ডেস্ক রির্পোট:- আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দেশে যে উন্নয়নের প্রচার করা হতো, তা দেশে-বিদেশে প্রশংসা কুড়ালেও প্রকৃতপক্ষে একটি ‘চোরতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। উন্নয়নের বয়ানকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে অন্তত ২৮ রকম উপায়ে দুর্নীতি সংঘটনের তথ্য খুঁজে পেয়েছে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দেশের সাতটি মেগা প্রকল্প। এসব প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে দুর্বলভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে, যার মাধ্যমে সম্পদের অপচয় হয়েছে। প্রকল্প যথাসময়ে শেষ করা হয়নি, এ ছাড়া খরচ বাড়ানো হয়েছে কয়েক গুণ। আর এই খরচ বাড়ানোর আড়ালে দেশের প্রায় লাখ কোটি টাকা লোপাট হয়ে গেছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এসব বিষয় উঠে আসে।
মেগা প্রকল্পগুলোর ব্যয় ও দুর্নীতি দেশের মানুষ এবং অর্থনীতির জন্য মেগা উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে বলে মনে করছেন কমিটির সদস্য ও সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে যেসব টাকা লোপাট করা হয়েছে, তা পরবর্তী প্রজন্মের ঘাড়ে বোঝা হয়ে রইল এবং সেটি কয়েক প্রজন্মকে বহন করতে হবে। কারণ, এই টাকার বড় অংশই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প, দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ দেশের সাতটি মেগা প্রকল্পের কোনো কোনোটির ব্যয় প্রায় ৯০০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি কিলোমিটার চার লেনের প্রধান সড়ক ভারতের চেয়ে ৪ দশমিক ৪ গুণ এবং পাকিস্তানের চেয়ে ২ দশমিক ১৫ গুণ বেশি খরচ করা হয়েছে। রংপুর-হাটিকুমরুল চার লেনের সড়ক নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে খরচ প্রায় ৬ দশমিক ৪৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের প্রতি কিলোমিটারে খরচ প্রায় ৭ দশমিক শূন্য ৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ধরা হয়েছে। ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা চার লেনের এক্সপ্রেসওয়েতে প্রতি কিলোমিটারে খরচ নির্ধারণ করা হয় ১১৩ দশমিক ৭ কোটি টাকা।
প্রতিবেদন অনুসারে, শহর এলাকায় চার লেনের প্রতি কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণে দেশে গড় ব্যয় করা হয়েছে ৬ দশমিক ৩৫ মিলিয়ন ডলার। যেখানে একই ধরনের রাস্তা নির্মাণে চীনের ব্যয় ৩ দশমিক ৯০ মিলিয়ন ডলার, ভারতে ব্যয় ১ দশমিক ৪৫ মিলিয়ন ডলার, পাকিস্তানে ব্যয় ২ দশমিক ৯৫ মিলিয়ন ডলার, ইন্দোনেশিয়ায় ২ দশমিক ১৫ মিলিয়ন ডলার, ফিলিপাইনের ব্যয় ১ দশমিক ১৫ মিলিয়ন ডলার ও তুরস্কে ব্যয় হয়েছে ১ দশমিক ৭০ মিলিয়ন ডলার।
কমিটির প্রতিবেদন অনুসারে, দেশের সাত মেগা প্রকল্পের শুরুতে যে ব্যয় ধরা হয়েছিল, চূড়ান্তভাবে তার চেয়ে ৮০ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় করা হয়েছে। প্রকল্পগুলোর প্রাথমিক মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ লাখ ১৪ হাজার ৫৪৭ দশমিক ৫৬ কোটি টাকা। তবে চূড়ান্ত খরচ দেখানো হয়েছে ১ লাখ ৯৫ হাজার ১১৬ দশমিক ৮৭ কোটি টাকা। সে হিসাবে প্রকল্পগুলোতে ৭০ শতাংশ ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। ফলে অনেক প্রকল্পের প্রাথমিক খরচের তুলনায় চূড়ান্ত খরচ ছিল কয়েক শ শতাংশ বেশি।
সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে গবেষণা পরিচালনা, প্রকল্প পরিকল্পনা ও নথিপত্র প্রস্তুত করার পদ্ধতির স্বচ্ছতার অভাবকে মেগা প্রকল্পগুলোতে দুর্নীতি বেশি হওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে কমিটি। তবে আইএমইডি নিয়মিতভাবে এসব অনিয়ম ও দুর্নীতি তুলে ধরে সরকারের কাছে প্রতিবেদন দিয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বছরের পর বছর করা এই পর্যবেক্ষণ, মন্তব্য ও পরামর্শের তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা নেয়নি সরকার।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায় সব বড় প্রকল্পেরই একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল বহুবার সংশোধন করা। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোতে প্রায়ই জটিল বৃহৎ পরিকল্পনার জন্য পরিচালিত নিরীক্ষা এবং প্রকল্প থেকে আয়ের যথাযথ মূল্যায়নের প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞতা ছিল না। নকশায় ঘন ঘন পরিবর্তন প্রকল্পের সময় বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যয়ও বাড়িয়েছে। প্রকল্পের পরবর্তী ক্রয়প্রক্রিয়া প্রথমদিকের মতো আরডিপিপিতে সংশোধিত বিধান অনুযায়ী করা হয়নি। তার বড় উদাহরণ হলো মাতারবাড়ী ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, যা প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের কাছে একটি সাধারণ ঘটনা ছিল। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বিগত সরকারের নেওয়া প্রকল্পগুলোর মধ্যে প্রায় ৮৬ দশমিক ৪ শতাংশ প্রকল্পের সময় বা ব্যয় অথবা উভয়ই বাড়ানো হয়েছে।
শ্বেতপত্র কমিটির প্রধান ও অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আওয়ামী লীগের দুর্নীতি ও অনিয়ম এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে তারা বিদেশি পরামর্শকদেরও হুমকি-ধমকি দিয়ে নিজেদের ইচ্ছামতো কাজ আদায় করে নিত। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা দাতা সংস্থা বা পরামর্শকদের কার্যালয় বন্ধ করে দেওয়ারও হুমকি দিতেন।