ডেস্ক রির্পোট:- শেখ হাসিনা পচে গেছেন অতিকথনে। ‘শেখ হাসিনা পালায় না’ দম্ভোক্তি করেই তিনি পালিয়ে গেছেন দাদাদের দেশে। ভারতের সহায়তায় তিনি বাংলাদেশে ‘স¤্রাজ্ঞী’ হয়ে উঠেছিলেন। দিল্লির ইন্ধন আর তার কথায় আইন, বিচার, প্রশাসনযন্ত্র সব কিছু চলেছে। ১৮ কোটি মানুষের মাথার ওপর জগদ্ধলপাথর হয়ে চেপে বসেছিলেন ফ্যাসিস্ট হাসিনা। কবি শামসুর রাহমানের ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ কবিতার মতোই ‘দ্বিতীয় রাজনৈতিক মৃত্যুর আগে হাসিনা ‘ভারত মাতার গান’ গেয়ে পালিয়ে গেছেন দিল্লি। সেখানে বসে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছেন। জনগণের প্রত্যাশায় ৮ আগস্ট গঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। গোটা জাতি প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ।
এ দেশের মানুষ নির্বাচনকে উৎসব মনে করে। অথচ প্রায় দুই যুগ ধরে নির্বাচনের নামে তামাশা হচ্ছে। মূলত ২০০১ সালের নির্বাচনের পর থেকে মানুষ ভোট দেয়ার জন্য মুখিয়ে রয়েছেন। নির্বাচন হবে, জনগণ ভোট দিয়ে প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন। প্রধান উপদেষ্টা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূস একাধিকবার জানিয়েছেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে চাইবে সেভাবেই সংস্কার ও নির্বাচন হবে, আমরা চলে যাব।’ গত চার মাসে ফ্যাসিস্ট হাসিনা কয়েকবার অন্তর্বর্তী সরকারকে উৎখাতে প্রতিবিপ্লব ঘটাতে ষড়যন্ত্রের তীর ছুড়েছে বাংলাদেশে। ১৮ কোটি মানুষ সব ষড়যন্ত্র ভ-ুল করে দিয়েছে। হাসিনা ও ভারতের ষড়যন্ত্র যখনই বুঝতে পেরেছেন তখনই ড. ইউনূস রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে সংলাপে ডেকেছেন। আদর্শ-দর্শন, দল-মত নির্বিশেষে রাজনৈতিক দলগুলো ছুটে গেছে। সংলাপ করে ড. ইউনূসের হাতকে শক্তিশালী করতে যা কিছু করা প্রয়োজন তা করার অঙ্গীকার করেছে দলগুলো। তারপরও কোথায় যেন সন্দেহ-অনিশ্চয়তা। ‘যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ’ প্রবাদের মতো কয়েকজন উপদেষ্টার অতিকথনে মূলত এই পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। মানুষের মধ্যে প্রশ্ন কোন দিকে যাচ্ছে দেশ? সময়মতো নির্বাচন হবে তো? সংস্কারের নামে অন্তর্বর্তী সরকার কত বছর থাকবে? ধ্বংসপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগকে জাগিয়ে তুলে পুনর্বাসনের লক্ষ্যেই কি ‘সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন’ পদ্ধতি সংবিধানের সংযোজনের চেষ্টা চলছে? নাকি কিছু এনজিওর প্ররোচনায় কিংস পার্টি গঠনের লক্ষ্যে সংস্কারের নামে নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা হচ্ছে? সাধারণ মানুষের মনে এমন হাজারো প্রশ্নের উদ্ভব হচ্ছে। কারণ একটি এনজিও ইতোমধ্যে জরিপের নামে দেখিয়েছে, নতুন রাজনৈতিক দল গঠিত হলে ৪০ শতাংশ মানুষ তাদের ভোট দেবে এমন মতামত দিয়েছে। এনজিওর এই জরিপে কারণে কিছু মানুষ ‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু’ প্রবাদ কার্পেটের নিচে চাপা দিয়ে কবি জীবনানন্দ দাসের ‘আবার আসিব ফিরে’ মতো ফের ক্ষমতায় আসার লোভে দল গঠনের উদ্যোগী হন।
জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি প্রখ্যাত দার্শনিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বদরুদ্দীন উমর বলেছেন, দেশের মানুষ নির্বাচনমুখী। যতই চেষ্টা হোক আওয়ামী লীগ আর কোনো দিন দাঁড়াতে পারবে না। দলটির মৃত্যু হয়েছে। অথচ দলটিকে নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করে নতুন নাম পুরুজ্জীবিতের চেষ্টা হয়েছে। এ ধরনের চেষ্টা ছিল অদূরদর্শী চেতনাধারীদের। শেখ হাসিনা ভারতের ইন্ধনে শেখ মুজিবুর রহমানকে শেষ করে দিয়েছে। তবে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বিএনপি রাজনৈতিক পরিপক্বতার পরিচয় দিয়েছে। এ ছাড়াও ছাত্ররা যে প্রেসিডেন্ট মোঃ সাহাবুদ্দিনকে সরানোর আন্দোলন করেছে এবং বিএনপি তার বিরোধিতা করেছে সেটিতে বিএনপি রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে। এখন বিভেদ নয়, সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। কমিশন আগামী বছরের মার্চ মাসে পূর্ণাঙ্গ ভোটার তালিকা প্রকাশ করার ঘোষণা দিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টা জানিয়েছেন, ‘দেশে নির্বাচনী ট্রেন লাইনে উঠেছে। এ ট্রেন আর থাকবে না।’ তারপরও কিছু উপদেষ্টার কথায় নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে সন্দেহ। ঢাকা সফরে এসে ১১ ডিসেম্বর ব্রিটিশ গ্লোবাল পার্টনার্স গভর্ন্যান্সের (জিপিজি) প্রতিনিধিদল সচিবালয়ে যান। সেখানে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো চাচ্ছে তাদের অধীনে সংস্কার হোক। তাই তারা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ করার চেষ্টা করছে। তারা সংস্কারের পরিবর্তে নির্বাচনকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে।’ এ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এর আগে গত চার মাসে কয়েকবার বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারকে কোনোভাবেই ব্যর্থ হতে দেয়া যাবে না, অন্তর্বর্তী সরকারকে সফল করতেই হবে।’ অন্যান্য রাজনৈতিক দল অন্তর্বর্তী সরকারকে সফল করতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার ঘোষণা দেয়। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত চার মাসে তিন দফায় রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপ করেছেন। যখনই ডাক দিয়েছেন প্রতি বারই রাজনৈতিক দলের নেতারা প্রধান উপদেষ্টার সংলাপে অংশ নিতে ছুটে আসেন। হাসিনা ও ভারতের ষড়যন্ত্র ঠেকাতে ভারতীয় পণ্য বর্জনের ক্যাম্পেইন করছেন। বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের অপপ্রচার ঠেকাতে সাইবার যুদ্ধ করছেন। কিন্তু তারপরও রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে একজন উপদেষ্টার সন্দেহ কেন? গত বৃহস্পতিবার লন্ডন থেকে ফিরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অন্তর্বর্তী সরকারকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘ন্যূনতম সংস্কার করে নির্বাচন দিন। দেশের অস্থিরতা নিরসন একমাত্র নির্বাচিত সরকারই করতে পারে।’
তথ্য উপদেষ্টার বক্তবের সুর ধরে বক্তব্য দিয়েছেন পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি ১৩ ডিসেম্বর বলেছেন, ‘যদি রাজনীতিবিদরাই সংস্কার করেন, তাহলে গত ৫৩ বছর তারা কী করেছেন? রাজনীতিবিদরাই যদি সংস্কার করতে পারেন, তাহলে আমাদের দায়িত্ব নিতে হতো না। প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করবেন।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপদেষ্টাদের এমন বক্তব্যের নেপথ্যে ‘কিংস পার্টি’। ফখরুদ্দিন-মঈন ইউ আহমদ ২০০৭ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর যেমন ড. ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীকে নিয়ে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল (পিডিপি) নামের কিংস পার্টি গঠন করেছিলেন; অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর সরকারের উপদেষ্টা পদে থাকা ছাত্র সমন্বয়ক ও এনজিওকর্মীরা নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টা করছেন। এনজিওর জরিপ অনুযায়ী, দেশের মানুষ নতুন দলকে ভোট দেয়ার জন্য মুখিয়ে রয়েছেন। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই আশঙ্কা, ভারতের চাণক্যনীতির ফাঁদে এনজিওগুলো পড়ছে কিনা?
এর আগে সেপ্টেম্বর মাসে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষা ধারণ করে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে রাষ্ট্রের সংস্কার ও পুনর্গঠনের লক্ষ্য নিয়ে গঠিত হয়েছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। আট দফা দাবিতে নাসির উদ্দিন পাটোয়ারীকে আহ্বায়ক ও আখতার হোসেনকে সদস্য সচিব করে এ কমিটি আত্মপ্রকাশ করেছে। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আয়োজিত সংলাপে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের পাশাপাশি জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্যরা অংশ নেন। জাতীয় নাগরিক কমিটি গত ১২ ডিসেম্বর ঘোষণা দেয়, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেয়া হবে। সূত্রের দাবি, চলতি মাসের শেষ দিকেই নতুন দলের আত্মপ্রকাশ ঘটতে পারে। দেশের যেকোনো নাগরিকের রাজনীতি করা বা রাজনৈতিক দল গঠনের গণতান্ত্রিক অধিকার রয়েছে।
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পাল্টে গেছে দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট। কিন্তু সন্দেহের সৃষ্টি অন্য জায়গায়। অনেকেই বলছেন, কিংস পার্টি গঠন এবং আওয়ামী লীগকে ফিরিয়ে আনা এবং জামায়াতকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে সংস্কারের নামে নির্বাচনের সময় ক্ষেপণের চেষ্টা চলছে। কিন্তু একাধিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেছেন, নির্বাচন যতই বিলম্ব হবে ততই ভারতের ষড়যন্ত্র বাড়তে থাকবে। ফ্যাসিস্ট হাসিনা বিদেশে পাচার করা টাকা খরচ করে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করবেন। কিন্তু নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দল ক্ষমতা গ্রহণ করলে ভারতের চাণক্যনীতি মাঠে মারা যাবে। হাসিনার ষড়যন্ত্র ধুলোয় লুটোপুটি খাবে।
এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহিদ উর রহমান বলেছেন, বর্তমান অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে বিএনপির সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের দূরত্ব বাড়ছে। ড. ইউনূস বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কার চাইলে হবে; যদি মনে করে সংস্কারের প্রয়োজন নেই তখন নির্বাচন দিয়ে চলে যাব। অথচ উপদেষ্টাদের কেউ কেউ রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কার অন্তর্বর্তী সরকারকে সফল হতে দেবে না বলে বক্তব্য দিচ্ছেন। বিএনপি মহাসচিব তার তীব্র প্রতিবাদ করছেন। শুধু তাই নয়, কিংস পার্টি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় ‘যথাসময়ে নির্বাচন’ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি বিএনপির সন্দেহের সৃষ্টি হচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. সলিমুল্লাহ খান বলেন, নির্বাচনের কথা উঠলেই অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু উপদেষ্টা ক্ষেপে যান কেন? আওয়ামী লীগ আর দাঁড়াতে পারবে না। যদি দাঁড়ায় তাহলে আমাদের সব রাজনৈতিক পড়াশোনা বৃথা যাবে। আওয়ামী লীগ হবে মুসলিম লীগের মতোই। ছাত্র-জনতা ৫ আগস্ট যে সাফল্য দেখিয়েছে তা ধরে রাখতে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।ইনকিলাব