ডেস্ক রির্পোট:- কূটনৈতিক সম্পর্কের দৃশ্যমান অবনতি ও চলমান রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে অনুষ্ঠিত হলো ভারত ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক। উচ্চ পর্যায়ের এ বৈঠকে সাম্প্রতিক সময়ের নানা ইস্যু আলোচনায় আসে। বৈঠকে উভয় পক্ষ থেকেই তুলে ধরা হয়েছে দুদেশের স্বার্থ সম্পর্কিত নানা বিষয়। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে ভারতে অবস্থানরত শেখ হাসিনার সম্প্রতি দেওয়া নানা বক্তব্য, সীমান্ত হত্যা, আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলার ঘটনাসহ নানা বিষয় উপস্থাপন করা হয়। এসব বিষয়ে কড়া প্রতিবাদও জানিয়েছে ঢাকা। অন্যদিকে ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনসহ নানা বিষয় তুলে ধরা হয়। তবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক না গলাতে বলা হয়েছে ঢাকার পক্ষ থেকে।
গতকাল সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্র সচিবদের মধ্যে এফওসি অনুষ্ঠিত হয়। এতে ঢাকার হয়ে নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিন। অন্যদিকে, দিল্লির পক্ষে নেতৃত্বে ছিলেন সে দেশের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি। দুই সচিবের মধ্যে একান্ত আলাপসহ সাড়ে তিন ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলে এই বৈঠক। বৈঠক ঘিরে দুদেশের জনগণের নজরও ছিল ঢাকার কূটনৈতিকপাড়ার দিকে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সাম্প্রতিক ইস্যুর মধ্যে বাংলাদেশ-ভারত সচিব পর্যায়ের বৈঠককে দুদেশের মধ্যকার আইস ব্রেকিং (জমে যাওয়া বরফ গলা) হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এমন সময়ে দুদেশের সচিব পর্যায়ের বৈঠক হওয়াটাই একটা সফলতা। আশা করা যায়, এই বৈঠকের পর দুদেশেই তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে উভয় দেশ উত্তেজনা প্রশমনের চেষ্টা করবে।
প্রবল আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। নতুন সরকার আসার পর বাংলাদেশ ও ভারত—দুই দেশের মধ্যে এটিই ছিল উচ্চ পর্যায়ের প্রথম বৈঠক। এর আগে গত বছরের নভেম্বরে দিল্লিতে সর্বশেষ পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে বৈঠক হয়। প্রতিবছর ভারতের সঙ্গে ফরেন অফিস কনসালটেশন (এফওসি) হলেও এবারের বৈঠক ছিল খুবই গুরত্বপূর্ণ। কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এ বৈঠক এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যখন বেশ কিছু ইস্যু নিয়ে দুদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে বড় ধরনের ফাটল ধরেছে। আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে শেখ হাসিনা দিল্লিতে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকেই ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হতে শুরু করে। আর সম্মিলিত সনাতন জাগরণী মঞ্চের মুখপাত্র ও সাবেক ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তার যেন সেই আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে।
বৈঠক শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র সচিব জসিম উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ভারতে অবস্থান করে যে বক্তব্য দেন এই বক্তব্যের প্রতি আমরা তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। তার বক্তব্য সরকার পছন্দ করছে না। এটা যে সরকার পছন্দ করছে না, সেটা শেখ হাসিনাকে জানাতে অনুরোধ করা হয়েছে।
এদিকে, সংখ্যালঘু নির্যাতন ইস্যুটি বৈঠকে গুরুত্বসহকারে উত্থাপন করা হয় ভারতের পক্ষ থেকে। সে দেশের পররাষ্ট্র সচিব তার প্রেস ব্রিফিংয়েও বিষয়টি উল্লেখ করেন। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি এ বিষয়ে বলেন, ‘আমরা সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া ঘটনাবলি আলোচনা করেছি। সংখ্যালঘু ইস্যুতে আমি আমাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছি। সংখ্যালঘুর বিষয় নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ বলেছে, বিষয়টি দেখবে।’ বিক্রম মিশ্রি বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দুই দেশের মধ্যে কিছু দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো নিয়েও আমরা আলোচনা করেছি। ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং কূটনৈতিক বিষয়ে আক্রমণের বিষয়ে আমরা আলোচনা করেছি।’
এদিকে, সংখ্যালঘু নির্যাতন ইস্যুতে ঢাকার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এটা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারত যেন হস্তক্ষেপ না করে। পররাষ্ট্র সচিব জসিম উদ্দিন প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, আমরা তাদের বলেছি, এই ব্যাপারে যদি তাদের কোনো সংশয় থাকে, তাহলে যে কোনো দেশের মতো তারাও আমাদের দেশে এসে দেখতে পারে, সত্যিকারে সংখ্যালঘুদের প্রতি কী ধরনের আচরণ করা হচ্ছে। ভারতীয় গণমাধ্যমে এ বিষয়ে যেভাবে অতিরঞ্জিত খবর প্রকাশ করেছে, তাতে আমরা উদ্বেগ জানিয়েছি।
বৈঠকে ঢাকার পক্ষ থেকে সীমান্তে হত্যার বিষয়টি তুলে ধরা হয়। এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র সচিব জসিম উদ্দিন বলেন, ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে বৈঠকে সীমান্ত হত্যা নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা বলেছি, সীমান্তে হত্যাকাণ্ড কাম্য নয় এবং দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের সঙ্গে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড সংগতিপূর্ণ নয়। আমরা সবসময় বলেছি, সীমান্ত হত্যা যেন শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা হয়। তাদের দিক থেকে তারা বলেছে, সীমান্তে নানা ধরনের অপরাধ হয়। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে এসব অপরাধের সংযোগ আছে। আমরা বলেছি, আমরা কোনো অপরাধ সমর্থন করি না, একই সঙ্গে হত্যাকাণ্ডকেও সমর্থন করি না। কাজেই দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের যে কথা বলছি, তার সঙ্গে সংগতি রেখে আমাদের যে অঙ্গীকার এবং রাজনৈতিক যে অঙ্গীকার হত্যাকাণ্ড শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার, সেটার বিষয়ে তারা যেন শ্রদ্ধাশীল থাকে।
অতি সম্প্রতি উভয় দেশের জাতীয় পতাকার অবমাননা উত্তেজনার পারদ তুঙ্গে রয়েছে। যার রেশ ধরেই ২ ডিসেম্বর আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশন কার্যালয়ে হিন্দুত্ববাদী একটি সংগঠনের হামলা হয়, যাকে ‘পূর্বপরিকল্পিত’ হিসেবে বর্ণনা করে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বাংলাদেশ। বর্বরোচিত ওই হামলার পর থেকে বাংলাদেশজুড়ে তীব্র প্রতিবাদ ও ক্ষোভ-বিক্ষোভ চলছে। এরই মধ্যে হাইকমিশনে হামলার ঘটনায় ভারতীয় রাষ্ট্রদূত প্রণয় ভার্মাকে গত মঙ্গলবার ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে ভারতের কলকাতা ও আগরতলায় বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনের প্রধানরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় ফিরে এসেছেন। দুদেশই ভিসা সীমিত করেছে দুদেশের নাগরিকদের জন্য। গতকালের সচিব পর্যায়ে বৈঠকে এ বিষয়গুলোও আলোচনায় আসে।
এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র সচিব জসিম উদ্দিন জানান, ভারতে বাংলাদেশি দূতাবাসে হামলার ঘটনায় উদ্বেগ জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বোঝাপড়ায় কিছুটা ঘাটতি আছে। আশা করছি, আজ তারা আমাদের এখানে আসার পরে সেটি কমবে।
দুই দেশের উচ্চ পর্যায়ে এই বৈঠকের বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম সফিউল্লাহ কালবেলাকে বলেন, আমরা আশা করিনি ঢাকার সচিব পর্যায়ের বৈঠকে ভারত অংশ নেবে। তারা যে অংশগ্রহণ করেছে প্রথমত এটিই বড় সফলতা। গত চার মাসেও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি ভারত। হাসিনার পলায়নের পর তাদের গণমাধ্যমের কাজকর্ম, সংখ্যালঘু নিয়ে তাদের নানা বিবৃতি দেখে মনে হচ্ছিল, তারা আমাদের বিরুদ্ধে এক ধরনের পরোক্ষ যুদ্ধে নেমেছে।
দুই দেশের মধ্যে এমন উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে বৈঠকটি অত্যন্ত যুগোপযোগী ছিল বলে মত সফিউল্লার। তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে সমস্যা কূটনৈতিক উপায় ছাড়া এই মুহূর্তে সমাধান কষ্টসাধ্য। এমন পরিস্থিতিতে দুদেশের নানা বিবৃতির মাধ্যমে তিক্ততা বাড়িয়ে লাভ নেই। স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে ধৈর্য নিয়ে আলোচনা করাই উত্তম।
সাবেক এই রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, আমি আশা করি এই ডায়ালগের পর ভারতের গণমাধ্যম অপপ্রচার বন্ধ করবে। সরকারিভাবেও ভারত অনেক বিবৃতি এতদিন দিয়েছে, আশা করি সেটা এখন কমবে। কারণ, আজকে (গতকালের বৈঠক) তারা অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সঙ্গে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব মানে তাদের দেশের সরকারের প্রতিনিধি, অর্থাৎ তারা যে গঠনমূলক ও সুন্দর সম্পর্ক রাখতে চাচ্ছে তা আশা করি এবার মানার চেষ্টা করবে।
এই বৈঠকের পর দুদেশের জনগণের মধ্যে পিপল টু পিপল কানেকটিভিটি সহনীয় পর্যায় যাবে কি না জানতে চাইলে এম সফিউল্লাহ বলেন, না, এই বৈঠকের মধ্য দিয়ে এমনটা সম্ভব নয়। এটা শুধু সুসম্পর্ক তৈরির পথ। এটার সঙ্গে জনগণ একাত্মতা এখনই প্রকাশ করবে না। জনগণের মধ্যকার সম্পর্ক গড়তে আরও অনেক সময় লাগবে, আরও অনেক আলোচনা করতে হবে। দুদেশকেই সেটা চাইতে হবে। ভারতের পক্ষ থেকে সুসম্পর্ক চাওয়া হচ্ছে কি না তা তাদের সচিবের বক্তব্যেই স্পষ্ট। ভারতের সচিব বলেছেন, সংকট কাটিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেবে ভারত।
তিনি আরও বলেন, ভারতে শেখ হাসিনা বক্তব্য দিলে আমরা তাদের জোর (ফোর্স) করে সেটা বন্ধ করতে পারি না। কারণ এটাও ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তবে শেখ হাসিনা যেহেতু বিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন, তাই আমরা ভারতকে সংবাদ প্রচার না করতে অনুরোধ করতে পারি।
এম সফিউল্লাহ বলেন, কোনো দেশ কারও বন্ধু হয় না। প্রতিটি রাষ্ট্রই নিজেদের স্বার্থ দেখেই কাজ করে। চীন এবং ভারত সীমান্তে যুদ্ধ অবস্থা বিরাজমান। তাও কিন্তু দুদেশের সম্পর্ক নষ্ট হয়নি। বাণিজ্যসহ বহুমাত্রিক সম্পর্ক তাদের। কখনো সম্পর্ক ছিন্ন করতে হয় না। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের সঙ্গেও আমাদের এত তিক্ততা না করাই শ্রেয়।