্লট চকরিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান জাহানারা পারভীন; ৬২ নম্বর প্লট মহেশখালী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোছাইন ইব্রাহীম; ১১৮ নম্বর প্লট ইজারা পেয়েছেন চকরিয়া-পেকুয়া আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জাতীয় পার্টির (জেপি-মঞ্জু) প্রেসিডিয়াম সদস্য এ এইচ সালাউদ্দিন মাহমুদ।
জানা গেছে, এফবিসিসিআইয়ের তালিকাভুক্ত ‘বাংলাদেশ ১০-১১ একর চিংড়ি প্রজেক্ট মালিক অ্যাসোসিয়েশন’ নামে চকরিয়া চিংড়িঘেরের ইজারাদারদের একটি সংগঠন রয়েছে। সংগঠনটির সভাপতির দায়িত্বে আছেন রাবেয়া আজিজ। তিনি ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি প্রয়াত এম এ আজিজের স্ত্রী। ইজারা পাওয়া প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ মৎস্য ও পশুসম্পদ ফাউন্ডেশন। ১০ একর চিংড়ি এস্টেটের ৪৩৮-৪৬৭ নম্বরের ৩০টি প্লটে মোট ৩০০ একর ইজারা পেয়েছে এই ফাউন্ডেশন।
চুক্তি করে সাবলিজ
দফায় দফায় চকরিয়ায় গিয়ে যে ৫০ জন চিংড়িচাষির সঙ্গে কথা হয়, তাঁরা কেউ ইজারাদার নন। বছরে ঘেরপ্রতি দুই থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত চুক্তিতে সাবলিজ নিয়ে তাঁরা চিংড়ি চাষ করছেন। সাবলিজের ১৫টি চুক্তিপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। ১০০ ও ৫০ টাকার স্ট্যাম্পে বেশির ভাগ চুক্তিপত্রে লেখার ধরন একই। ১০ একর চিংড়িঘেরের ১০০ নম্বর প্লটের ইজারাদার বাঁশখালীর বাসিন্দা জাফর আহমদ। চকরিয়ার করাইয়াঘোনার বাসিন্দা জসিম উদ্দিনকে লিখিত চুক্তির মাধ্যমে প্লটটি তিনি সাবলিজ দেওয়া হয়েছে। এর জন্য বছরে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা দেওয়ার চুক্তি হয়। দুই বছরের অগ্রিম টাকাও নেন জাফর। জানতে চাইলে জাফর আহমদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘টাকার প্রয়োজন হওয়ায় কয়েক বছরের জন্য সাবলিজ দিয়েছি।’
২১৭ ও ২১৮ নম্বর প্লটে ১০ বছর ধরে চিংড়ি চাষ করেন চকরিয়ার ছোঁয়াফাড়ি এলাকার বাসিন্দা আব্দুল মালেক (৪২)। তিনি জানান, প্লট দুটি মূলত তাঁর মামা হেলাল সওদাগর ২০০৯ সালে সাবলিজ নিয়েছেন। ২০১৪ সালে মামার কাছ থেকে তিনি প্লট দুটি বর্গা নেন।
২১৭ নম্বর প্লটের ইজারাদার দেওয়ান জহির আহমেদ ও ২১৮ নম্বর প্লটের ইজারাদার কুতুবদিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এ টি এম নুরুল বশর চৌধুরী। দেওয়ান জহির আহমেদের বাড়ি হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে হলেও তিনি চকরিয়ার চিরিংগা ইউনিয়নের ঠিকানা দিয়েছেন। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগে চকরিয়ায় তিনি লবণের ব্যবসা করতেন। ১০ একর ঘেরের ৩ নম্বর প্লটের ইজারা পেয়েছেন ঢাকার শ্যামপুরের বাসিন্দা ও সোনালী ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বেগম রাশেদা আউয়াল। ১৯৮৬ সালে সরকারি ব্যাংকে চাকরি করা অবস্থায় তিনি চিংড়ির প্লট ইজারা পান। তাঁর ঘেরে চিংড়ি ও লবণ চাষ করেন বদরখালীর বাসিন্দা গিয়াসউদ্দিন। তিনি জানান, ছোঁয়াফাড়ির হাবিবুর রহমান থেকে বছরে ৪ লাখ ৬৫ হাজার টাকায় ঘের সাবলিজ নিয়েছেন। রাশেদা আউয়ালের সঙ্গে তাঁর কোনো যোগাযোগ নেই। সাবলিজ দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে রাশেদা আউয়াল বলেন, ‘এ রকম অনেকে করে।’ তাঁর প্লটে কে চিংড়ি চাষ করে প্রশ্ন করলে তিনি নাম বলতে পারেননি। চকরিয়া চিংড়িঘেরে ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন দায়িত্বে ছিলেন মৎস্য কর্মকর্তা খন্দকার হাবিবুর রহমান। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘সব ভুয়া লোকজনকে ইজারা দেওয়া হয়েছে। কেউ রাজনৈতিক প্রভাবে, কেউ টাকাপয়সা দিয়ে ইজারা পেয়েছেন।’
