শিরোনাম
আইএমএফের ঋণের দীর্ঘ মেয়াদি ফাঁদে বাংলাদেশ এবারের টার্গেট খালেদা-তারেক,আবারও মাইনাস টু ফর্মুলা ষড়যন্ত্র বৈষম্যবিরোধীদের ডাকা সভায় যোগ দেয়নি মূলধারার ছাত্র সংগঠনগুলো ‘মুন্নী সাহার স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্ট’ বলে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করায় বিস্ময় প্রকাশ মুন্নী সাহার বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তির পেছনে যে ৭টি কারণ-বিবিসি বাংলা কক্সবাজারের টেকনাফে অস্ত্রের মুখে পাহাড় থেকে দুই কৃষককে অপহরণ, গুলিবিদ্ধ ৩ বান্দরবানের তুমব্রু সীমান্তে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ হাসিনা সবকিছু ধ্বংস করে গেছে, শূন্য থেকে শুরু করেছি : ড. ইউনূস ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ৭৩ আসামিসহ এখনও পলাতক ৭০০: কারা মহাপরিদর্শক ড. ইউনূসের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতসহ রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠক

যেভাবে হয়েছিল আদানির সাথে ঢাকার বিতর্কিত চুক্তি

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় রবিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০২৪
  • ৩২ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- প্রায় এক দশক আগেকার কথা, চুলচেরা হিসেবে পাক্কা ৯ বছর ছয় মাস। ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার প্রথম বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন নরেন্দ্র মোদী, আর পেয়েছিলেন বিপুল অভ্যর্থনাও। সেবার কেউ তাকে দেশে কালো পতাকা দেখায়নি, বরং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রবল করতালিতে তাকে স্বাগত জানিয়েছিল।

২০১৫ সালের ৭ জুন তারিখে নরেন্দ্র মোদির সেই ঢাকা সফরের শেষ পর্বে দু’দেশ যে যৌথ বিবৃতিটি জারি করে, তার নাম দেয়া হয়েছিল ‘নতুন প্রজন্ম – নঈ দিশা’। বাস্তবিকই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে নানা নতুন গতিপথ বা বাঁকবদলের আভাস ছিল ওই ঘোষণাপত্রে।

৬০টি অনুচ্ছেদের সুদীর্ঘ ওই ঘোষণাপত্রে সবচেয়ে লম্বা ছিল ২৩ নম্বর অনুচ্ছেদটি, যাতে বিদ্যুৎ খাতে দু’দেশের সহযোগিতার রূপরেখা বর্ণনা করা হয়েছিল। সেখান থেকে অংশবিশেষ নিচে তুলে দেয়া যাক :

“বিদ্যুৎ খাতে দু’দেশের সহযোগিতা ও অর্জনের মাত্রায় উভয় প্রধানমন্ত্রীই গভীর সন্তোষ ব্যক্ত করেছেন এবং এই সহযোগিতাকে আরো প্রসারিত করতে সম্মত হয়েছেন। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে প্রধানমন্ত্রী হাসিনার অক্লান্ত প্রয়াসকে এবং ‘২০২১ লক্ষ্য’ (অর্থাৎ ২০২১ সালের মধ্যে ২৪০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা অর্জন) বাস্তবায়নে তার সরকারের নিরন্তর প্রচেষ্টাকে প্রধানমন্ত্রী মোদিও সমাদর করেছেন।”

এতে আরো বলা হয়, ‘প্রধানমন্ত্রী মোদী এই বার্তাও দেন যে এই লক্ষ্য অর্জনে ভারত খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হতে পারে এবং ভারতে এমন বহু কর্পোরেট সংস্থা আছে যারা এই প্রচেষ্টায় বাংলাদেশকে প্রভূত সহযোগিতা করতে পারে।’

