রাঙ্গামাটি:- একটি অংশের চাপের মুখে রাঙ্গামাটি পৌরসভা প্রাঙ্গণে পৌর কর্তৃপক্ষের সৌন্দর্য বর্ধন প্রকল্পের কাজ বন্ধ করা হয়েছে। পৌরসভায় কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বলছেন এখন থেকে ব্যবস্থা না নিলে হাতছাড়া হতে পারে পৌরসভার সম্পদ।
পৌর সূত্রগুলো বলছে, চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে পৌরসভার সম্পদ দখল করে আছে। অবশিষ্ট সম্পদ দখলে নিতে চায়। সম্প্রতি পৌর কর্তৃপক্ষ আভ্যন্তরীন নানা সংকট উত্তোরণের উদ্যোগ গ্রহণ করলে চক্রটি সক্রিয় হতে উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে, সাম্প্রদায়িক উস্কানি ছড়িয়ে পৌর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মানববন্ধনও করিয়েছে চক্রটি। এ কাজে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগীতা দিচ্ছে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠন এবং বাঙালি ছাত্র পরিষদের কিছু নেতাকর্মী।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রাঙ্গামাটি পৌর মেয়র আকবর হোসেন চৌধুরীকে অপসারণ করে গত ১৯ আগস্ট রাঙ্গামাটি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক নাসরীন সুলতানাকে পৌর প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয় সরকার।
দায়িত্ব গ্রহণের পর নাসরীন কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়ে নিয়মিত সভা করেন। একাধিক সভায় পৌর কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা পৌর সভার বেদখলকৃত জমি উদ্ধার করা, পৌর মার্কেট সংস্কার করে ভাড়া বৃদ্ধি করে পৌরসভার আয় বৃদ্ধি করা, পৌর মার্কেটেরে ভাড়াটিয়াদের সাথে চুক্তি নবায়ন করা, পৌর ভবন সৌন্দর্য এবং নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে নিরাপত্তা বেষ্টনী করার দাবী তুলেন। সভার সিদ্ধান্ত মতে পৌর ভবনের সামনে সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ শুরু করা হলে এর বিরুদ্ধে গত মঙ্গলবার মানববন্ধন করে একটি অংশ।
মানববন্ধনে বক্তব্য দেওয়া বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মোঃ সাইফুল ইসলাম শাকিল ইনডিপেনডেন্টকে বলেন, আমি মানববন্ধনে বিএনপি নেতা হয়ে যাইনি। আমি গিয়েছি একজন সচেতন পৌরবাসী হিসেবে। পৌরসভার পরিকল্পনায় যদি বর্তমান খোলা মাঠে হল রুম করার পরিকল্পনা থাকে এবং যদি সে কাজ শুরু করা হয় আমরা বাঁধা দিব না। পৌর প্রশাসক পৌরবাসীর সাথে কথা না বলে এ কাজ করতে পারে না। শাকিল বলেন বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাঙামাটি শহরে খেলার মাঠ নাই, সভা সমাবেশ করার মত জায়গা নাই সেজন্য পৌরসভা মাঠটি উন্মুক্ত রাখলে ভাল হয়।
মানববন্ধনে শাকিল ছাড়াও রাখেন জাতীয়দাবাদী সাংস্কৃতিক দলের রাঙামাটি জেলা সাধারণ সম্পাদক কামাল হোসেন জেলা দুর্নীতি দমন কমিটির সভাপতি মোঃ ওমর ফারুকসহ বিএনপি সহযোগী সংগঠন এবং পার্বত্য নাগরিক পরিষদের একাধিক নেতা।
পৌরসভার হিসাব কর্মকর্তা ফারুক আহমদ বলেন, পৌরসভা প্রাঙ্গণে ফুল বাগান নিয়ে কয়েকজন মানুষ যা শুরু করেছে এদের কথা কার্যক্রম বন্ধ করা হলে আগামীতে পৌরসভার জায়গাটিও জনগণের জন্য দিতে হবে। ফুল বাগান করলেও তো অনুষ্ঠান করা যাবে। যেখানে ফুল বাগান করা হচ্ছে এখানে আগে পৌর টাউন হল ছিল। তখনো তো বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয়েছিল। পুরনো হল রুম ভেঙে ফেলার কারণে এখন হয়ত খোলা মাঠ দেখা যাচ্ছে। পৌরসভা ভবনটি সম্পুর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় আছে। এখানে প্রতিনিয়িত চুরি হয়। বারান্দায় লাইট ফ্যান তারসহ ইলেক্ট্রিক সরঞ্জাম একাধিকবার চুরি হয়েছে। বাইরে কোন কিছু রাখা যায় না। আমরা দেখি প্রতিদিন রাতে পৌরসভা খোলা স্থানে ট্রাক রাখা হয়। শুনেছি এ ট্রাকগুলো থেকে টাকা তুলে একটি চক্র। ফারুক বলেন পৌর কর্তৃপক্ষের দায় অনেক। শুধু অবসররে যাওয়া কর্মচারীরা পাবে ১৩ কোটি টাকা।
