সৈয়দ ইবনে রহমত:- ২ ডিসেম্বর ২০২৪। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক চুক্তির ২৭ বছর পূর্তি। চুক্তির ২৭ বছর পূর্তি উপলক্ষে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এক বাণীতে বলেছেন, ‘পার্বত্য জেলাসমূহের নৈসর্গিক সৌন্দর্য সংরক্ষণ ও পর্যটন শিল্পের প্রসারে স্থানীয় জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করে নানামুখী সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এতে বেকারত্ব হ্রাস পাবে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে এবং জীবনযাত্রার উন্নতি ও সামাজিক বৈষম্য দূর হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল অধিবাসীর জীবনে শান্তি, সম্প্রীতি, উন্নয়ন ও অগ্রগতির অভিযাত্রা অব্যাহত রাখতে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা আবশ্যক। ছাত্র-শ্রমিক-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন অটুট রেখে ঐক্যবদ্ধভাবে বৈষম্যমুক্ত নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে অঙ্গীকারবদ্ধ।’ বাণীতে প্রধান উপদেষ্টা পাহাড়ে বৈষম্যহীন সমাজের কথা বলেছেন, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সেটা কীভাবে সম্ভব? বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক এই একপেশে চুক্তি বলবৎ রেখে, বৈষম্যহীন সমাজের ভাবনাটাই তো একটা অকল্পনীয় ব্যাপার।
এই চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর। তখন ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ, আর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেখ হাসিনা। সেই সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটির সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির স্বাক্ষরিত চুক্তির প্রথম ধারাতেই ‘পার্বত্য চট্টগ্রামকে উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল’ ঘোষণা দিয়ে অর্ধেক জনগোষ্ঠি বাঙালিদের অস্তিত্বকে কার্যত মুছে দেয়া হয়েছে। এরপর যত ধারা উপধারা এই চুক্তিতে যুক্ত করা হয়েছে তার সবগুলোই মূলত বাঙালিদের অধিকার কেড়ে নিয়ে উপজাতি তথা অবাঙালিদের হাতে পাহাড়ের সকল ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধা তুলে দেয়ার জন্য। এই চুক্তির আলোকে সংশোধিত তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন-১৯৯৮, আঞ্চলিক পরিষদ আইন-১৯৯৮, পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন-২০০১ (সংশোধিত ২০১৬) এতটাই একপেশে যে পাহাড়ে বসবাসরত বাঙালিদের অস্তিত্ব বিনাশের বীজ বপন করা আছে এসব আইনের প্রতিটি ধারা-উপধারায়।
এই চুক্তিতে বাঙালিদের প্রতি বৈষম্য এবং সংবিধানবিরোধী ধারা-উপধারা যুক্ত থাকার অভিযোগ এনে উচ্চ আদালতে একাধিক রিট করা হয়েছিল। দীর্ঘ শুনানি শেষে রিট আবেদন নম্বর ২৬৬৯/২০০০ এবং ৬৪৫১/২০০৭-এর প্রেক্ষিতে দেয়া রায়ে হাইকোর্ট দ্ব্যর্থহীন ভাষায় পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদ আইনকে বেআইনি ও অবৈধ ঘোষণা করেছে। পৃথক দু’টি মামলার রুলের চূড়ান্ত শুনানি গ্রহণ করে বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীকে নিয়ে গঠিত হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ ২০১০ সালের ১২ ও ১৩ এপ্রিল দুই দিনব্যাপী এক ঐতিহাসিক রায় প্রদান করেন। এই রায়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি সম্পর্কে মন্তব্যে আদালত বলেন, বহু-বৈচিত্র্যময় শান্তিচুক্তিটি সংবিধানের অধীন বর্ণিত চুক্তির অন্তর্ভুক্ত নয়। দীর্ঘদিন ধরে চলমান শান্তি প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট এই আন্তঃরাষ্ট্রীয় শান্তিচুক্তিটি মূলতঃ সংবিধান সংশ্লিষ্ট নয় এবং সাংবিধানিক বিবেচনার বাইরে থেকেই এর প্রকৃতি ও বৈধতা নির্ধারণ করতে হবে। তাছাড়া শান্তিচুক্তি স্বাভাবিক কার্যকারিতা হারিয়েছে। কারণ, এই চুক্তিটি পরবর্তীকালে ৪টি আইনে পরিবর্তিত হয়েছে। এ কারণে শান্তিচুক্তির বৈধতার প্রশ্নে আদালতের কিছু বিবেচনার প্রয়োজন নেই। কারণ, শান্তিচুক্তির শর্তগুলো উক্ত ৪টি আইনের মাধ্যমে কার্যকর হয়েছে। ফলে আদালত শান্তিচুক্তির পরিবর্তে চুক্তির শর্ত মোতাবেক প্রণীত আইনগুলো সম্পর্কে মতামত ব্যক্ত করে রায় প্রদান করেন।
আঞ্চলিক পরিষদ আইন সম্পর্কে আদালতের বক্তব্য হচ্ছে, আঞ্চলিক পরিষদ আইনের ধারা ৪১-এর মাধ্যমে আইন প্রণেতাদের ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ দেয়ার উদ্দেশ্যকেই প্রকাশ করে। রাষ্ট্রের একক স্বত্বাকে খর্ব করার উদ্দেশ্যেই আঞ্চলিক পরিষদ আইনের ধারা ৪০ এবং ৪১ ইচ্ছাকৃতভাবেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়াও আঞ্চলিক পরিষদ আইন সংবিধানের ১ নম্বর অনুচ্ছেদে রক্ষিত রাষ্ট্রের একক চরিত্র হিসাবে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে বিনষ্ট ও ধ্বংস করেছে। বাদী এবং বিবাদী পক্ষের যুক্তিতর্ক ও সংবিধানের ৮ম সংশোধনী মামলার মতামত ও পর্যবেক্ষণ থেকে আদালত সিদ্ধান্তে আসে যে, আঞ্চলিক পরিষদ আইনটি রাষ্ট্রের একক চরিত্র ধ্বংস করেছে বিধায় এটি অসাংবিধানিক। এ ছাড়াও সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদ মোতাবেক এই আঞ্চলিক পরিষদ কোনো স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা নয়। এর কারণ হচ্ছে যে, পরিষদ আইনে আঞ্চলিক পরিষদকে প্রশাসনিক কোনো ইউনিট হিসাবে আখ্যা দেয়া হয়নি।
হাইকোর্টের রায়ে আঞ্চলিক পরিষদ আইন এবং আঞ্চলিক পরিষদকে অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণার পাশাপাশি পার্বত্য তিনটি জেলা পরিষদ আইনের বেশ কিছু ধারাকে বেআইনি ও অবৈধ ঘোষণা করেছে। আদালত যেলা পরিষদ আইনের ৬ নম্বর ধারা বিবেচনা করে উল্লেখ করেন, ঐ ধারায় একজন ব্যক্তি উপজাতীয় কি না, তা গ্রামের হেডম্যান কর্তৃক প্রদত্ত সনদের দ্বারা নির্ধারিত হবে বলে সার্কেল চিফকে ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে। বস্তুতঃ এই বিধান এমন কোন বস্তুনিষ্ঠ মানদণ্ড নিশ্চিত করেনি যার দ্বারা ঐ সনদ প্রদান করা হবে কি না, তা নিশ্চিত করা যায়। তাই এটি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭, ২৮(১), ২৯(১) এবং ৩১-এর বিধানগুলোর লঙ্ঘন। সংবিধানের একই বিধানগুলো দ্বারা ১৯৮৯ সালের আইনের ১১ নম্বর ধারা (যা ১৯৯৮ সালের আইনের ১১ নম্বর ধারার সংশোধিত)- যার বিধান অনুযায়ী ‘স্থানীয় সরকার পরিষদ নির্বাচনে ভোট প্রদান করতে হ’লে একজন ব্যক্তিকে অবশ্যই পাহাড়ি অঞ্চলে জমির অধিকারী এবং ঐ এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা হ’তে হবে কে বাতিল করে। আদালত মনে করেন যে, ওই ধারা বাস্তবিকভাবে একজন অ-উপজাতীয় (বাঙালি) ব্যক্তিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে যেকোন নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত করছে যদিও বাংলাদেশ সংবিধানে সেই অধিকারগুলো রক্ষিত আছে। আদালত আরো উল্লেখ করেন যে, ১৯৮৯ সালের আইনের ধারা ৩২(২) এবং ৬২(১) (যা ১৯৯৮ সালের আইনের সংশোধিত) এর দ্বারা পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগের ক্ষেত্রে উপজাতীয়দের অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। এই নিয়োগের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার নীতির বিধান পূর্ববর্তী আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নিয়োগ নীতির পরিবর্তে আনা হয়েছে।
কোন ব্যক্তি কীভাবে এবং কীসের ওপর ভিত্তি করে অন্য ব্যক্তির অধিকারকে লঙ্ঘন করে এবং তাকে বাদ দিয়ে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে নিয়োগের সুবিধা পাবে, এই আইনে সে বিষয়ে কিছুই উল্লেখ নেই। তাই আদালত মনে করেন যে, এই বিধানগুলো সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭, ২৮ (১), ২৯ (১) এবং (২) এর পরিপন্থী। এই পরিপ্রেক্ষিতে বস্তুনিষ্ঠ মানদন্ডের অনুপস্থিতিতে এবং বর্ণ বৈষম্যের ওপর ভিত্তি করে অগ্রাধিকার নীতি প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় তা অসাংবিধানিক। অপরদিকে আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও আঞ্চলিক পরিষদকে বেআইনি ও অবৈধ এবং পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনসমূহের বিভিন্ন বিতর্কিত ধারা বাতিল করে হাইকোর্টের রায় পেশ করার দিনই আদালত প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়ে অতিরিক্ত এটর্নি জেনারেল এডভোকেট মুরাদ রেজা জানিয়েছিলেন যে, রায় ঘোষণার পর এর বিরুদ্ধে আপিল না করা পর্যন্ত আঞ্চলিক পরিষদের কোনো অস্তিত্ব নেই। যতদূর জানি সেই মামলাগুলো বর্তমানে আপিল বিভাগের রিভিউ শুনানির অপেক্ষায় আছে। আমরা প্রত্যাশা করি, অতিদ্রুত এসব মামলার রিভিউ শুনানি করে চূড়ান্ত ফয়সালার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক চুক্তি এবং চুক্তির আলোকে প্রণীত আইনে বিদ্যমান বৈষম্য ও সংবিধানবিরোধী ধারা-উপধারাসমূহ বিলোপ করে পাহাড়ে বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হবে। অন্যথায় পাহাড়ে কোনোদিন বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখা সম্ভব না।
ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে গদিচ্যুত করে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান। ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী স্পিরিট নিয়ে গঠিত হয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। আর এই অন্তর্বর্তী সরকার তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠন করেছে, সেখানে কিন্তু বৈষম্যবিরোধী চেতনার কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। বরং পার্বত্য বাঙালিদের প্রতি বৈষম্য আরও বেড়েছে। জনসংখ্যার দিক থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি এবং অবাঙালি সমান হলেও একপেশে চুক্তি এবং চুক্তির আলোকে সংশোধিত জেলা পরিষদ আইন অনুযায়ী পরিষদের এক তৃতীয়াংশ (৩৩ শতাংশ) সদস্য হবেন অ-উপজাতি (বাঙালি), দুই তৃতীয়াংশ (৬৬ শতাংশ) হবেন উপজাতি (অবাঙালি)। কিন্তু ১৫ জনের জেলা পরিষদে বাঙালি আছেন চার জন (২৬ শতাংশ) এবং অবাঙালি আছেন ১১ জন (৭৪ শতাংশ)। এটা কি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার আলামত বহন করে?
আরও একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের অধীনে RHDC- ERRD-CHT, UNDP এর যৌথ প্রকল্পের জনবল নিয়োগের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা নেওয়ার পর গত ২৩ নভেম্বর ২০২৪ চূড়ান্তভাবে ১৯ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। নিয়োগ প্রাপ্তদের মধ্যে বাঙালি মাত্র ২ জন (১০ শতাংশ), অবাঙালি ১৭ জন (৯০ শতাংশ)! এমন উদাহরণ পাহাড়ের পরতে পরতে বিরাজমান। এসব জাতিগত বঞ্চনা বিদ্যমান রেখে পাহাড়ের বৈষম্যহীন সমাজের প্রত্যাশা কি আদৌ কল্পনা করা সম্ভব?
লেখক: সাংবাদিক ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষক।
sayedibnrahmat@gmail.com