এতে আরো ছিল, ‘বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন, সরবরাহ ও বিতরণ খাতে ভারতীয় কোম্পানিগুলোর প্রবেশের পথ যাতে প্রশস্ত হয়, সে জন্যও তিনি প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকে অনুরোধ জানিয়েছেন।’

ঘোষণাপত্রে কোনো ভারতীয় কর্পোরেট সংস্থার নাম উল্লেখ করা হয়নি– কিন্তু বিদ্যুৎ খাতের দু’টি কোম্পানি, আদানি পাওয়ার ও রিলায়েন্সের প্রতিনিধিরাই কেবল সেবার প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী ছিলেন– কাজেই ধরেই নেয়া যেতে পারে নরেন্দ্র মোদি এদের কথাই বুঝিয়েছিলেন।

এর মধ্যে গৌতম আদানির নেতৃত্বাধীন আদানি গোষ্ঠীর প্রস্তাবটি ছিল অভিনব ও দক্ষিণ এশিয়াতে নজিরবিহীন– কারণ তারা ভারতের মাটিতে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করে সেখানে উৎপাদিত বিদ্যুৎ পুরোটাই বাংলাদেশে রফতানি করার কথা বলেছিলেন।

অন্য দিকে অনিল আম্বানির রিলায়েন্স পাওয়ার ৩০০ কোটি ডলার খরচ করে বাংলাদেশে একটি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ার প্রস্তাব দিয়েছিল, যার ক্ষমতা হবে ৩০০০ মেগাওয়াট। বলা হয়েছিল একটি এলএনজি টার্মিনাল গড়ে তোলার কথাও।

নরেন্দ্র মোদির সফরের শেষ দিনেই মুম্বাই স্টক এক্সচেঞ্জে একটি ফাইলিংয়ে রিলায়েন্স পাওয়ার জানিয়েছিল, তারা বাংলাদেশে এ ব্যাপারে ‘মউ’ বা সমঝোতাপত্র স্বাক্ষর করেছে।

যদিও পরে জ্বালানি গ্যাস সরবরাহে অনিশ্চয়তার কারণে রিলায়েন্সের ওই প্রকল্প কখনো দিনের আলো দেখেনি।

আদানি পাওয়ার কিন্তু ‘নতুন প্রজন্ম– নঈ দিশা’ ঘোষণাপত্র জারির ঠিক আট বছরের মাথায় বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রফতানি শুরু করে দেয়।

কিন্তু যে আন্তর্জাতিক চুক্তির অধীনে এই বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয় এবং ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যের গোড্ডায় যে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি সেই বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে থাকে– সেরকম বিতর্কিত চুক্তি বা পাওয়ার স্টেশন এই অঞ্চলে আর একটিও নেই বললেও বোধহয় ভুল হবে না।

আদানি পাওয়ার ও বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের (বিপিডিবি) মধ্যে স্বাক্ষরিত যে পিপিএ (পাওয়ার পারচেজ এগ্রিমেন্ট) বা বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিটি এখন নতুন করে আলোচনায়, তার ভিত কিন্তু রচিত হয়েছিল নরেন্দ্র মোদির সেই ঢাকা সফরেই।

এর আগে পর্যন্ত প্রতিবেশী দেশগুলোতে ভারতের সরকারি বা রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোই শুধু ব্যবসা করার অনুমতি পেত (যেমন রামপালে এনটিপিসি), কিন্তু বাংলাদেশে আদানির জন্য ভারত সেই নিয়মেরও ব্যতিক্রম ঘটায়।

পরবর্তী এক দশকে গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলা ও বাংলাদেশে সেই বিদ্যুৎ বেচার ইতিবৃত্ত কোনও ‘কর্পোরেট থ্রিলারে’র চেয়ে কম রোমাঞ্চকর নয়!

‘মোদানি’ জুটির গ্লোবট্রটিং
গত বছরের শুরুতে হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টে আদানি গোষ্ঠীর বহু আর্থিক কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পর ভারতে পার্লামেন্টের বাজেট অধিবেশনে স্লোগান উঠেছিল, ‘মোদি-আদানি ভাই ভাই, দেশ বেচকে খায়ে মালাই!’

যার অর্থ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আর শিল্পপতি গৌতম আদানির জুটি ভারতকে বিক্রি করে সব ক্ষীর খেয়ে যাচ্ছে!

ওই একই অধিবেশনে কংগ্রেস নেতা ও এমপি রাহুল গান্ধী অভিযোগ করেছিলেন, ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরই ‘আদানি ম্যাজিক’ শুরু হয়ে গিয়েছিল।

নইলে গুজরাটের একজন মাঝারি মাপের শিল্পপতি, ২০১৪ সালেও যার কোম্পানির মোট টার্নওভার ছিল আট বিলিয়ন ডলার, তা মাত্র আট বছরের মধ্যে প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ডলারে কীভাবে পৌঁছতে পারে– সেটাই ছিল রাহুল গান্ধীর প্রশ্ন।

ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষক সঞ্জয় ঝার কথায়, ‘স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে কোনো প্রধানমন্ত্রী ও একজন শিল্পপতির ঘনিষ্ঠতার সম্পর্ক ও সুবিধে পাইয়ে দেয়ার ইতিহাস নিয়ে এত চর্চা হয়নি, যতটা এই দু’জনের ক্ষেত্রে হয়েছে।’

“ভারতের বিরোধী দলগুলো যে এই দু’জনের নাম সন্ধি করে ‘মোদানি’ বলে ডাকে, তা এমনি এমনি নয়!’, বলছিলেন ঝা।

যারা নরেন্দ্র মোদিকে বহু বছর ধরে ফলো করছেন, তারা অবশ্য বলেন, ২০১৪ নয়– নরেন্দ্র মোদি ও গৌতম আদানির মধ্যে এই ঘনিষ্ঠতার সূত্রপাত ২০০১ সালে মোদি যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হন, তখন থেকেই।

এর ঠিক তিন বছর আগে গুজরাটের মুন্দ্রা বেসরকারি পোর্টে আদানি গোষ্ঠী তাদের প্রথম শিপডক তৈরি করেছিল । পরের বছর থেকে তারা নামে কয়লার ব্যবসাতেও।

নরেন্দ্র মোদি মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর এই উদীয়মান গুজরাটি শিল্পপতিকে বিভিন্ন বিদেশ সফরেও নিজের সাথে নিয়ে যেতে শুরু করেন।

আহমেদাবাদের প্রবীণ সাংবাদিক মহেশ লাঙ্গা জানাচ্ছেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী মোদীর ছায়াসঙ্গী হয়ে ওঠেন গৌতম আদানি। মোদি তখন আমেরিকার ভিসা পেতেন না, ফলে সেখানে যাওয়া হয়নি– কিন্তু এছাড়া চীন, জাপান, সিঙ্গাপুর, রাশিয়া সর্বত্রই দু’জনে এক সাথে গেছেন।’

আর এই সব সফরের অব্যবহিত পরেই ওইসব দেশে আদানি গোষ্ঠী বড় বড় প্রকল্পের বরাদ্দ পেতে থাকে কিংবা ব্যবসা শুরু করে, এমন নজির প্রচুর আছে।

নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরেও এই প্রবণতা অব্যাহত ছিল। ২০১৪ সালের মে মাসে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়ার পর প্রথম এক বছরে নরেন্দ্র মোদি যতগুলো বিদেশ সফর করেছেন, প্রায় প্রতিটাতেই গৌতম আদানির উপস্থিতি ছিল অবধারিত। সে কানাডাই হোক বা অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিলই হোক বা জাপান।

হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকা ওই সময় লিখেছিল, মোদির আমেরিকা সফরের সময় নিউ ইয়র্ক প্যালেস হোটেলের যে স্যুইটে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন সেখানে গৌতম আদানিকে বারে বারেই দেখা যেত– যদিও তিনি সরকারি প্রতিনিধিদলের অংশই ছিলেন না।

