বিএনপির ঘরের আগুনে রাউজানে ঝরছে রক্ত,গিয়াস কাদের গ্রুপ বেপরোয়া

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪
  • ১৪ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রামের রাউজানের একসময় ‘রাজা’ ছিলেন এবিএম ফজলে করিম। যেখানে তাঁর কথাই ছিল আইন। কারও সঙ্গে দ্বিমত হলেই নেমে আসত নির্যাতনের খড়্গ। সাড়ে ১৫ বছর এভাবে চলার পর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ‘তাসের ঘরের’ মতো ভেঙে পড়ে সাবেক সংসদ সদস্য ফজলে করিমের ‘সাম্রাজ্য’। এলাকাবাসী ভেবেছিল, ফজলে করিম তল্পিতল্পা গোটানোয় এবার হয়তো এলাকায় শান্তি ফিরবে, মিলবে মুক্তি। তাদের সেই আশায় গুড়ে বালি। দৃশ্যপটে এখন আবির্ভূত হয়েছেন তারই চাচাতো ভাই গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী। সঙ্গে আছেন কিছু বিএনপি নেতা। সাবেক বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছোট ভাই এই গিয়াস উদ্দিন। দীর্ঘদিন পর অনুকূল পরিবেশ পেয়েই যেন বেপরোয়া তারা। প্রায় প্রতিদিনই রাউজানের কোনো না কোনো এলাকায় তারা জড়াচ্ছেন নিজেদের মধ্যে গোলাগুলি, মারামারিতে। এভাবে সংঘর্ষে রক্ত ঝরছে রাউজানের জনপদে। তাদের শিকারে পরিণত হচ্ছে সাধারণ মানুষও। নির্বিচারে চলছে চাঁদাবাজিও।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম আকবর খোন্দকারের অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষ লেগেই আছে। মূলত আগামী নির্বাচন সামনে রেখে আধিপত্য বিস্তারেই এই সংঘাত। যদিও সংঘর্ষের জন্য পরস্পরকে দুষছেন তারা। তবে এলাকাবাসী বলছেন, গোলাম আকবর সহ্য করতে পারছেন না গিয়াস উদ্দিনকে। তাঁকে এলাকা থেকে তাড়ানোর অপচেষ্টার জের ধরেই চলছে এই হাঙ্গামা।

জানা যায়, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য হুম্মাম কাদের চৌধুরীও রাজনীতিতে সক্রিয়। তবে তিনি রাউজান নিয়ে তেমন একটা মাথা ঘামাচ্ছেন না। পাশের উপজেলা রাঙ্গুনিয়ায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। ওই আসন থেকে নির্বাচন করতে চান তিনি।

ফজলে করিম ও গিয়াস উদ্দিনকে ইঙ্গিত করে গোলাম আকবর খোন্দকার বলেন, ‘এক ফেরাউনের বিদায় হয়েছে। রাউজানের মাটিতে নতুন কোনো ফেরাউনের জন্ম হতে দেব না। আমি না, খোদ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরাও খুশি হয়ে বলছেন, রাউজানের মাটি থেকে ফেরাউনের বিদায় হয়েছে।’ একই কথা বলছেন গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীও। তিনিও ফজলে করিমের সঙ্গে গোলাম আকবরের মিল রেখে বলেন, ‘রাউজান থেকে আমরা এক ফেরাউনকে বিদায় করেছি। ১৫টা বছর নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করেছি। রাউজানের মাটিতে এখন আর কোনো ফেরাউনের ঠাঁই হবে না।’

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাউজান উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ নেতা এহছানুল হায়দার চৌধুরী বাবুলের একটি অডিও ফাঁস হয়। তাতে ফজলে করিমের নাম উল্লেখ করে তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘রাউজানের মাটি থেকে একজন ফেরাউনের বিদায় হয়েছে।’ মূলত বিএনপি নেতারা এটাকেই সামনে এনে পরস্পরকে ‘নব্য ফেরাউন’ হিসেবে আখ্যায়িত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন।
গেল শনিবার রাউজান ঘুরে দেখা গেছে, উত্তর রাউজানে দাপট রয়েছে গিয়াস উদ্দিনের। দক্ষিণ রাউজানে গিয়াস গ্রুপকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দাপট দেখাচ্ছে গোলাম আকবর গ্রুপ। এই পরিস্থিতিতে উত্তর রাউজান কিছুটা শান্ত থাকলেও দক্ষিণ রাউজান উত্তপ্ত। জানা গেছে, গত তিন মাসে রাউজানে ছোট-বড় ১৮ থেকে ২০টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। দু-একটি ছাড়া সব ঘটনাই ঘটেছে দক্ষিণ রাউজানে। এখন যে পরিস্থিতি, তাতে যে কোনো সময় বড় ধরনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটতে পারে।