৮ নং ওয়ার্ডের সাবেক পৌর কাউন্সিলর কালায়ন চাকমা বলেন, পৌর ভবনের সামনে বটগাছের গোড়ায় সভা সমাবেশের জন্য একটি মঞ্চ করার পরিকল্পনা আছে সেটা আমি জানি। বিগত সময়ের পৌর কর্তৃপক্ষেরও কিছুটা দুর্বলতা ছিল সেটা হয়ত রাতারাতি সমাধান হবে না এজন্য মনে হচ্ছে বর্তমান সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে।
সাবেক পৌর মেয়র মনি স্বপন দেওয়ান বলেন, পৌরসভা প্রাঙ্গন খেলার মাঠ বা জনসমাবেশ করার স্থান নয়। সেখানে এগুলো হতে পারে না। যারা খেলার মাঠ ও জনসমাবেশ করার জন্য পৌর কর্তৃপক্ষের কাজে বাধা প্রদান করছে খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে তাদের ব্যাক্তিগত স্বার্থ জড়িত। নিজের স্বার্থ উদ্ধারে কেউ পরিবেশবাদী সাজেন। তাদের স্বার্থে এরা পরিবেশ বিরোধী কাজ হলেও নিশ্চুপ থাকে। বর্তমানে যে শিশু পার্ক করা হয় এটি তো খেলার মাঠ ছিল। আমি নিজে এ মাঠে খেলা খেলছি কই এখানে তো কেউ বাধা দিল না। আমি পৌর মেয়র থাকাকালীন চেষ্টা করেছি পৌরসভারকে একটি মডেল পৌরসভায় পরিণত করার। নানা বাধার মুখে অনেক উচ্ছেদের কাজ করেছি। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি যে কাজ করতে পারে সেটা হয়ত ভারপ্রা্প্ত পৌর প্রশাসক করতে পারবে না। নির্বাচিত মেয়র হলে বাধা উপেক্ষা করে কাজটি করা যেত। সেজন্য নির্বাচন দরকার।
আরেক সাবেক মেয়র সাইফুল ইসলাম ভুট্টো বলেন, সৃষ্ট সমস্যার মাঝে কোথাও শূণ্যতা আছে মনে হচ্ছে। বর্তমান পৌর প্রশাসক সম্ভবত বুঝাতে পারছেন না তিনি কি করতে চাচ্ছেন। তার উচিত ছিল পৌরসভার গুরুত্বপুর্ণ নাগরিকদের সাথে কথা বলে এ কাজ করার। পৌর কর্তৃপক্ষ পৌর ভবনের সামনে কি করবে সেটা পৌর কর্তৃপক্ষের ব্যাপার। তবে সে করাটি জনপ্রতিনিধি কর্তৃক করা হলে সহজ হয়।
পৌরসভার একটি সূত্র জানায়, পৌর এলাকা উন্নয়নে সম্প্রতি নগর পরিচালন ও অবকাঠামো উন্নতিকরণ প্রকল্প (ইউজিপ) এর ১২ কোটি একটি প্রকল্প টেন্ডার আহবান হয়েছে। এ কাজটি পেতে চায় বিএনপির কয়েকজন নেতা। এ কাজ পেতে পৌরসভার উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে চাপ সৃষ্টি করছে বিএনপির কয়েকজন নেতা।
জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মামুনুর রশীদ মামুন বলেন, পৌর কর্তপক্ষের কাজে বিএনপি বাঁধা দিচ্ছে না। পৌর কর্তৃপক্ষ থেকে কিছু পাবার জন্য চাপও দিচ্ছে না। দলের পক্ষ থেকে যারা কথা বলছে এগুলো ব্যক্তিগত কথা। দলীয় নয়। বিএনপি চায় পৌরসভার বিগত অনিয়ম যেন তদন্ত করে সুন্দর একটি পৌরসভা আমাদের উপহার দেয়া হয়।
নাসরীন সুলতানা বলেন, এক পৌর মার্কেটে ভাড়াটিয়া ফজলে এলাহীকে বেশী আগ্রহী মনে হচ্ছে। সে মুহুর্তে মুহুর্তে পৌর কর্তৃপক্ষের কাজের বিরুদ্ধে ফেসবুকে লেখালেখি করে উস্কানি দিচ্ছে। এ লোক পৌর মার্কেটে ভাড়াটিয়া। সে ৮টি দোকান দখল করে আছে। ভাড়া বকেয়া রেখেছে টাকা। মার্কেট সংস্কারের জন্য ফ্লট ছাড়তে এবং বকেয়া টাকা পরিশোধ করতে নোটিশ দেওয়ার পর সে পুরো পৌর মার্কেট ভাড়া নেওয়ার জন্য আবেদন করেছে।