প্যারিসে ইউনেসকোর সদর দফতরে বা নিউ ইয়র্কে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে নরেন্দ্র মোদি যখন ভাষণ দিয়েছেন– সেখানেও শ্রোতার আসনে গৌতম আদানিকে নজর এড়ায়নি।

শেখ হাসিনা ও গৌতম আদানির মোলাকাত
তবে ২০১৫ সালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর যে ঢাকা সফরে আদানির বিদ্যুৎ বেচার পথ সুগম হয়েছিল, সেখানে অবশ্য গৌতম আদানি বা মোদির আর এক ঘনিষ্ঠ শিল্পপতি অনিল আম্বানি- কেউই সশরীরে হাজির ছিলেন না।

তবে তাদের শিল্পগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা অবশ্যই ছিলেন, যাদের উপস্থিতিতে উভয় গোষ্ঠীর সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের ‘মউ’ স্বাক্ষরিত হয়েছিল।

কিন্তু শেখ হাসিনার সাথে গৌতম আদানির ব্যক্তিগত সম্পর্কও যে পুরোদস্তুর ঘনিষ্ঠ, তা পরে একাধিক ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে।

২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে শেখ হাসিনা যখন ভারত সফরে আসেন তখন দিল্লির বাংলাদেশ দূতাবাসে তার সম্মানে দেয়া সংবর্ধনায় দেশী-বিদেশী অতিথিদের প্রায় ঘণ্টাদুয়েক বাড়তি অপেক্ষা করতে হয়েছিল।

নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে শেখ হাসিনা প্রায় রাত ১০টা নাগাদ দূতাবাসে পৌঁছান– কারণ সন্ধ্যায় তাজ প্যালেস হোটেলে তার স্যুটে এক ভিভিআইপি অতিথি হঠাৎ করেই হাজির হয়ে গিয়েছিলেন। যার নাম গৌতম আদানি।

গৌতম আদানি নিজে এমনিতে সোশ্যাল মিডিয়ায় তেমন একটা সক্রিয় নন।

কিন্তু সে দিন রাতেই তিনি নিজের ভেরিফায়েড এক্স হ্যান্ডল থেকে টুইট করে জানান, “দিল্লিতে বাংলাদেশের মাননীয়া প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে পেরে সম্মানিত। বাংলাদেশের জন্য তার ‘ভিশন’ অনুপ্রেরণাদায়ী, অসম্ভব বলিষ্ঠ!”

মাসতিনেকের ভেতরেই, পরবর্তী বিজয় দিবসেই (১৬ ডিসেম্বর) যে ১৬০০ মেগাওয়াটের গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র তথা বাংলাদেশের জন্য পৃথক ট্রান্সমিশন লাইন ‘কমিশন’ করতে তারা অঙ্গীকারাবদ্ধ, পোস্টে সে কথাও জানান আদানি।

ওই বিজয় দিবসের ‘ডেডলাইন’ অবশ্য রক্ষা করা সম্ভব হয়নি, কিন্তু পরের এপ্রিলে যখন গোড্ডার বিদ্যুৎ অবশেষে সত্যিই বাংলাদেশে যেতে শুরু করল গৌতম আদানি নিজে কয়েক ঘণ্টার জন্য ঢাকায় উড়ে এসে প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে যান।

এর আগে ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে (নরেন্দ্র মোদির সফরের কয়েক মাস পরেই) প্রধানমন্ত্রী হাসিনার আমন্ত্রণে ‘বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড পলিসি সামিটে’ অংশ নিতে ও সেখানে ভাষণ দিতে গৌতম আদানি ঢাকাতেও এসেছিলেন।