রাউজানের নোয়াপাড়ার নিরামিষপাড়া গ্রামেই হয়েছে বেশির ভাগ সংঘর্ষ। এখানে রাত নামলেই শুরু হয় গোলাগুলি। আতঙ্কে ঘর থেকে বের হন না এলাকার মানুষ। গোটা গ্রাম যেন পুরুষশূন্য। গ্রামের মাঝামাঝিতে ‘আছদ আলী মাতব্বরপাড়া সমাজকল্যাণ পরিষদ’ ভবন। সেই ভবনের সামনেই ‘ইনুজা ভবন’। সেই ভবনের দেয়ালে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। রাস্তার ঠিক আরেক পাশে স্থানীয় এক ব্যক্তির লাকড়িঘর। টিনের তৈরি সেই ঘরে ছোট-বড় অসংখ্য ছিদ্র। সেই রক্তের দাগ ও টিনের ঘরের ছিদ্র দেখিয়ে মো. ইদ্রিস নামে এক বৃদ্ধ বলেন, ‘দেখেন, আমরা কেমন আছি। রাত নামলেই গোলাগুলি শুরু হয়। বেশ কিছুদিন ধরেই এমন ঘটছে। স্বাধীনতার পর এলাকায় এমন পরিস্থিতি দেখিনি। ১৪ নভেম্বর রাতে দুই পক্ষের দফায় দফায় গোলাগুলিতে সাধারণ মানুষের রক্ত ঝরেছে।’ সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকা আরেকজন নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘এখানে দুই ব্যক্তির (গিয়াস ও আকবর) শাসনে সাধারণ মানুষ পিষ্ট। দুই পক্ষের মারামারির কারণে সাধারণ মানুষও ঘরে থাকতে পারছে না।’

নিরামিষপাড়ার লোকজন সংঘাতের জন্য বিএনপি নেতা গিয়াস উদ্দিন কাদেরকেই দুষছেন বেশি। গত বুধবার স্থানীয় দয়াময়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন এলাকার নারীরা। স্থানীয় শিরিন আকতার, রীমা আকতার, সখী আকতারসহ কয়েক নারী সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, এলাকায় সংঘর্ষ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য স্থানীয় সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান খায়েজ আহমেদের ছেলে কামাল উদ্দিন দায়ী। কামাল এলাকায় গিয়াস কাদেরের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

জানা গেছে, রাউজানের রাজনীতি অনেকটাই সন্ত্রাসনির্ভর। এলাকায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিবারের ব্যাপক দাপট। সালাউদ্দিনের ফাঁসি হওয়ার পর তাঁর ছোট ভাই গিয়াস উদ্দিন হাল ধরেছেন। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কোমর বেঁধে মাঠে নামেন গোলাম আকবর খোন্দকার। গিয়াস কাদেরের কয়েকজন অনুসারী আকবরের সঙ্গে যোগ দিলে পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়।

রাউজানের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দক্ষিণ রাউজানে চিহ্নিত সন্ত্রাসী ফজল হক এক সময় গিয়াসের সঙ্গে থাকলেও সম্প্রতি তিনি গোলাম আকবরের সঙ্গে সম্পর্ক গড়েন। তিনি এখন দেশের বাইরে থাকলেও তাঁর ছোট ভাই জানে আলম তাঁর হয়ে এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছেন। গিয়াস কাদেরের হয়ে সেখানে আধিপত্য বিস্তার করেন চিহ্নিত সন্ত্রাসী কামাল উদ্দিন, সিএনজি জসিম, বিধান বড়ুয়াসহ আরও কয়েকজন। নিরামিষপাড়াসহ আশপাশের এলাকায় এখন যেসব সংঘর্ষ হচ্ছে, সেগুলো মূলত এই দুই গ্রুপের মধ্যেই ঘটছে। সর্বশেষ গত ১৪ নভেম্বর রাতে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে গোলাম আকবর অনুসারীর ওপর হামলা চালায় গিয়াস কাদের গ্রুপ। অত্যাধুনিক বিভিন্ন অস্ত্র নিয়ে এই হামলা চালানো হয়। এক পর্যায়ে পাল্টা হামলা চালায় গোলাম আকবরের অনুসারীরা। ঘটনার পর থেকেই বেশির ভাগ পরিবারই এলাকা ছেড়েছে। একটি ভিডিও ফুটেজ এসেছে সমকালের হাতে। তাতে মুখোশ পরা ও অস্ত্র হাতে কয়েক সন্ত্রাসীকে গুলি ছুড়তে দেখা যায়। স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, তারা গিয়াসের সমর্থক। একজনের হাতে একটি ওয়ান শুটার গান, একজনের হাতে অত্যাধুনিক পিস্তল ও আরেকজনের হাতে এলজি ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র দেখা যায়। তবে তাদের শনাক্ত করা যায়নি।

গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, ‘আমরা তিলে তিলে রাউজানে বিএনপিকে গড়ে তুলেছি। দলের দুঃসময়ে মাঠে ছিলাম। এ জন্য আমাদের অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। হাসিনা সরকারের পতনের পর গোলাম আকবর খোন্দকার রাতারাতি রাউজানে আধিপত্য বিস্তারে মরিয়া হয়ে উঠেছেন।’ এক সময়ের কয়েকজন চিহ্নিত সন্ত্রাসী গোলাম আকবর খোন্দকার গ্রুপে যোগ দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার কোনো সন্ত্রাসী বাহিনী নেই। আমার নামে মিথ্যাচার করা হচ্ছে, বানোয়াট তথ্য দিয়ে সুনাম নষ্ট করার চেষ্টা করছেন আকবর। তাঁকে মনে রাখতে হবে, এখন তিনি যা শুরু করেছেন, এটা হান্ড্রেড মিটার দৌড় নয়, ম্যারাথন দৌড়। আমরা জুলুম-নির্যাতনের মধ্যেও ১৫ বছর টিকেছি। দেখি, তিনি কতদিন টিকে থাকতে পারেন।’ তিনি বলেন, ‘আকবর কখনও দলের দুঃসময়ে রাউজানে যাননি। গত ৫০ বছরে তাঁকে রাউজানে ভোট দিতে পর্যন্ত দেখা যায়নি। নির্বাচন সামনে রেখে তিনি অশুভ খেলায় মেতে উঠেছেন।’

এদিকে গিয়াসকে ইঙ্গিত করে গোলাম আকবর খোন্দকার বলেন, ‘রাউজানে একজন ফেরাউনের পতনের পর আরেকজন ফেরাউনকে মানুষ মেনে নেবে না। বিএনপি সন্ত্রাসী কার্যক্রমে বিশ্বাস করে না। আর কোনো চাঁদাবাজকে চাঁদাবাজি করতে দেওয়া হবে না।’ তিনি বলেন, ‘আমার কাছে সন্ত্রাসীদের কোনো স্থান নেই। আমি বলব, বিএনপি কিংবা আমার নামে কেউ চাঁদাবাজি করলে যেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে খবর দেওয়া হয়। যারা চাঁদাবাজি-সন্ত্রাসী করবে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ও দলীয়ভাবে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

বিএনপি নেতাকর্মীরা জানান, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক হওয়ার সুবাদে রাউজানের তৃণমূল পর্যায়ে দলের যেসব কমিটি গঠন হয়েছে, সেগুলোতে গোলাম আকবরের অনুসারীদের ঠাঁই হলেও গিয়াস কাদেরের লোকজন তেমন একটা নেই। এ নিয়ে তাদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। এ কারণে উত্তর রাউজানে এসব কমিটির সভাও করতে দিচ্ছেন না গিয়াসের অনুসারীরা। তবে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে দক্ষিণ রাউজানে। বিশেষ করে নোয়াপাড়া ও আশপাশের এলাকায়। জানা যায়, গত ২০ আগস্ট নোয়াপাড়ার পথেরহাট এলাকায় গিয়াস কাদেরের সমর্থকরা পথসভা করেন। এর পর সভা শেষে ফেরার পথে প্রতিপক্ষের ১০-১২ জনকে মারধর করেন। গত ২৮ আগস্ট নোয়াপড়া ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় থেকে আকবরের অনুসারী দুই ছাত্রদল নেতা জয়নাল আবেদিন সোহেল ও সাজ্জাদকে তুলে নিয়ে যায় প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসীরা। পরে মারধর করে, হাত-পা বেঁধে মৃত ভেবে স্থানীয় নদীর চরে ফেলে যায়। বিষয়টি নিয়ে দলের মধ্যে তোলপাড় দেখা দেয়। বিচ্ছিন্নভাবে পাল্টা হামলা চালায় গোলাম আকবরের অনুসারীরাও।
এদিকে, বিএনপির দু’গ্রুপের সংঘর্ষের কারণে বিপাকে রয়েছে পুলিশ। এক গ্রুপের কাউকে গ্রেপ্তার করা হলে সেই পুলিশ কর্মকর্তাকে অপর গ্রুপ বদলি করাতে মরিয়া হয়ে ওঠে। গত শনিবার থানায় গিয়ে দেখা যায়, ওসি নেই। আগে বদলি হওয়া ওসির (তদন্ত) পদে নতুন একজন এসেছেন। তবে তিনি সেদিনও দায়িত্বভার বুঝে নিতে পারেননি। সেকেন্ড অফিসার আলমগীর থানার কার্যক্রম চালিয়ে নিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘বিএনপির দুই গ্রুপ মারামারি করে; কিন্তু ব্যবস্থা নিতে গিয়ে বিপাকে পড়ে পুলিশ। তার পরও পুলিশ নিরপেক্ষভাবে কাজ করে যাচ্ছে।’সমকাল

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions