ডেস্ক রির্পোট:- নির্বাচন ও সংস্কার প্রশ্নে জাতীয় ঐক্য প্রয়োজন বলে মত প্রকাশ করেছেন রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, ছাত্র প্রতিনিধি ও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবারের সদস্যরা। তারা বলেছেন, ছাত্র-জনতার ত্যাগের বিনিময়ে সংস্কারের সুযোগ এসেছে। একইসঙ্গে সংস্কারকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হলে নির্বাচিত সরকার প্রয়োজন। এজন্য সংস্কার এবং নির্বাচন দু’টিকে সমান গুরুত্ব দিয়ে এগুতে হবে। স্থায়ী সংস্কারের জন্য জাতীয় ঐকমত্য সুদৃঢ় করতে হবে। ‘জাতীয় ঐক্য’ সৃষ্টির লক্ষ্যে গতকাল রাজধানীর ফার্মগেইটে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ (এফবিএস) আয়োজিত ‘ঐক্য, সংস্কার ও নির্বাচন’ শীর্ষক দুই দিনব্যাপী সংলাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান এবং প্রথম ও দ্বিতীয় অধিবেশনে বক্তারা এসব কথা বলেন। সংলাপে প্রধান অতিথি ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অনুষ্ঠানে তার ভিডিও বক্তব্য প্রচার করা হয়। সংলাপে ধারণাপত্র পাঠ করেন সাংবাদিক মনির হায়দার। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা করেন লেখক ও সাংবাদিক ফারুক ওয়াসিফ, প্রথম অধিবেশনে সঞ্চালনা করেন ডা. জাহেদ উর রহমান এবং দ্বিতীয় অধিবেশনের সঞ্চালনা করেন সাইয়েদ আব্দুল্লাহ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, সংস্কার বিষয়ে আমাদের মধ্যে ঐকমত্য প্রয়োজন। ঐক্যবিহীন সংস্কার কিংবা সংস্কারবিহীন নির্বাচন বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে পারবে না। সংস্কার ও নির্বাচনের প্রস্তুতি একইসঙ্গে চলতে থাকবে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, নির্বাচনের প্রস্তুতির কাজ মূলত নির্বাচন কমিশনের। নাগরিকদের নির্বাচনের তারিখ না পাওয়া পর্যন্ত এই প্রক্রিয়ায় সময় দিতে হয় না। কিন্তু সংস্কারের কাজে সকল নাগরিককে অংশগ্রহণ করতে হবে। যারা ভোটার, তারা তো অংশগ্রহণ করবেনই, তার সঙ্গে যারা ভবিষ্যতে ভোটার হবেন, তারাও সর্বাত্মকভাবে সংস্কারের কাজে নিজেদের নিয়োজিত করুন। তিনি বলেন, প্রত্যেক সংস্কার কমিশনের দায়িত্ব হলো প্রধান বিকল্পগুলো চিহ্নিত করে তার মধ্য থেকে একটি বিকল্পকে জাতির জন্য সুপারিশ করা। যার যার ক্ষেত্রে সংস্কারের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ কীভাবে রচিত হবে, তা বিভিন্ন পক্ষের মতামত নিয়ে সুপারিশমালা তৈরি করে দেয়া, নাগরিকদের পক্ষে মতামত স্থির করা সহজ করে দেয়া। প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, কমিশনের প্রতিবেদনে সুপারিশ করলেই আমাকে-আপনাকে তা মেনে নিতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। এজন্য সর্বশেষ পর্যায়ে জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন গঠন করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমি মনে করি, ভোটার হওয়ার বয়স ১৭ বছর নির্ধারিত হওয়া উচিত। নির্বাচন সংস্কার কমিশন কী সুপারিশ করবেন, তা আমার জানা নেই। কিন্তু দেশের বেশির ভাগ মানুষ যদি কমিশনের সুপারিশ করা বয়স পছন্দ করে, ঐকমত্যে পৌঁছার জন্য আমি তা মেনে নেবো। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছি যে যার যাই মতামত হোক না কেন আমরা দ্রুত একটা ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত করে সংস্কারের কাজগুলো করে ফেলতে চাই। নির্বাচনের পথে যেন এগিয়ে যেতে পারি, সেই ব্যবস্থা করতে চাই। জুলাই গণঅভ্যুত্থান হত্যাকাণ্ডের বিচারের বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের ছাত্র-জনতা অটুট সাহসে শিশু হত্যাকারী ও পৈশাচিক ঘাতকদের মোকাবিলা করেছে। মানবতার বিরুদ্ধে এমন নিষ্ঠুরতাকে অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্নকে সাহসী করে তুলেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাকহীন বাংলাদেশ জোরালো কণ্ঠে আবার কথা বলার শক্তি ফিরে পেয়েছে। এই দৃঢ়কণ্ঠ আবার ঐক্য গঠনে সোচ্চার হয়েছে। ঐক্যই মূলশক্তি মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জুলাই অভ্যুত্থান আমাদের ঐতিহাসিক মাত্রায় বলীয়ান করেছে। গত পাঁচ মাসে এই ঐক্য আরও শক্তিশালী হয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের বিরুদ্ধ শক্তি আমাদের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি করার ক্রমাগত প্রয়াস চালাতে থাকায় আমাদের ঐক্য আরও মজবুত হচ্ছে। রাষ্ট্রের কাছে এবং অন্য নাগরিকের কাছে আমার অন্য কোনো পরিচয় দেয়ার প্রয়োজন হবে না। যেখানে ব্যক্তি বন্দনার কোনো সুযোগ থাকবে না। দেশের ভেতরে বা বাইরে প্রভু-ভৃত্যের কোনো সম্পর্কের সুযোগ থাকবে না। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পর জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে দেশ গড়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এই সুযোগ যদি আমরা গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক হই, কিংবা অপারগ হই, তাহলে বাংলাদেশে ভবিষ্যতের কোনো প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না। আজকের সংলাপের মূল লক্ষ্য হলো সবার পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ কণ্ঠে ঘোষণা দেয়া যে, আমরা এই সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া হতে দেবো না। আমরা একতাবদ্ধভাবে এই সুযোগের প্রতিটি মুহূর্ত সর্বোত্তম কাজে লাগাবো।
বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিএনপি প্রথম থেকেই সংস্কারের পক্ষে। দুর্ভাগ্য আমাদের, এখন কিছু কিছু বক্তব্য আসছে যে বিএনপি সংস্কার চায় না, নির্বাচন চায়। এ কথাটা সঠিক নয়। আমরা একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার জন্য ন্যূনতম যে সংস্কার প্রয়োজন, সেই সংস্কারটুকু করে আমরা নির্বাচনে যেতে চাই। চাপিয়ে দিয়ে কোনো কিছু করার সম্ভাবনা নেই মন্তব্য করে তিনি বলেন, যেমন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়েছে। অর্থাৎ এই ব্যবস্থা মানুষ গ্রহণ করেছিল এবং জরুরি মনে করেছে। কিন্তু আমরা যদি তখন রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারে চলে যেতাম, সেটা জনগণ গ্রহণ করতো না বলে আমার কাছে মনে হয়। আমার ধারণা, জনগণকে বাদ দিয়ে কোনো কিছু করা সম্ভব হবে না। মির্জা ফখরুল বলেন, ড. আলী রীয়াজ বলেছেন, তাদের কাছে এক লাখের ওপর বিভিন্ন ধরনের প্রস্তাব এসেছে। খুব ভালো কথা। আমি শুনেছি তারা তাদের প্রস্তাব তৈরি করে সরকারের কাছে দেবেন এবং সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসবে। তারাই (কমিশন) যদি আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসতেন, আমার মনে হয়, সেটা আরও কার্যকরী হতো। এখন সরকার বসবে, আলোচনা হবে, আরও সময় লাগবে। যত বেশি সময় যাবে, সমস্যাগুলো তত বাড়বে। আসল সমস্যা তো অন্য জায়গায়। আপনি এগুলো বাস্তবায়ন করবেন কাদের দিয়ে? তিনি বলেন, খুব জরুরি কথা, আমরা যেন একাত্তরকে ভুলে না যাই। একাত্তর সালকে আমরা কখনো ভুলে না যাই। একাত্তরের পর থেকে গণতন্ত্রের জন্য ধারাবাহিক যে লড়াই-সংগ্রাম, সেই সংগ্রামের প্রত্যেককে আমাদের মনে রাখা দরকার। সেই লড়াইয়ের মধ্যদিয়ে, ছাত্রদের আত্মত্যাগের মধ্যদিয়ে আজকে আমরা এই জায়গায় এসে পৌঁছেছি। মির্জা ফখরুল বলেন, সেই প্রশাসন, সরকারের মেশিনারি তো পুরোপুরিভাবে এখনো ফ্যাসিবাদের মধ্যে আছে। এতটুকুও পরিবর্তন হয়নি। কাঠামোটা যদি না থাকে, শুধু উপর থেকে চাপিয়ে দিলেই আমরা দ্রুত কোনো কিছু করতে পারবো না। তাই আমাদের কাঠামোটা ঠিক করতে হবে, প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঠিক করতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলোকে গণতন্ত্রের উপযোগী করে গড়ে তুলতে পারলেই আমরা গণতন্ত্রকে সফল করতে পারব।
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, সংস্কার, সংলাপ, জাতীয় ঐকমত্যের প্রশ্নে আমি বলবো, সরকারের পক্ষ থেকে যে রিফর্ম কমিশনগুলো গঠন করা হয়েছে, সেই কমিশনের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পরামর্শ চাওয়া হয়েছিল। সহজ পথ হলো, আমরা পরামর্শ দিয়েছি, সব দল দিচ্ছে-আমি কমিশনের প্রধানদের অনুরোধ করবো, প্রধান উপদেষ্টার কাছে ম্যাসেজ দিতে চাই, এগুলো ডিসেম্বরের মধ্যে হয়তো এসে যাবে। আসার পর এগুলোকে সর্টআউট করে রাজনৈতিক দল ও স্টেকহোল্ডারদের কাছে থেকে আসা সমস্ত সংস্কার প্রস্তাব জাতীয় ঐক্যের দৃষ্টিতে যেগুলো কমন সেগুলো নিয়ে আরেকটি পাবলিক ডায়ালগের ব্যবস্থা আপনারা করুন। সেখানে একটা জাতীয় ঐকমত্য তৈরি হতে পারে। তিনি বলেন, আর সংস্কার বিশাল ব্যাপার। রাষ্ট্রের সমস্ত অর্গানগুলো পলিটিসাইজ হয়েছে এবং করাপ্ট হয়েছে-এটা একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে সবকিছু সংস্কার করা সম্ভব নয়। ইট উইল টেক টাইম। কিন্তু একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যে সংস্কারগুলো মিনিমাম প্রয়োজন সেগুলো সম্পন্ন করতে সুযোগ দিতে হবে। তারপরেই একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব। সেই নির্বাচনে যুক্তিসঙ্গত সময়ের জন্য যতটুকু লাগে আমরা জামায়াতে ইসলামী সেই সময় দিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দিতে প্রস্তুত আছি।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ঐক্যের পথ বন্ধুর, সবার মতামত নিয়ে ঐক্যে যেতে হবে এবং সংস্কারের প্রশ্নে জাতীয় ঐক্যে পৌঁছাতে হবে। ঐক্যে পৌঁছাতে যদি আমাদের কিছুটা ছাড়ও দিতে হয় সেটি দিতে হবে। বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে তারুণ্যই বড় ভূমিকা রাখবে মন্তব্য করে রিজওয়ানা হাসান বলেন, এবার যদি আমরা সংস্কারের প্রশ্নে পিছপা হই, তাহলে রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা আবার পিছিয়ে যাবে। তিনি বলেন, আমরা বিপ্লবের মাধ্যমে এসেছি। কাজেই বিপ্লবের মাধ্যমে আসা একটি সরকার তার ম্যান্ডেট নিয়ে মোটেও চিন্তিত না। সে জানে তার ম্যান্ডেটটা কি। কিন্তু এই ম্যান্ডেটে সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন হবে। যাতে করে জনমতের প্রতিফলন আমরা দেখতে পারি।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, দেশের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে আক্রমণের বিষয়ে একটা জাতীয় ঐক্য দেখা গেছে। এখন বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা কী হবে, সেই ঐক্য দরকার। গত ১৫-১৬ বছরে ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল। রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও জনগণকে ঐক্যের মাধ্যমে সংস্কারের পথে নিয়ে যাবে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন আনতে হবে। কারণ, আপনি যত ভালো সংবিধান তৈরি করেন না কেন, রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তন না হলে সেই সংবিধান আবারো ভাঙা হবে। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের পাশাপাশি রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনে জোর দিতে হবে।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আমরা এমন একটি সংস্কার চাই যেন ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতি আর না আসে। এ ছাড়া যাতে মানুষ কথা বলার অধিকার অর্জন করে। ৫ই আগস্টের আগে শেখ হাসিনার সরকারের পতন না হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, তখন বুলেটের সামনে বুক পেতে দাঁড়ানোর মতো কেউ ছিল না, যেটা আবু সাঈদ করেছে। এই তরুণদের ত্যাগ আমাদের ঋণী করে দিয়েছে, আমাদের দায়িত্ব তাদের ঋণ পূরণ করা। এজন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। তিনি বলেন, মনোনয়ন বাণিজ্য হলে রাজনীতিটা ব্যবসায় রূপান্তরিত হয়। যদি মনোনয়ন বাণিজ্য বন্ধ করা না যায়, তাহলে আমাদের সমস্ত শ্রম বৃথা হয়ে যাবে।
দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সংস্কার খুব বড় স্বপ্ন, তার জন্য ঐক্য দরকার, নির্বাচনেও যেতে হবে। কিন্তু তার আগে মানুষকে স্বস্তি দিতে হবে। তিনি বলেন, সংস্কারমুখী মানুষকে আইনশৃঙ্খলা না দিয়ে, তার খাওয়ার ব্যবস্থা না করে, চাকরির নিশ্চয়তা না দিয়ে বিপথে নিয়ে যাবেন না। সর্বোত্তম পেতে গিয়ে আমরা যেন উত্তমকে হারিয়ে না ফেলি। আমরা সর্বোচ্চ পর্যায়ে যেতে চাই, কিন্তু এই মুহূর্তের সমস্যাগুলোতে মনোযোগ না দিলে ওই জায়গাটায় পৌঁছানো যাবে না। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মনে করেন, কাঠামোগত প্রশাসনিক সংস্কারের বিষয়ে অনেক আলোচনা হলেও এর মধ্যে ঘাটতি লাগার বিষয় আছে। আর তা হলো, উপরিকাঠামো নিয়ে যতখানি আলোচনা হচ্ছে, এই দেশ-সমাজের ভিত্তি নিয়ে তত আলোচনা হয় না। বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ বলেন, এই আলোচনা শোনা যায় না যে, গার্মেন্টস শ্রমিকের বেতন কতো হবে, সে ন্যায্য মজুরি কীভাবে পাবে, কৃষক ফসলের দাম পাবে কিনা, এই মুহূর্তে মধ্যবিত্ত ৮০ টাকায় শাকের আঁটি কেমন করে খাবে? একবারও তো আলোচনা হলো না যুবসমাজের কর্মসংস্থান কেমন করে হবে? সেই সংস্কার কি আমরা দেখেছি। কীসের উপরিকাঠামো সংস্কার করবেন, যদি আমার ভিত ঠিক না থাকে। আসল ক্ষমতায়ন তো রুটি-রুজির ক্ষমতায়ন। আমার খুব কষ্ট লাগে, এই বিষয়গুলো আমাদের নেতারা দেখছেন না। সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা নিয়ে আলোচনা চললেও বাদবাকি মানুষ কোথা থেকে মহার্ঘ ভাতা পাবে সেই আলোচনা শোনা যায় না। শিক্ষিত যুবসমাজের জন্য কোনো ভাতার প্রচলন হবে কিনা, সেটাও শোনা যায় না।
অর্থনীতিবিদ ড. মুশতাক হুসাইন খান বলেন, সংস্কারের মাধ্যমে শুধু আইনকানুন পরিবর্তন করলে হবে না। বাংলাদেশে একটি গোপন ক্ষমতা কাঠামো গড়ে উঠেছে। এ গোপন ক্ষমতার বিন্যাস ভাঙতে হবে। কারণ, আইন করা সহজ। কিন্তু ক্ষমতার কাঠামো ভাঙা না হলে ওই আইন আবারো ভাঙা হবে। কাজটা এখনই করতে হবে। তা রাজনৈতিক দলগুলোকে সঙ্গে নিয়েই করতে হবে। তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশ্যে বলেন, ক্ষমতার গোপন কাঠামো ভাঙতে না পারলে আপনারা ভালো কিছু চাইলেও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। কারণ, আপনার দলেরই এমপি, নেতারা তা ঠেকিয়ে দেবে। মুশতাক হুসাইন খুনিদের বিচারের পাশাপাশি বড় বড় চোরের বিচার করার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, সবাইকে একসঙ্গে পারা যাবে না। একজন, দুজনকে ধরতে হবে। মানুষ তখন দেখতে পারবে যে, চুরি করে পার পাওয়া যাচ্ছে না।
জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার অন্যতম নজিরগুলো আমরা ইদানীং দেখতে পারছি। আপনারা দেখেছেন সচিবালয়ে আগুন লাগানো হয়েছে। সচিবালয় ফ্যাসিবাদ উৎপাদনের কারখানায় পরিণত হয়েছে।
ধারণাপত্র পাঠ করে সাংবাদিক মনির হায়দার বলেন, ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও মতাদর্শের পার্থক্যের কারণে অনৈক্যের সুর দেখা যাচ্ছে। এত অল্প সময়ের মধ্যে অনৈক্য জাতিকে উদ্বিগ্ন করে। এ জন্য জাতীয় ঐক্যের লক্ষ্যে, বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যের জন্য এ আয়োজন করা হয়েছে। অন্যথায় কাঙ্ক্ষিত সংস্কার ও নির্বাচন অর্জন করা যাবে না।
সংলাপের শুরুতে কথা বলেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানে গুলিবিদ্ধ ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী আবু বকর সিদ্দিক, নিহত ইমাম হোসেনের ভাই রবিউল আওয়াল, উত্তরা চব্বিশের সংগঠক মনিশা মাফরুহা, নিহত শাহরিয়ার হাসান আলভীর বাবা আবুল হাসান। আবু বকর বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চার মাসের মধ্যেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল রাষ্ট্র সংস্কার ও নির্বাচনকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। জাতি হিসেবে এটা আমাদের জন্য ব্যর্থতা এবং গণঅভ্যুত্থানে আহত-নিহতদের জন্য এটা অপমানজনক। গণ- আন্দোলনে আহত ও নিহতদের পরিবারের সঠিক পুনর্বাসন ও খুনিদের বিচার নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। গণঅভ্যুত্থানে হতাহতের ঘটনায় আদৌ বিচার হবে কিনা, সেই প্রশ্ন তোলেন যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের গুলিতে নিহত ইমাম হোসেনের ভাই রবিউল আওয়াল। তিনি বলেন, একটি হত্যাকাণ্ডে একজন করে পুলিশ জড়িত থাকলে এক হাজার পুলিশ গ্রেপ্তার হওয়ার কথা, দুইজন করে জড়িত থাকলে দুই হাজার পুলিশ গ্রেপ্তার হতো। কিন্তু গ্রেপ্তার হয়েছে মাত্র ২৩ জন পুলিশ। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছাত্রলীগের কতোজন গ্রেপ্তার হয়েছে? তাহলে আমরা কীভাবে বিশ্বাস করবো যে বিচার হবে? খুনিদের গ্রেপ্তার করতে না পারলে বিচারের নামে এমন রঙ্গমঞ্চ কেন? আপনারা সংস্কারের কথা বলেন, কিন্তু বিচারের কথা জোর দিয়ে বলেন না। রবিউল অভিযোগ করে বলেন, যাত্রাবাড়ীতে গণহত্যায় ডিএমপি কমিশনারের ভাগ্নে জড়িত। তাকে গ্রেপ্তারের জন্য তার লোকেশনের তথ্য পুলিশের কাছে দিলেও পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেনি। নিহত পরিবার ও আহতদের সহায়তার বিষয়টি দ্রুত করার দাবি জানান উত্তরায় আন্দোলনের অন্যতম সংগঠন মনিশা মাফরুহা। ছেলের মৃত্যুর কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন শাহরিয়ার হাসান আলভির বাবা আবুল হাসান। তিনি বলেন, ছেলের জানাজা এলাকায় দিতে দেয়া হয়নি। দুটো মসজিদে মরদেহের গোসল করাতে দেয়া হয়নি। জনগণ এত রক্ত নির্বাচনের জন্য দেয়নি। আপনারা এই দেশটা সংস্কার করুন। নিহতদের পরিবার ও আহতদের নিরাপত্তা দেয়ার কথাও বলেন আবুল হাসান।
মানবাধিকার কর্মী ড. জাহেদ-উর রহমানের সঞ্চালনায় প্রথম অধিবেশনে আরও বক্তব্য রাখেন অন্তর্বর্তী সরকারের শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, গণফোরামের সদস্য এডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, জেএসডি’র সহ-সভাপতি তানিয়া রব, গণঅধিকার পরিষদের আহ্বায়ক নুরুল হক নুর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মামুন আহমেদ, সাবেক সচিব এএফএম সোলায়মান চৌধুরী ও রাষ্ট্রদূত মুশফিকুল ফজল আনসারীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ। অন্যদিকে সাইয়েদ আব্দুল্লাহর সঞ্চালনায় দ্বিতীয় অধিবেশনে বক্তব্য রাখেন ড. আ ন ম এহসানুল হক মিলন, মজিবুর রহমান মঞ্জু, ড. রোকসানা খন্দকার, এডভোকেট রুহুল কুদ্দুস কাজল, হাসনাত আব্দুল্লাহ, এডভোকেট দিলরুবা শারমিন, লে. কর্নেল (অব.) দিদারুল আলম, ড. নেয়ামুল বশির, ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম, আশফাক নিপুণ, নাফিন মুরশিদ, ইলিরা দেওয়ান, মেঘমল্লার বসু, মঞ্জুরুল ইসলাম, রাশেদ আহমেদ, তানজিল মাহমুদ এবং নাছির উদ্দীন নাছির।