ডেস্ক রির্পোট:- পরিবারের সদস্যসহ শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার দেশে-বিদেশে সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ জন্য তিন সংস্থার সমন্বয়ে ১০টি টিমও গঠন করা হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত এসব টিম আজ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করবে। অনুসন্ধানের তালিকায় আছে সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের নামও। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ সাতটি বৃহৎ শিল্প গ্রুপের সম্পদের খোঁজও নেবে এই টিম।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অবৈধ সম্পদ অর্জন, রাজস্ব ফাঁকি ও অর্থ পাচারে সন্দেহভাজন গত সরকারের সময়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি ও ব্যবসায়ী গ্রুপের বিষয়ে অনুসন্ধানে এসব টিমের কার্যক্রম সমন্বয় করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে থাকা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। আর আইনি সহায়তা দেবে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়। অনুসন্ধানের আওতায় আনা প্রভাবশালী বেশির ভাগের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ইতোমধ্যে ফ্রিজ করেছে বিএফআইইউ।
জানা গেছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর পরিবার এবং আত্মীয়স্বজনের যাদের বিষয়ে তদন্ত করা হবে, প্রাথমিকভাবে তার একটি তালিকা করা হয়েছে। শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, তাঁর বোন শেখ রেহানা, মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক, ছেলে রেজওয়ান সিদ্দিক ববি, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, শেখ ফজলে নূর তাপস, শেখ ফজলে ফাহিম, শেখ হেলাল, শেখ তন্ময়, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ, সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ এবং তাদের পরিবারের সদস্য, স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে তদন্ত করা হবে।
অনুসন্ধানের আওতায় থাকা তালিকায় রয়েছে ব্যাংক দখল, ঋণ জালিয়াতি ও অর্থ পাচারে অভিযুক্ত এস আলম গ্রুপ। আরও রয়েছে সামিট, বেক্সিমকো, বসুন্ধরা, ওরিয়ন, নাশা ও জেমকন গ্রুপ। এসব ব্যক্তি ও ব্যবসায়ী গ্রুপের সম্পদের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণ, ঋণের ব্যবহার, অর্থের গতিপথ, তাদের ব্যবসায়িক ও অন্যান্য লেনদেন, ঋণের সুবিধাভোগীসহ বিভিন্ন বিষয়ে অনুসন্ধান চালানো হবে। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, কানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশে তাদের বিষয়ে তথ্য চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিদেশে থাকা সম্পদ জব্দ করার আদেশ দিয়েছেন আদালত। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মো. জাকির হোসেন গত ২১ নভেম্বর এ আদেশ দেন। সংযুক্ত আরব আমিরাত, স্লোভাকিয়া, সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস, সুইজারল্যান্ড, ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জ, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, সাইপ্রাসসহ বিভিন্ন দেশে তাদের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ আনা হয়। আদালতের আদেশের অনুলিপি স্লোভাকিয়ার স্টেট রেজিস্টার, সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিসের সিটিজেন ইন্টারন্যাশনাল, সুইজারল্যান্ডের চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জের অর্থ, শ্রম ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ইউকে ডিপার্টমেন্ট ফর বিজনেস অ্যান্ড ট্রেড, এক্সচেঞ্জ অব সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাতের হাবিব ব্যাংকের চেয়ারম্যান, সাইপ্রাসের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ভূমি জরিপ বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে পাঠানো হয়েছে। তাদের কাছে পারস্পরিক আইনি সহায়তার অনুরোধও জানানো হয়েছে। এর আগে সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের পরিবারের সম্পদ ক্রোকের আদেশ দেন আদালত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, সমন্বয়ের অভাবেই দেশি-বিদেশি সম্পদ উদ্ধার কঠিন হয়। যে কারণে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি গত কয়েক দিনে বিএফআইইউতে একাধিক বৈঠক করেছে। প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে কমিটি এসব ব্যক্তি ও ব্যবসায়ী গ্রুপের তালিকা করেছে। অবৈধ সম্পদ অর্জন ও পাচার চিহ্নিত হওয়ার পর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত এবং পাচার হওয়া অর্থ দ্রুত ফেরত আনার চেষ্টা করা হবে। পুরো কার্যক্রম যথাযথভাবে এগিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে চারটি সংস্থার পক্ষ থেকে সমন্বিতভাবে কাজ করা হবে। বিশেষ ১০টি টিম দেশি-বিদেশি কার কোন সম্পদ আছে, আয়কর নথিতে প্রদর্শন হয়েছে কিনা, কোন উপায়ে সম্পদ অর্জন করেছে, অর্থের গতিপথসহ পুরো চিত্র বের করতে কাজ করবে। এসব টিমের কাজ শুধু তদন্ত করেই শেষ হবে না; তদন্ত শেষে মামলা করবে তারা। মামলা পরিচালনার জন্য ডকুমেন্ট সরবরাহ করা হবে চার সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত কমিটি থেকে। আপাতত বিএফআইইউর কার্যালয়ে এর দাপ্তরিক কার্যক্রম চলবে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর অর্থনীতি বিষয়ে শ্বেতপত্র প্রণয়নে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে একটি কমিটি করে সরকার। গত রোববার ওই কমিটি রিপোর্ট জমা দিয়েছে। কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে প্রতিবছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। টাকার অঙ্কে ১৫ বছরে পাচারের পরিমাণ ২৮ লাখ কোটি টাকার বেশি। ব্যাংক, অবকাঠামো, বিদ্যুৎ-জ্বালানি ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বেশি দুর্নীতি হয়েছে। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য গত সোমবার এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আওয়ামী লীগের সময়ে চামচা পুঁজিবাদ থেকে চোরতন্ত্রের উত্থান ঘটে। রাজনৈতিক গোষ্ঠী, উর্দি পরা বা উর্দি ছাড়া আমলা এবং ব্যবসায়ী– এই তিন গোষ্ঠীর সমন্বয়ে চোরতন্ত্র সৃষ্টি হয়। চোরতন্ত্রের বিষবৃক্ষ সৃষ্টির উৎস ছিল ২০১৪ সাল থেকে তিনটি বিতর্কিত নির্বাচন। এর মাধ্যমে মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার ও জবাবদিহির জায়গা নিশ্চিহ্ন করা হয়।সমকাল