ফজলে এলাহী বলেন, পৌর প্রশাসক যা বলছেন তা সম্পুর্ণ মিথ্যা বলছেন। পৌর কর্তৃপক্ষের দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে মার্কেট লাভজনক হতে পারছে না। এখানে নানান সমস্যা বিদ্যমান। বিদ্যুৎ বিল বকেয়া রাখে পৌর কর্তৃপক্ষ। আমাকে দোকান ছাড়ার নোটিশ দেওয়া হয়েছে। আমি চাইলে হুট করে ছাড়তে পারব না। আমার সকল বকেয়া পরিশোধ করা আছে। পৌর কর্তৃপক্ষ পৌর মার্কেটটি চট্টগ্রামের একটি প্রতিষ্ঠানকে হাসপাতালের জন্য ভাড়া দিতে চাচ্ছে। আমরা যদি পৌরসভাকে সে পরিমাণ অর্থ দিতে পারি তাহলে পৌর কর্তৃপক্ষ আমাদের ভাড়া দিবে না কেন? সেজন্য আমি পৌর মার্কেট পাবার জন্য আবেদন করেছি।
এলাহী বলেন, পৌর মার্কেটের ৫৮টি প্লট। চালু আছে মাত্র ১৭টি। মার্কেটের অর্ধেকের বেশী পৌরসভার গোডাউন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পৌরসভার দুর্বল ব্যবস্থাপনার দায় দোকানদারদের উপর চাপালে তো হবে না। আমি ব্যাংকের মাধ্যমে বিল পরিশোধ করি। পৌর মার্কেটে চিরকাল থাকার কোন মানসিকতা নেই। আমি অফিস পরিবর্তনের জন্য জায়গা চাচ্ছি। আমাকে সময় দিতে হবে।
এ পৌর প্রশাসক নাসরীন সুলতানা বলেন, আমাকে দায়িত্ব দেওয়ার পর পৌরসভায় নিয়মিত সভা করেছি। সভায় উপস্থিত সবাই রাঙ্গামাটির বাসিন্দা। সভার সিদ্ধান্তের বাইরে পৌরসভা কোন কাজ করছি। সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক কাজ বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছি। যা করেছি রাঙ্গামাটি পৌরবাসী কল্যাণের জন্য করেছি। বেদখলে থাকা পৌরসভার সম্পদ উদ্ধারে অভিযান চালিয়েছি। পৌরসভার বকেয়া আদায় করে কিভাবে আয়ের খাতগুলো সচল করা যায় সে কাজ করার চেষ্টা করছি। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে কিছু মানুষের আচরণ দেখে আমি অবাক হচ্ছি। সৌন্দর্য বর্ধন কাজ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
নাসরীন বলেন, আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে পৌরসভার জন্য যে সহায়ক কমিটি গঠন করে দেয়া হয়েছে তাদের সমন্বয়ে মাসিক মিটিংয়ের মাধ্যমে পৌরসভার সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। পৌরসভার সামনের মাঠটি অকেজো গাড়ি রেখে ব্লক করা ছিল। তাছাড়া কতিপয় ব্যাক্তি রাতের বেলা অবৈধভাবে এই মাঠকে ট্রাক স্ট্যান্ড হিসেবে ব্যবহার করে ভাড়া আদায় করতো। যা আমরা বন্ধ করে দিয়েছি। আমাদের পরিকল্পনা ছিল এই জায়গাটিকে সুন্দরভাবে ব্যবহার উপযোগী করা। এটির সামনের অংশে কিছু শীতকালীন ফুল গাছ রোপন করা, যেপাশে গর্ত আছে তা ভরাট করে বাচ্ছাদের জন্য কয়েকটি রাইড স্থাপন এবং মাঝখানের অংশে ব্যাডমিন্টন কোর্ট করা যাতে পৌরসভার কর্মকর্তা /কর্মচারীসহ পৌরএলাকার জনগণ খেলাধুলা করতে পারে।
মাঠটি ঘিরে যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল তা বাস্তবায়ন শেষ হলে আসলে সবাই বুঝতে পারতো মাঠটি নষ্ট নয় বরং তাদের সকল রকম প্রোগ্রাম বাস্তবায়নের জন্য এটিই হতো সবচেয়ে ভালো জায়গা। যেহেতু সবাই কাজটির বিরুদ্ধে জনগণ আপত্তি জানিয়েছে সেহেতু আপাতত কাজটি স্থগিত রেখেছি তবে পরবর্তী মাসিক সভায় পুনরায় আলোচনার প্রক্ষিতে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
দায়িত্ব নেয়ার পর পৌরসভার বেদখলে থাকা কিছু সম্পত্তি উদ্ধার করেছি,আরো কিছু দখলদারকে নোটিশ দিয়েছি । এসব দখল উদ্ধার করে পৌরসভার আয় বৃদ্ধি করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। আমি সরকারি চাকরি করি, সরকারি স্বার্থরক্ষায় কাজ করা আমাদের দায়িত্ব। সুত্র পাহাড়ের খবর