পৃথিবীর অজস্র দেশে ব্যবসা ছড়ানো থাকলেও গৌতম আদানি কোনো একটি প্রকল্পের জন্য দু’দুবার সে দেশের সরকারপ্রধানের সাথে ব্যক্তিগতভাবে গিয়ে দেখা করেছেন– এমন আর কোনও নজির জানা নেই।

বছরপাঁচেক আগে দিল্লির গবেষক বিবস্বান সিং ‘তথ্য জানার অধিকার’ বিলকে হাতিয়ার করে একটি নিবন্ধে দেখিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর প্রথম চার বছরে নরেন্দ্র মোদি যে ৫২টি দেশে সফর করেন তার মধ্যে ১৬টি দেশেই আদানি বা আম্বানির কোম্পানি মোট ১৮টি চুক্তি করেছিল।

প্রতিরক্ষা, অবকাঠামো, লজিসটিক্স বা বিদ্যুৎ খাতের এই চুক্তিগুলো হয়েছিল হয় প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময়– কিংবা সফরের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই।

ফ্রান্স, সুইডেন, ইসরায়েল, রাশিয়া, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, ইরান, মোজাম্বিক, চীন, ওমানসহ বিভিন্ন দেশের এই লম্বা তালিকায় যথারীতি বাংলাদেশের নামও আছে। আর তার কারণ আদানি গোষ্ঠীর সাথে তাদের বিদ্যুৎ কেনার সমঝোতা, ও পরে চুক্তি।

বিতর্কের আর এক নাম গোড্ডা
বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে প্রাথমিক সমঝোতা হতে না-হতেই পূর্ব ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যে গোড্ডা শহরের কাছে আদানি পাওয়ার তাদের বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরিতেও ঝাঁপিয়ে পড়ে।

অস্ট্রেলিয়া-ভিত্তিক মনিটরিং গ্রুপ ‘আদানি ওয়াচে’র ওয়েবসাইটে সাংবাদিক পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা তার এক নিবন্ধে বলেছেন, ‘গোড্ডা থার্মাল পাওয়ার প্লান্টের মতো বিতর্কিত ও বেনজির বিদ্যুৎকেন্দ্র ভারতের ইতিহাসে সম্ভবত আর একটিও তৈরি হয়নি।’

এর নির্মাণের প্রতিটি পর্যায়ে যেভাবে দেশের প্রচলিত আইনকানুন, নিয়মরীতিকে সম্পূর্ণ বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নতুন নিয়ম বানানো হয়েছে এবং সব ধরনের সরকারি সুযোগ-সুবিধা আদানি গোষ্ঠীকে পাইয়ে দেয়া হয়েছ – তা বাস্তবিকই চোখ কপালে তোলার মতো!

যেমন, একটি একক বা স্ট্যান্ড-অ্যালোন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হওয়া সত্ত্বেও গোড্ডাকে ‘স্পেশাল ইকোনমিক জোন’ (এসইজেড) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে, যদিও তা ছিল সরকারি নীতিরই পরিপন্থী।

গোড্ডা যে রাজ্যে অবস্থিত, সেই ঝাড়খন্ডের আইন ছিল রাজ্যে কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হলে তার অন্তত ২৫ শতাংশ বিদ্যুৎ রাজ্যের ক্রেতাদের কাছেই বিক্রি করতে হবে। ঝাড়খন্ডে তখন ক্ষমতায় থাকা রঘুবর দাসের বিজেপি সরকার সেই শর্ত থেকেও আদানিকে বিশেষ ছাড় দিয়েছিল।

গোড্ডায় কড়া পরিবেশগত আইন পাশ কাটাতেও আদানি গোষ্ঠীর কোনও সমস্যা হয়নি।

গোড্ডার জন্য কয়লা আসছে সুদূর অস্ট্রেলিয়ায় আদানির কারমাইকেল খনি থেকে প্রায় ৯ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে, তারপরও ভারতে এটি পরিবেশগত ছাড়পত্র পেয়েছে অনায়াসে।