ঘের দখলের পালা
চকরিয়া চিংড়িঘেরে দিনের চিত্র এক রকম, রাতের চিত্র অন্য রকম। ঘের দখল আর মাছ লুট নিয়মিত ঘটনা। একটি সশস্ত্র ডাকাত বাহিনীও গড়ে উঠেছে এখানে। তাদের সব সময় নিয়ন্ত্রণ করে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতারা। তাই সরকার বদলের পর দখলের চিত্রও পাল্টে যায়। রেহাই পায়নি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতিষ্ঠানের চিংড়িঘেরও। জানা গেছে, ২০২১ সালের ৫ জুলাই রাতে গ্রামীণের ঘের দখল করে নেয় আওয়ামী লীগের এমপি জাফর আলমের বাহিনী। ওই ঘটনায় মারধরের শিকার হওয়া ফাউন্ডেশনের কর্মী কবির আহমেদ (৫২) আজকের পত্রিকাকে বলেন, সন্ত্রাসীরা তিনতলা ভবনের অনেক ক্ষয়ক্ষতি করেছে। ঘরভর্তি মালপত্র ছিল, সব নিয়ে গেছে। তবে ৫ আগস্ট সরকার বদলের পর দখলমুক্ত হয় গ্রামীণের ঘেরগুলো।
১০ একরের ২৪২ নম্বর প্লটের ইজারাদার নারায়ণগঞ্জের দেওভোগের বাসিন্দা নাছরিন আক্তার জানান, করোনার পর থেকে জাফর আলমের সাঙ্গপাঙ্গরা তাঁর প্লট দখল করে রেখেছে। সেখানে তারা ঘরও তুলেছে। ২৩৬ নম্বর প্লট সাবলিজ নিয়ে চিংড়ি চাষ করেন শাহানবিল ইউনিয়নের কোরালখালীর বাসিন্দা নুরুল আলম। তিনি বলেন, প্রতি জোতে ডাকাতদের প্লটপ্রতি এক হাজার টাকা দিতে হয়। মাসে দুবার টাকা না দিলে ওরা মাছ লুট করে নিয়ে যায়।
সম্প্রতি জাহাঙ্গীর নামের এক ডাকাত সরদার গ্রেপ্তার হয়েছে। চকরিয়া থানা-পুলিশের তালিকাভুক্ত ডাকাতের মধ্যে আরও আছেন আব্দুস সালাম, নেজাম উদ্দিন, মো. ইব্রাহিম, আব্দুল জলিল, রুহুল আমিন, আব্দুল কাদের, রায়হান মিয়া, আব্দুর সবুর, পুতু মেম্বার ও সোহেল। গত ১৫ বছর এই ডাকাতদের পৃষ্ঠপোষকতা করার অভিযোগ রয়েছে সাবেক সংসদ সদস্য জাফর আলমের বিরুদ্ধে। সরকার বদলের পর আত্মগোপনে থাকায় তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
৫ আগস্টের পর চকরিয়ার চিংড়িঘের নিয়ন্ত্রণে বিএনপির কয়েকজন নেতা জড়িয়ে পড়েছেন বলে জানা গেছে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান চৌধুরী (খোকন মিয়া), বিএনপির মাতামুহুরী সাংগঠনিক উপজেলার সভাপতি জামিল ইব্রাহিম চৌধুরী, উপজেলা বিএনপির সদ্য সাবেক সদস্যসচিব ফখরুউদ্দিন ফরাজী, নজরুল ইসলাম (ব্যাঙ নজরুল), আলী আহমেদ। জানতে চাইলে ফখরুউদ্দিন ফরাজী আজকের পত্রিকাকে বলেন, বিগত সরকারের সময় সাধারণ মানুষের চিংড়ির প্লট বেদখল ছিল। এখন তা পুনরুদ্ধার করা হয়েছে।
স্লুইসগেটে সিন্ডিকেট
চকরিয়ার চিংড়ি এস্টেটে বয়ে যাওয়া নদী-খালে ২৭টি স্লুইসগেট রয়েছে। জোয়ার-ভাটার সময় এসব গেট দিয়ে চিংড়িঘেরে নোনা পানি যাওয়া-আসা করে। ২০-২৫টি ঘেরের জন্য একটি করে গেট। নীতিমালায় বলা আছে, ঘেরগুলোর ইজাদারেরা কমিটি করে স্লুইসগেটের ব্যবস্থাপনা ঠিক করবেন। কিন্তু ইজারাদারেরা চিংড়ি চাষ না করে ঘেরগুলো সাবলিজ দিয়ে রেখেছেন; তাই সেখানে কোনো বৈধ কমিটি তৈরি হয়নি। এই সুযোগে গেটগুলো কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এক শক্তিশালী সিন্ডিকেট। তারা বিভিন্ন অজুহাতে স্থানীয়দেরকে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে গার্ড পদে আবেদন করিয়ে মৎস্য অধিদপ্তর থেকে নিয়োগ আদায় করে। পরে তাদের মাধ্যমেই স্লুইসগেটগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চাঁদাবাজি, মাছ লুটের মতো অবৈধ কর্মকাণ্ডে মেতে ওঠে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এই গার্ড নিয়োগে মোটা অঙ্কের ঘুষ লেনদেন হয়। সংগ্রহ করা এ রকম পাঁচটি কাগজে দেখা যায়, যেখানে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে গার্ড নিয়োগের কথা লেখা আছে। কাগজগুলোতে স্বাক্ষর রয়েছে কক্সবাজার চিংড়ি চাষ সম্প্রসারণের আঞ্চলিক মৎস্য কর্মকর্তা তৌফিকুল ইসলামের। কাগজগুলো মৎস্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দেখালে তাঁরা জানান, এভাবে গার্ড নিয়োগের কোনো আইনি ভিত্তি নেই।
অনুসন্ধান বলছে, গার্ড নিয়োগের নামে আসলে অতি গুরুত্বপূর্ণ স্লুইসগেটগুলোকে একধরনের ইজারা দিয়ে রেখেছেন মৎস্য কর্মকর্তারা। একেকটি স্লুইসগেটের ‘ইজারা মূল্য’ বছরে দুই থেকে ছয় লাখ টাকা পর্যন্ত। যাঁরা ইজারা নেন, তাঁরা গেটে নিষিদ্ধ বিন্দিজাল বসিয়ে মাছ ধরেন। বদরখালী এলাকার এক বাসিন্দা জানান, তিনি চার লাখ টাকা দিয়ে এক বছরের জন্য স্লুইসগেট ইজারা পেয়েছেন। আরেক ‘ইজারাদার’ বজল কবির বলেন, আঞ্চলিক মৎস্য কর্মকর্তা তৌফিককে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা দিয়ে স্লুইসগেট নিলেও তিনি এখনো দখলে যেতে পারেননি। এই মৎস্য কর্মকর্তা তৌফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে ইজারা বাতিল হওয়া কিছু প্লটে মৌখিক ইজারা দিয়ে টাকা কামাইয়ের অভিযোগও আছে।
আটজন চিংড়িচাষি গত ১৫ সেপ্টেম্বর তৌফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন। তবে মৎস্য অধিদপ্তর এখনো তদন্ত শুরু করেনি। জানতে চাইলে অভিযোগকারীদের একজন রায়হান কাইছার রিগান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘তৌফিক সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যোগসাজশে কৌশলে টাকা আদায় করেন।’ এই অভিযুক্ত কর্মকর্তা তৌফিক তিন বছরের বেশি সময় একই পদে রয়েছেন।
অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করলে আঞ্চলিক মৎস্য কর্মকর্তা তৌফিকুল ইসলাম বলেন, ‘অস্থায়ী গার্ড নিয়োগের আবেদনপত্রে প্রথমে কয়েকটিতে স্বাক্ষর করেছি। পরে অনেকে আমার স্বাক্ষর নকল করে নিয়োগের কাগজ বানিয়ে নিয়েছে।’ আপনার স্বাক্ষরিত গার্ড নিয়োগের কাগজগুলো; ঘের মৌখিক ইজারা দিয়ে টাকা নেওয়া এবং চিংড়িচাষিদের কাছ থেকে মাছ আদায়ের মেসেজ আদান-প্রদানের স্ক্রিনশট আমাদের কাছে আছে জানালে তিনি ফোন কেটে দেন।
পরে হোয়াটসঅ্যাপে কল করে বলেন, ‘যদি কোনো কিছু করা লাগে, কক্সবাজার আইসেন, আমি চেষ্টা করব। বদির রিসোর্ট আছে। আপনার ভালোই লাগবে।’
মৎস্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক (চিংড়ি) মো. আয়নাল হক বলেন, ‘দুর্নীতির কিছু তথ্য-প্রমাণ পাওয়ার পর তৌফিককে এমন কাজ করা থেকে বিরত থাকতে বলেছি।’ পদাধিকারবলে চিংড়িঘেরের স্লুইসগেটসহ অবকাঠামো ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি চকরিয়ার ইউএনও। কিন্তু কমিটিতে দায়িত্বে থাকার বিষয়ে কিছুই জানেন না দাবি করেছেন সদ্য সাবেক ইউএনও মো. ফখরুল ইসলাম।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ইজারাদারেরা শর্ত ভঙ্গ করে সাবলিজ দেওয়ায় চিংড়িঘেরে সরকারের উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয়নি। ইজারা পুনর্মূল্যায়ন করে প্রকৃত চিংড়িচাষি রেখে বাকিদের ইজারা বাতিল করা উচিত। যারা বিশ্বাসভঙ্গ করে সাবলিজ দিয়েছে, শাস্তির পাশাপাশি তাদের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা উচিত। অনিয়মের সঙ্গে সরকারের যে কর্তাব্যক্তিরা জড়িত, তাঁদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে।’
সার্বিক বিষয় অবগত করে জানতে চাইলে অন্তর্বর্তী সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার ‘খোঁজ নেবেন’ বলে জানান।
[ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) দুর্নীতিবিষয়ক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ফেলোশিপ-২০২৪ এর আওতায় প্রতিবেদনটি করা হয়েছে। ]আজকের পত্রিকার।