ডেস্ক রির্পোট:- প্রশাসনে আমলাতন্ত্র রাজনীতিবিদ ও মাঠ প্রশাসনের মধ্যে একটি যোগসূত্রের দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করে আসছে। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা মাঠ প্রশাসনে সামগ্রিক কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণী জায়গা থেকে সচিবালয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে সরকারের উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পদের সবই প্রশাসন ক্যাডার থেকে পদায়ন করার বিধান রয়েছে। পলিসি তৈরির ক্ষেত্রে মাঠের বাস্তবতা, অর্জিত জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টি দেশের জনগণের প্রতিনিধি রাজনীতিবিদদের কাছে জায়গা করে নিয়েছে। যারা দেশের নেতৃত্ব দিয়ে আসছে প্রশাসন ক্যাডারা। গত ২০১৮ সালে অর্থনৈতিক (ইকোনমিক) ক্যাডার বিলুপ্ত করে প্রশাসন ক্যাডারে একীভূত করার ফলে প্রশাসন ক্যাডারে কয়েক বছর ধরে অসন্তোষ চলে আসছিলো। এর মধ্যে উপসচিব পদে পরীক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন ও প্রশাসন ক্যাডার থেকে ৭৫ শতাংশের বদলে ৫০ শতাংশ কর্মকর্তা নিয়োগের সুপারিশের ঘোষণার পরপরই তীব্রবাদ ও প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করছে প্রশাসন ক্যাডারের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন এবং সারা দেশের ৬৪ জেলার ডিসিরা। সরকারের সিভিল প্রশাসনে ক্ষোভ বাড়ছে। এ ছাড়া স্থানীয় সরকার বিভাগসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে সচিব পদ শূন্য রয়েছে। তারপর নিয়োগ দিতে পারেনি সরকার। ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারসহ অন্যান্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের মাঝে। একারণে প্রশাসন যন্ত্র সামাল দিতে হিমসিম খাচ্ছে সরকার। অর্থনৈতিক (ইকোনমিক) ক্যাডাররা এসব সুযোগ-সুবিধা প্রশাসন ক্যাডারের দখল নিতেই মূলত ইকোনমিক ক্যাডারকে একীভূত করা হয়েছে। অর্থনৈতিক (ইকোনমিক) ক্যাডার কর্মকর্তাদের মূল দায়িত্ব ছিলো প্রকল্প তৈরি, তদারকি ও বাস্তবায়নের মান নিয়ে কাজ করা সেটা না করে প্রশাসন ক্যাডারে যুক্ত হওয়ার কারণে তাদের দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে অনেক জেলায় উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নে ডিসিদের অনীহা দেখা দিযেছে। আবার অনেক জেলায় নতুন ডিসিদের মধ্যে অনেকেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে।
এ বিষয়ে ঢাকা জেলার জেলা প্রশাসক তানভীর আহমেদ বলেন, জনমুখী,জবাবদিহিমূলক,দক্ষ ও নিরপেক্ষ প্রশাসন বিনির্মাণে জনপ্রশাসনের সকল স্তরে বিদ্যমান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করেছি। তা সমাধানের জন্য জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সাথে মতবিনিময়ের জন্য সময় চেয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। গত ১৬ বছরে প্রশাসনে যা হয়েছে তা আমিও চাই না। আমরা প্রশাসন ক্যাডারকে নতুন হিসেবে দেখতে চাই। দেশের জনগণের জন্য কাজ করতে চাই। সব ক্ষেত্রে বৈষম্য নিরসন হওয়া প্রয়োজন।
ফ্যাসিবাদ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত ১৫ বছরে জনপ্রশাসনে বঞ্চিত দাবি করে যেসব কর্মকর্তা আবেদন করেছিলেন, তাদের মধ্য থেকে ৭৬৪ জনকে পদোন্নতি দেওয়ার সুপারিশ করেছে এ-সংক্রান্ত কমিটি। উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে এসব কর্মকর্তাকে পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত ও মারা যাওয়ায় এসব সরকারি কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। পূর্বের বা অতীতের কোনো তারিখ থেকে কোনো বিষয় কার্যকর করা হলে তাকে ‘ভূতাপেক্ষ’ বলা হয়ে থাকে। জনপ্রশাসনে পদোন্নতি বঞ্চিত অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের আবেদন পর্যালোচনা কমিটি সম্প্রতি তাদের প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দিয়েছে। কিন্তু কয়েকজন সচিব পদে নিয়োগ ছাড়া বঞ্চিতদের পদোন্নতি দেয়া হয়নি। প্রশাসনের গতি বাড়াতে নতুন পরিকল্পনা নিলেও মাঠ থেকে শুরু করে প্রশাসনে ঘাপটি মেরে থাকার ফ্যাসিবাদী সরকারের দোসরদের এখনো প্রত্যাহার করতে পারেনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। জেলা প্রশাসক পদে কর্মকর্তা পদায়নের জন্য ফিটলিস্ট প্রণয়ন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পদে কর্মকর্তা পদায়নের জন্য ফিটলিস্ট প্রণয়ন, উপজেলা নির্বাহী অফিসার পদে কর্মকর্তা পদায়নের জন্য ফিটলিস্ট করার আগে যাদের তথ্য নেয়া হচ্ছে বর্তমানে সবাই বিএনপি ও জামায়াতের লোক বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদন দেয়া হচ্ছে। এছাড়া যুগ্ম সচিব পদে ২৪ ব্যাচকে পদোন্নতি দেয়ার কার্যক্রম শুরু করেছে ইতোমধ্যে এসএসবি সভায় হয়েছে। আরো কয়েকটি এসএসবি সভা অনুষ্ঠিত হবে। প্রশাসনে থাকার ফ্যাসিবাদী সরকারের দোসররা থাকার কারণে নানা ষড়যন্ত্র থামছে না। এছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে ঘাপটি মেরে আছে তাদের এখনোর বদলী বা প্রত্যহার করা হয়নি বলে জানা গেছে।
অ্যাসোসিয়েশন একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে এবং ৬৪ জন জেলা প্রশাসক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বরাবর কার্যবিবরণী প্রেরণের মাধ্যমে প্রতিবাদ পাঠায়। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য ৫০ শতাংশ ও অন্য ক্যাডারের জন্য ৫০ শতাংশ বরাদ্দে সুপারিশ নিয়ে বিবৃতি দিয়ে ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানিয়েছে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন। তাঁরা উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত সব পদে প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদায়ন চান। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের বিষয়ে সংগঠনের জেলা শাখা সভাও করেছে। পদাধিকারবলে জেলা প্রশাসকেরা ওই সংগঠনের জেলা শাখার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
জেলা প্রশাসকেরা সচিব ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে কার্যবিবরণী পাঠিয়ে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরছেন। সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়, উচ্চ আদালতের একটি মীমাংসিত বিষয়ে কমিশন প্রধানের আকস্মিক বক্তব্য সম্পূর্ণ অনাকাক্সিক্ষত। তারা বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারকে আলাদা করে আগের মতো শতভাগ উপসচিব বা তার ওপরের পদ অন্তর্ভুক্ত করে ‘বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস’ প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছেন। বর্তমানে উপসচিব পদে পদোন্নতিতে প্রশাসন ক্যাডার থেকে ৭৫ শতাংশ ও অন্য ক্যাডার থেকে ২৫ শতাংশ নেওয়া হয়। এই ২৫ শতাংশের ক্ষেত্রে অন্যান্য ক্যাডার থেকে আবেদন আহ্বান করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সুপিরিয়র সিলেকশন কমিটির (এসএসবি) মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে উপসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। প্রশাসনে সিনিয়র সচিব/ সচিব এবং গ্রেড-৯৩টি, অতিরি সচিব পদে ২১২ টি, যুগ্মসচিব পদে ৫০২টি, উপসচিব পদে ১ হাজার ৭৫০টি, সুপারমানিও ৪৩০টি এবং সিনিয়র সহকারী ও সহকারী সচিব পদে ১ হাজার ৩৪৪টি। সরকারের উপসচিব ও তার ওপরের পদে কোটাপদ্ধতি বাতিল করে উন্মুক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগসহ বেশ কিছু দাবি করে আসছে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ। সংস্কার কমিশন এখন উপসচিব পদে পদন্নোতির কোটা প্রশাসন ক্যাডারের জন্য অর্ধেক, বাকিদের জন্য অর্ধেক করতে চাচ্ছে। অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আনোয়ার উল্ল্যাহ ও মহাসচিব মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান এক বিবৃতিতে বলা হয়,কমিশনের প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দেওয়ার আগেই আকস্মিকভাবে এ ধরনের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কেন প্রকাশ্য নিয়ে আসা হলো সেই প্রশ্ন তুলেছেন। কোনো মহলের ইন্ধনে অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমকে অস্থিতিশীল করার অপপ্রয়াস কি না, তা খতিয়ে দেখার দাবি তাদের। আমলাতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ এসব পদে সব সময় প্রশাসনের কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, পতিত আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৮ সালে জারি করা এক নীতিমালায় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বঞ্চিত করে ২৫ শতাংশ উপসচিব পদে অন্যান্য ক্যাডার সার্ভিসকে আনুপাতিকভাবে কোটা প্রদান করে।
প্রশাসনের কর্মকর্তারা রাষ্ট্রের ক্ষমতার একজন হেফাজতকারী মাত্র। জনগণকে স্বস্তি দেওয়ার জন্য এটিকে ব্যবহার করা। এখন মানুষ আগের মতো নেই। কোথাও কোনো কিছু হলে সঙ্গে সঙ্গে তারা ঘিরে ফেলে। এটা আগে ছিল না। মানুষ যাতে আইন হাতে তুলে না নেয়, সেটা আমাদের বোঝাতে হবে। প্রশাসনে সংশোধনের মাধ্যমে রাষ্ট্র সংস্কার না হলে পরে আবারও ভয়াবহ বিপ্লব হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী। তিনি বলেন, এবারের বিপ্লবে তো তেমন কিছু হয়নি। পরে আবার বিপ্লব হলে সেটা হবে ভয়াবহ। গত এক দশকে চাকরির বাজারে বড় রকমের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। চাকরি প্রার্থীদের প্রথম এবং অকাট্য পছন্দই হচ্ছে সরকারি চাকরি। বিশেষ করে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার প্রবণতা মারাত্মক আকারে বেড়েছে। তবে মজার বিষয় হলো, বিসিএস ক্যাডার হওয়াই এখন শুধু মুখ্য বিষয় নয়, বরং পছন্দের ক্যাডার প্রাপ্তির আশায় তারা ক্যাডার পদে যোগ দিয়েও শেষ বিসিএস পর্যন্ত চেষ্টা করে যান পছন্দের ক্যাডার প্রাপ্তির আশায়। যেকোনও বিষয়েই পড়াশোনা করুন না কেন ব্যতিক্রম ছাড়া নির্দিষ্ট কিছু পছন্দের ক্যাডার চয়েজ প্রায় সবারই এক। একজন চিকিৎসক, একজন প্রকৌশলী বা একজন সাহিত্য ব্যাকগ্রাউন্ড শিক্ষার্থীর পছন্দও কেন ইদানীং এক রকম হয়ে উঠলো সেটি এখন মূল প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন ক্যাডারের সংখ্যা ২৬। এরমধ্যে ১০টি ক্যাডার পুরোপুরি সাধারণ। অর্থাৎ যেকোনও বিষয়ের শিক্ষার্থীই এই ক্যাডারগুলোতে আসতে পারে। পাঁচটি ক্যাডার সাধারণ ও কারিগরি/পেশাগত। ১১টি ক্যাডারে পুরোপুরি কারিগরি/পেশাগত। অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীরাই কেবল এই ক্যাডারে যেতে পারেন। যেমন- চিকিৎসা, প্রকৌশল বা কৃষি বিষয়ের ওপর যারা পড়াশোনা করেন।
পিএসসি বিসিএস পরীক্ষার আবেদনের সময় আগ্রহের ক্যাডার জানতে চায়। সাধারণত পরীক্ষার ফলে এগিয়ে থাকা চাকরিপ্রার্থীরা প্রশাসন, পররাষ্ট্র ও পুলিশ ক্যাডারে আগ্রহ বেশি দেখান। বিশেষায়িত বিষয়ে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীরা সংশ্লিষ্ট ক্যাডারে যান। সাম্প্রতিককালে দেখা যাচ্ছে, চিকিৎসা, প্রকৌশলবিদ্যার মতো বিশেষায়িত বিষয়ে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ প্রশাসন, পুলিশ ও পররাষ্ট্র ক্যাডারে চলে যাচ্ছেন। এ তো গেলো ক্যাডার পরিবর্তন বা বিষয় সংশ্লিষ্ট ব্যাকগ্রাউন্ড পরিবর্তনের কথা। কিন্তু ইদানীং এসব ‘পছন্দের ক্যাডার’ বিশেষ করে প্রশাসন ক্যাডারে যেতে নতুন প্রবণতা তৈরি হয়েছে। নিজেদের সংশ্লিষ্ট ক্যাডারটিই বিলুপ্ত করে একীভূত হতে চান প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে। সম্প্রতি বাণিজ্য, তথ্য, সমবায় ও পরিসংখ্যান এই চারটি ক্যাডারের কর্মকর্তারা নিজেদের ক্যাডার বিলুপ্ত করে প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে মিশে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, সংশ্লিষ্ট ক্যাডারগুলোতে সহজে পদোন্নতি পাওয়া যায় না। বিনা সুদের ঋণে গাড়ি কেনার সুযোগ নেই। বিদেশ ভ্রমণের সুবিধাও কম। ওদিকে এসব সুবিধা রয়েছে প্রশাসন ক্যাডারে, সঙ্গে রয়েছে সামাজিক মর্যাদা ও ক্ষমতার প্রভাব। ইতোমধ্যে বাণিজ্য ক্যাডার বিলুপ্তির প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে। এতে অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারাও একই পথে হাঁটার চিন্তাভাবনা শুরু করেছেন।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে পুরো প্রশাসনযন্ত্র। সরকারে উপসচিব ও যুগ্ম সচিব হতে পরীক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি উপসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রশাসন ও অন্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের অনুপাত ৫০ঃ৫০ শতাংশ করা হচ্ছে। এ ছাড়া শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারকে নিয়ে পৃথক সংস্থা গঠনের প্রস্তাব করবে কমিশন। কমিশনের এমন প্রস্তাবে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন (বিএএসএ)। একইভাবে কমিশনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে চিকিৎসকদের সংগঠন বিসিএস হেলথ ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন এবং শিক্ষকদের বিসিএস জেনারেল এডুকেশন ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন। এ ছাড়া সারা দেশের ৬৪ জন জেলা প্রশাসক (ডিসি) এমন প্রস্তাবের বিরোধিতা করে সভার কার্যবিবরণী পাঠিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। তারা কেউই মানছেন না অন্তর্র্বর্তী সরকার গঠিত জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব। এই ক্যাডার সংগঠনগুলো নিজ নিজ সংগঠনের নেতাদের নিয়ে বৈঠক করে সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। প্রতিবাদ বিজ্ঞপ্তি আকারে গণমাধ্যমকেও জানানো হয়। বিএএসএ বলছে, সরকারের সব পদে শতভাগ প্রশাসন ক্যাডার থেকে পদায়ন করা উচিত। অন্যদিকে প্রশাসন ছাড়া অন্য ২৫ ক্যাডার এই ইস্যুতে বলছে, মেধার ভিত্তিতে সরকারের পদে নিয়োগ হবে। সেখানে কোনো কোটা থাকবে না। আবার শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারকে নিয়ে পৃথক সংস্থা গঠনের প্রস্তাবে দেশে স্বাস্থ্য খাতে নেতিবাচক পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে দায় নেবে না হেলথ ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন। আর শিক্ষা খাতে অস্থিরতা তৈরি করতেই এমন প্রস্তাব করা হয়েছে বলে অভিযোগ এডুকেশন ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের। গত মঙ্গলবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়সভায় সংস্কার কমিশন প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী বলেন, পরীক্ষা ছাড়া সিভিল সার্ভিসের উপসচিব ও যুগ্ম সচিব পর্যায়ে কেউ পদোন্নতি পাবেন না। পাবলিক সার্ভিস কমিশন পরীক্ষা নেবে। ৭০ নম্বর না পেলে পদোন্নতি পাবেন না।
পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশি নম্বর পাওয়া কর্মকর্তাই উপসচিবের তালিকায় ১ নম্বর হবেন। উপসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য ৫০ শতাংশ এবং অন্য ক্যাডার থেকে ৫০ শতাংশ সুপারিশ করা হবে। বর্তমানে প্রশাসন ক্যাডার থেকে ৭৫ শতাংশ এবং অন্য ক্যাডার থেকে ২৫ শতাংশ নেওয়া হয়। এর মাধ্যমে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর হবে। এ ছাড়া বলা হয়, সংস্কার কমিশন মনে করে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারের বর্তমান কাঠামো বজায় রাখার প্রয়োজন নেই। বরং এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর পরিচালনার জন্য পৃথক সংস্থা গঠনের প্রস্তাব করবে কমিশন। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের এমন প্রস্তাবের পরই রাতে রাজধানীর বিয়ামে জরুরি বৈঠকে বসে প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠন বিএএসএ। দীর্ঘ বৈঠকের পর তারা গণমাধ্যমে লিখিত বিবৃতি পাঠায়। বিএএসএ সভাপতি ড. মো. আনোয়ার উল্লাহ এবং মহাসচিব মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমানের সই করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দেশের সর্বোচ্চ আদালতে মীমাংসিত একটি বিষয় নিয়ে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের আনুষ্ঠানিক লিখিত প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দেওয়ার আগেই আকস্মিকভাবে এ ধরনের ঘোষণা অনভিপ্রেত, আপত্তিকর ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে দুর্বল করার শামিল। উপমহাদেশে সিভিল সার্ভিসের ইতিহাসে সব সময়ই প্রশাসন ক্যাডার/সার্ভিসের লোকেরাই উপসচিব/যুগ্ম সচিব/অতিরিক্ত সচিব/সচিব পদে কাজ করে আসছেন।
রাষ্ট্রে প্রশাসন ক্যাডারের কার্যপরিধির সঙ্গে পলিসিমেকিংয়ের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। সরকারের নির্বাহী বিভাগের অন্যতম প্রতিনিধি হিসেবে মাঠে সহকারী কমিশনার/সহকারী কমিশনার (ভূমি)/উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা-অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক- জেলা প্রশাসক-বিভাগীয় কমিশনার হিসেবে সরকারের কোনো সুনির্দিষ্ট পলিসি নয়, বরং সব পলিসি বাস্তবায়ন ও সমন্বয়ের মূল কাজটি প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারাই করে থাকেন। সচিবালয়ে আমলাতন্ত্র রাজনীতিবিদ ও মাঠ প্রশাসনের মধ্যে একটি যোগসূত্রের মতো কাজ করে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে কেন ৭৫ শতাংশ কোটা প্রশাসন ক্যাডারের জন্য সংরক্ষণের দরকার, সেই যুক্তিগুলোও তারা তুলে ধরেন। প্রায় অভিন্ন ভাষায় জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছেন ঢাকাসহ দেশের ৬৪ জেলার ডিসিরা। তারা এ বিষয়ে নিজ নিজ জেলায় বৈঠক করে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাবের বিরোধিতা করে কার্যবিরণী তৈরি করেন। এতে তীব্র বিরোধিতা করে বলা হয়, এই প্রস্তাব গৃহীত হলে এটি প্রশাসন ক্যাডারের প্রতি বৈষম্যমূলক হবে।ইনকিলাব