উল্টা সেই আমদানিকৃত কয়লা কাস্টমস ডিউটি থেকেও রেহাই পেয়েছে, পাশাপাশি কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে যে ‘ক্লিন এনার্জি সেস’ দিতে হয় সেটা থেকেও ছাড় পেয়েছে গোড্ডা।

তা ছাড়া গোড্ডা প্লান্টের জমি আদিবাসীদের কাছ থেকে জোর করে দখল করা, এই অভিযোগে প্রথম থেকেই এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ছিল বিতর্কে ঘেরা।

শক্তিশালী আদানি গোষ্ঠী ধীরে ধীরে সাইটের পুরো জমিটা কব্জা করে নিলেও স্থানীয় আদিবাসী মহিলা সীতা মুর্মুর পরিবার ও একজন অবসরপ্রাপ্ত গান্ধীবাদী শিক্ষক চিন্তামণি সাহু নিজেদের জমি দিতে নারাজ ছিলেন দীর্ঘদিন– বহু বছর আদালতে মামলা লড়েও তারা অবশ্য শেষ পর্যন্ত হার মেনেছেন।

সবচেয়ে বড় কথা– শতকরা একশো ভাগ রফতানিমুখী এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ভারতীয় ক্রেতাদের জন্য তৈরি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর যে সহজ শর্তে সরকারি ঋণ পাওয়ার কথা, তাতেও অ্যাকসেস পেয়েছিল অনায়াসেই।

বস্তুত যে ১৭০ কোটি ডলার খরচ করে গোড্ডা প্লান্টটি তৈরি হয়, তার ৭২ শতাংশই এসেছিল ভারত সরকারের মালিকানাধীন দুটি কর্পোরেশন থেকে ঋণের আকারে। যার একটি ছিল পাওয়ার ফিনান্স কর্পোরেশন, অপরটি রুরাল ইলেকট্রিফিকেশন কর্পোরেশন।

এতেই শেষ নয়, গত ৫ অগাস্ট ঢাকায় শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে ভারত সরকার নিয়ম পাল্টে গোড্ডায় উৎপাদিত বিদ্যুৎ ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারেও বেচার অনুমতি দেয়– সম্ভবত এটা আঁচ করেই যে এখন তাদের বাংলাদেশে বিদ্যুৎ বিক্রি করতে বা বকেয়া অর্থ আদায় করতে সমস্যায় পড়তে হবে।

ভারতের কোনো বেসরকারি শিল্প বা কারখানা সরকারের কাছ থেকে এভাবে বছরের পর বছর ধরে বিপুল সুবিধা পেয়ে আসছে এবং তাদের সব ধরনের বিপদ থেকে ‘বেইল আউট’ করে আসছে– সত্যিই এদেশে তার কোনো দ্বিতীয় নজির নেই!

কেন বিতর্কিত এই পিপিএ
গোড্ডার জন্য ভারত সরকারের কাছ থেকে বিপুল আর্থিক সুযোগ-সুবিধা পেলেও আদানি গোষ্ঠী বাংলাদেশে ক্রেতাদের সাথে তা ‘শেয়ার’ করেনি, বিপিডিবি ও আদানি পাওয়ারের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি নিয়ে এটাই প্রধান অভিযোগ।

আদানি পাওয়ার (ঝাড়খন্ড) লিমিটেড ও বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের (বিপিডিবি) মধ্যে এই ‘পাওয়ার পারচেজ এগ্রিমেন্ট’টি স্বাক্ষরিত হয় ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর, যখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি সফর করছিলেন।

আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে কত পরিমাণ বিদ্যুৎ কত দিন ধরে বাংলাদেশে সরবরাহ করা হবে, তার দাম কী হবে এবং কোন কোন শর্তের অধীনে– এগুলোর সব কিছুই ওই চুক্তিতে নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। যদিও চুক্তিটি তখন জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি।

এর অনেক পরে ২০২৩ সালের গোড়ার দিকে অস্ট্রেলিয়া-ভিত্তিক ওয়াচডগ ‘আদানি ওয়াচ’ ১৬৩ পৃষ্ঠার ওই চুক্তিপত্রটি নিয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

ততদিনে অবশ্য সেই চুক্তির বিভিন্ন ধারা নিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে ও বাইরে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়ে গেছে।

ওয়াশিংটন পোস্টের একটি প্রতিবেদনে একজন আন্তর্জাতিক জ্বালানি বিশেষজ্ঞকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছিল, ‘এই চুক্তিটিই এমন যে বাংলাদেশে বাল্ক ইলেকট্রিসিটির যে বাজারদর, তারা সেটার অন্তত পাঁচগুণ বেশি দামে আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনতে বাধ্য হবে।’

২০২২ সালে প্রকাশিত একটি বেসরকারি গবেষণা রিপোর্ট বলেছিল, এই প্রকল্প থেকে বিদ্যুৎ কেনার জন্য বাংলাদেশ আগামী ২৫ বছরে আদানিকে ১১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’ দিচ্ছে– যে পরিমাণ অর্থ দিয়ে সে দেশে তিনটে পদ্মা সেতু বা ন’টা কর্ণফুলী টানেল তৈরি করা সম্ভব।

এই ‘পিপিএ’-তে যে পাঁচিশ বছরের ‘লক ইন পিরিওড’ রাখা হয়েছিল, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন অনেক বিশেষজ্ঞ।

কারণ চুক্তিপত্রে বাংলাদেশ সরকার আদানিকে ‘রাষ্ট্রীয় ও সার্বভৌম গ্যারান্টি’ দিয়েছিল যে পরবর্তী ২৫ বছর ধরে তারা গোড্ডায় উৎপাদিত বিদ্যুতের পুরোটাই কিনে নেবে।

বহু আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞই মনে করিয়ে দিচ্ছেন, আন্তর্জাতিক এনার্জি মার্কেট এতটাই ‘ভালনারেবল’, সেখানে এত বেশি চাহিদা ও দামের ওঠাপড়া থাকে, যার ফলে বেশির ভাগ পিপিএ-তেই ‘লক ইন পিরিওড’ মাত্র কয়েক বছরের রাখা হয়। সেখানেও এই পিপিএ ছিল বিরাট ব্যতিক্রম।

চুক্তিতে এটাও উল্লেখ ছিল যে বিপিডিবি আদানি পাওয়ারকে বিদ্যুতের দাম শোধ করবে মার্কিন ডলারে, যদিও বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট তখন থেকেই শুরু হয়ে গেছে– যা গত দু’এক বছরে আরও গভীর হয়েছে।

‘ফলে সব মিলিয়ে এই চুক্তিটাই এমন, যে হেড বা টেল যাই পড়ুক, জিতবে আদানিই!’, মন্তব্য করেছিলেন সিডনি-ভিত্তিক ক্লাইমেট এনার্জি ফিনান্সের প্রতিষ্ঠাতা টিম বাকলি।

চুক্তির বিতর্কিত ধারাগুলো নিয়ে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার দৈনিক ‘দ্য ডেইলি স্টার’ কথা বলেছিল সাবেক আমলা মিঞাঁ মাসুদউজ্জামানের সাথে, যিনি বিপিডিবি-র তদানীন্তন সচিব হিসেবে চুক্তিপত্রে বাংলাদেশের তরফে সই করেছিলেন।

‘আমার এখন আর কিছু মনে নেই। সব কিছু চেয়ারম্যানের হাত ঘুরেই এসেছিল। আমি ছিলাম শুধু শেষ ধাপ’, ডেইলি স্টারকে বলেছিলেন তিনি।

আর ওই সময় যিনি ডিপিডিবি-র চেয়ারম্যান ছিলেন, সেই খালেদ মাহমুদ বিষয়টি নিয়ে কথা বলতেই অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।

