ডেস্ক রির্পোট:- মাঠ পর্যায়ের পুলিশের সঙ্গে ফলপ্রসূভাবে কাজ এগিয়ে নিতে আসন্ন ডিসি সম্মেলনে একগুচ্ছ প্রস্তাব তুলবেন জেলা প্রশাসকরা (ডিসি)। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাসহ উচ্ছেদ অভিযান, বিভিন্ন জরুরি কার্যক্রম তথা ত্রাণ বিতরণ ও দুর্যোগে তাৎক্ষণিক সেবা দিতে ডিসিদের অধীনে একটি বিশেষ পুলিশ বাহিনী গঠনের প্রস্তাব আসছে। এ ছাড়া জেলার পুলিশ বাহিনীর সার্বিক কার্যক্রমের ওপর বার্ষিক একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন পাঠানোর এখতিয়ারও চান ডিসিরা। পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ কমিটিতে ডিসিদের প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার প্রস্তাবও আসছে। আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হতে যাওয়া ডিসি সম্মেলনে এসব প্রস্তাবের ওপর আলোচনা হবে। তবে প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন হবে কি না, তা যাছাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কারণ প্রস্তাবের পক্ষে-বিপক্ষে পুলিশ ও প্রশাসনের পাল্টাপাল্টি যুক্তি আছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
মাঠ প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ৬৪ জেলায় ডিসিদের অধীনে বিভিন্ন বাহিনী থেকে ১০-১৫ জনের সমন্বয়ে ‘স্পেশাল ডেডিকেটেড রেসপন্স ফোর্স’ গঠনের প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে। প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বলা হয়েছে, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নিজে কিংবা তার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা বিভিন্ন সময় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা, উচ্ছেদ অভিযানসহ বিভিন্ন জরুরি কার্যক্রম তথা ত্রাণ বিতরণ ও দুর্যোগে তাৎক্ষণিক সেবাদান করে থাকেন। এসব কাজ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। নিজস্ব সুরক্ষাসহ এ ধরনের জরুরি সেবা কার্যক্রম জোরদার করার জন্য ডিসির অধীন বিভিন্ন বাহিনীর সমন্বয়ে একটি স্পেশাল ডেডিকেটেড রেসপন্স ফোর্স স্থায়ীভাবে নিয়োগ করা প্রয়োজন। কারণ এ ধরনের তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণে বিদ্যমান বিভিন্ন বাহিনীর সম্পৃক্ততার ক্ষেত্রে দূরত্ব থাকায় এসব কাজে সময়ক্ষেপণ হয়।
মাঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা গেছে, পুলিশ রেজুলেশনস অব বেঙ্গল, ১৯৪৩-এর ৭৫এ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করার পক্ষে যুক্তি দেখিয়েছেন ডিসিরা। তাদের ভাষ্য, বহু বছর ধরেই জেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করছেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেটরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা কার্যক্রমে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে মূলত পুলিশ বাহিনীর ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু পুলিশ কর্মকর্তাদের সার্বিক আচার-আচরণ ও জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিফলিত হয়, এরূপ বার্ষিক প্রতিবেদন প্রদানের বিধান ছিল পুলিশ প্রবিধানের ৭৫এ অনুচ্ছেদে। এটি বাতিল হওয়ার কারণে প্রায়ই এ বিষয়ে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটরা বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। পুলিশ আইন ১৮৬১-এর ধারা-৪ অনুযায়ী জেলার পুলিশ সদস্যদের ওপর জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সাধারণ নিয়ন্ত্রণ বিদ্যমান এবং পিআরবির প্রবিধান ১৯ অনুযায়ী, অপরাধ দমন ও নিরোধ কার্যক্রম জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সার্বক্ষণিক তদারকির বিধান রয়েছে। এ ছাড়া প্রবিধান ১৯ মতে, সাধারণ ডায়েরি, অস্ত্র আইন প্রতিপালন, প্রত্যেক থানার অপরাধজনিত ঘটনাবলির অবস্থা পর্যালোচনা, থানার কর্মকর্তারা তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছেন কি না, সেসব বিষয় তদারকির দায়িত্বও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের। ১৯৪৩ সালের পুলিশ আইনের প্রবিধান ১৫ মতে, পুলিশ কর্মকর্তাদের আচার-আচরণ ও যোগ্যতার ব্যত্যয়ের ক্ষেত্রে তা পুলিশ সুপারের নজরে আনার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য তিনি দায়িত্বশীল। এ বিষয়ে তাকেই জবাবদিহি করতে হয়। সুতরাং পুলিশ রেজুলেশনস অব বেঙ্গল, ১৯৪৩-এর ৭৫এ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে (যিনি একইসঙ্গে ডিসি) জেলা পুলিশ বাহিনীর সার্বিক কার্যক্রমের ওপর একটি গোপনীয় প্রতিবেদন তৈরির ক্ষমতা দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন ডিসিরা। এ প্রতিবেদন পাঠানোর জন্য জননিরাপত্তা বিভাগ একটি নির্দিষ্ট কাঠামো বা ফরম্যাট তৈরি করে দিতে পারে বলেও মনে করেন ডিসিরা। ১৯৪৩ সালের পুলিশ প্রবিধানের ৭৫এ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করলে ডিসিরা পুলিশের কার্যক্রম নিয়ে বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন দেওয়ার ক্ষমতা পাবেন।
প্রস্তাবে পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ কমিটিতে ডিসিদের প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করারও দাবি উঠেছে। প্রস্তাবের পক্ষে বলা হয়েছে, পুলিশের কনস্টেবল নিয়োগটি স্থানীয়ভাবে হয়ে থাকে। তাই নিয়োগ কমিটিতে জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধিকে সম্পৃক্ত করলে নিয়োগ প্রক্রিয়া অধিকতর কার্যকর, ফলপ্রসূ ও গ্রহণযোগ্য হবে। এ ছাড়া পিআরবি, ১৯৪৩ অনুযায়ী পরিদর্শক এবং এর নিচের পদমর্যাদার পুলিশ সদস্যের সক্ষমতা ও কর্মনৈপুণ্য (পারফরম্যান্স) মনিটরিংয়ের দায়িত্ব জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের এখতিয়ারভুক্ত।
তবে পুলিশের নিয়োগে জেলা প্রশাসক কিংবা তার প্রতিনিধি যুক্ত হওয়ার বিষয়টি মোটেই সমীচীন হবে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, পুলিশের কাজ পুলিশই করুক। অন্য ক্যাডার সেখানে ঢুকলে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। এ বিষয়ে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ আব্দুল আউয়াল মজুমদার বলেন, কনস্টেবল নিয়োগের কমিটিতে ডিসির প্রতিনিধিকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাবটি বাস্তবায়ন করা ঠিক হবে না। পুলিশের নিয়োগে ডিসিরা ঢুকে পড়লে তা নিয়ে নেতিবাচক প্রশ্ন উঠবে। কোনো দুরভিসন্ধি আছে বলেও কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারে। সুতরাং সেখানে ডিসিদের সম্পৃক্ত হওয়ার কোনো দরকারই নেই।
আরও যেসব প্রস্তাব আসছে: অপরাধ ডেটাবেজ ও ন্যাশনাল আইডি ডেটাবেজে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) প্রবেশাধিকার চান ডিসিরা। তারা বলছেন, জেলা পর্যায়ে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটরা এবং উপজেলা পর্যায়ে ইউএনওরা তাদের নিজ নিজ অধিক্ষেত্রে জেলা বা উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। জেলা ও উপজেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে উল্লিখিত ডেটাবেজে প্রবেশাধিকার দেওয়া হলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে। বর্তমানে এসব ডেটাবেজে শুধুমাত্র জেলা ও উপজেলার পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রবেশাধিকার রয়েছে। এ ছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন, ২০০৯-এর বিধিমালা তৈরির পক্ষে প্রস্তাব দিয়েছেন ডিসিরা। তাদের ভাষ্য, সাধারণ আইন প্রণয়নের পর ওই আইন কার্যকরভাবে প্রয়োগের স্বার্থে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে বিধিমালা প্রণীত হয়। কিন্তু ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন, ২০০৯ প্রণীত হলেও এখন পর্যন্ত কোনো বিধিমালা তৈরি করা হয়নি। আইনটির যথার্থ কার্যকারিতার স্বার্থে ভ্রাম্যমাণ আদালত বিধিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন।
বিশেষজ্ঞ মত: ডিসিদের অধীনে বিশেষ পুলিশ বাহিনী গঠনের যৌক্তিকতা প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সাবেক রেক্টর (সচিব) একেএম আব্দুল আউয়াল মজুমদার বলেন, ‘ব্রিটিশ আমলে এসপি, কিংবা ডিসিদের অধীনে এরকম বিশেষ বাহিনী ছিল। কালক্রমে সেগুলো বিলুপ্ত হয়েছে। এটার ভালো দিক যেমন আছে, খারাপ দিকও আছে। ভালো-মন্দ বিবেচনায় নিয়ে এ বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত সরকার নিতে পারে। তবে এটি বাস্তবায়ন সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এ বাহিনী গড়ে তোলার আগে ডিসিদের সৎ, দক্ষ ও মর্যাদাবান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। কারণ ডিসিদের নিয়ে জনমনে নানা বিতর্কিত প্রশ্ন উঠছে।’
তবে এ প্রস্তাবের পক্ষে একমত নন সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নুর মোহাম্মদ। তিনি প্রস্তাবটিকে অপ্রাসঙ্গিক বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তার ভাষ্য, ‘প্রতি বছরই এরকম কিছু অপ্রাসঙ্গিক প্রস্তাব তাদের (ডিসি) পক্ষ থেকে আসে। নিজেদের যেসব কাজ, সেগুলো ঠিকঠাকভাবে করুক আগে। সরকারের পক্ষ থেকে এসব ব্যাপারে তাদের ধমকি দিয়ে থামিয়ে দেওয়া উচিত।’
১৯৪৩ সালের পুলিশ প্রবিধানমালার ৭৫এ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল এবং পুলিশের বার্ষিক প্রতিবেদন ডিসিদের কাছ থেকে নেওয়ার প্রস্তাব প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ একেএম আব্দুল আউয়াল মজুমদার বলেন, ‘অনুচ্ছেদটি কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল হয়নি। এটা মুখে মুখেই বাতিল হয়েছে। এখনকার বাস্তবতায় অনুচ্ছেদটি পুনর্বহাল করা দরকার। তাহলে জেলার পুলিশের কর্মদক্ষতা ও জবাবদিহি বাড়বে। তারা গোপনীয় প্রতিবেদনের বিষয়টি মাথায় রেখে জনগণকে আরও বেশি সেবা দিতে চেষ্টা করবে।’ তিনি বলেন, ‘এখন ডিসিরা গোপনীয় প্রতিবেদন না দেওয়ার ফলে পুলিশ অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে। ডিসিদের এ প্রস্তাবটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে জেলা পুলিশের পাশাপাশি জেলা প্রশাসনও লাভবান হবে।’
অন্যদিকে এই প্রস্তাবেরও বিরোধিতা করেছেন সাবেক আইজিপি নুর মোহাম্মদ। তিনি বলেছেন, ‘বার্ষিক প্রতিবেদন ডিসিদের কাছ থেকে কেন নিতে হবে? এটা পুলিশ বাহিনীর বিষয়, পুলিশ বাহিনী বুঝবে। এই আইন বুঝেশুনেই তো বন্ধ করা হয়েছে। এটা নিয়ে আবার নতুন করে প্রস্তাবনা দেওয়া তো ফাজলামো। এ ছাড়াও ডিসিদের কাছ থেকে চাহিদাপত্র (রিকিউজিশন) এলে সে অনুযায়ী সবসময় পুলিশ ফোর্স দেওয়া হয়। সেজন্য তো আলাদা করে কোনো বাহিনীর দরকার নেই।’