আদানি পাওয়ারের যুক্তি কী?
লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, এই চুক্তির যে সব ধারা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে তার কোনোটি নিয়েই আদানি পাওয়ার আজ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য করেনি বা কোনো প্রেস বিবৃতি দেয়নি।

তবে খুব সম্প্রতি আদানি পাওয়ারের একটি সূত্র নাম গোপন রেখে বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, তাদের সংস্থার বিরুদ্ধে ‘যে সব অভিযোগ তোলা হচ্ছে সেগুলোর কোনও ভিত্তি নেই’– এবং যারা এসব বলছেন ‘আন্তর্জাতিক এনার্জি মার্কেটের গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধেও তাদের কোনো ধারণা নেই’।

তিনি যুক্তি দিচ্ছেন, যে বিদ্যুৎ বাংলাদেশের কাছে বেচা হচ্ছে সেটা হচ্ছে একটা ‘ফিনিশড প্রোডাক্ট’– এবং এর উৎপাদনের কোনও ঝক্কিই বাংলাদেশকে পোহাতে হচ্ছে না।

‘বিদ্যুৎকেন্দ্রটা ভারতের মাটিতে অবস্থিত, তার লগ্নিও সম্পূর্ণ আদানির, এখান থেকে যেটুকু যা দূষণ সেটাও বাংলাদেশকে সামলাতে হচ্ছে না – তারা শুধু তৈরি পণ্যটা কিনছে, যার দাম একটু বেশি হওয়াটাই স্বাভাবিক।’

সাম্প্রতিক অতীতে বাংলাদেশে একাধিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে জ্বালানি কয়লার অভাবে উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে, কিন্তু গোড্ডার ক্ষেত্রে কয়লার ‘সোর্সিং’ ও জোগান যে আদানিরই দায়িত্ব– সে কথাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন তিনি।

উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের গোড়ার দিকে বাংলাদেশে তখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা (ও পরে তথ্য প্রতিমন্ত্রী) মোহাম্মত এ আরাফাত আদানির সাথে করা চুক্তির হয়ে সওয়াল করে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। তাতে তিনি লেখেন :

‘বাংলাদেশের ভেতরে যদি এই বিদ্যুৎকেন্দ্র বানানো হতো তাহলে এই ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে – বিশাল আকারের জমির ব্যবস্থা করতে হতো, কয়লা পুড়ে বাংলাদেশের আকাশে ছড়িয়ে পড়তো, এছাড়াও, সরকারকে পুরো টাকা এককালীন বিনিয়োগ করতে হতো।

অথচ, আমরা ভারতের মাটি ব্যবহার করে, ভারতে কয়লা পুড়িয়ে, ভারতীয় কোম্পানিকে দিয়ে এককালীন পুরো টাকা বিনিয়োগ করিয়ে,এবং বাংলাদেশের ভেতরে এই ১৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ডিজেল, ফার্নেস অয়েল বা আমদানিকৃত এলএনজি দিয়ে উৎপাদন করতে যে খরচ হতো, তার থেকে অনেক কম মূল্যে বিদ্যুৎ বাংলাদেশে নিয়ে আসবো এবং এ দেশের মানুষ সেই বিদ্যুৎ ব্যবহার করবে।’

মোহাম্মদ এ আরাফাত সেই নিবন্ধে আরও লেখেন, ‘কিন্তু এরপরও কিছু মানুষের গাত্রদাহ থেমে নেই!’

আদানি পাওয়ারের সূত্রগুলো এবং বাংলাদেশের তখনকার সরকারের ঘনিষ্ঠরা এই চুক্তির সমর্থনে যে যুক্তিগুলো পেশ করছেন, তার মধ্যে চমকপ্রদ সাদৃশ্য কিন্তু নজর এড়ানোর নয়!
সূত্র : বিবিসি

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions