রাঙ্গামাটি:- রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দীপংকর তালুকদার পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য থাকাকালে রাঙ্গামাটি শহরের চম্পক নগরে বিলাসবহুল বাসভবন ‘দীপালয়’ নির্মাণ করেন। পাঁচ তলাবিশিষ্ট ভবনটি নির্মাণে কয়েক কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। রাঙ্গামাটি শহরের বনরূপায় কল্পতরু কনভেনশন হল নির্মাণেও ব্যয় করেছেন কোটি টাকা। ভারতের কলকাতায় ১০তলা বাড়ি নির্মাণেরও অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুর ও রাজউকের পূর্বাচল নিউ টাউনের দুই জায়গায় ১ কোটি ১৪ লাখ ৪৮ হাজার টাকার ফ্ল্যাট বাড়ি এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) অনন্যা আবাসিক এলাকায় ৩৩ লাখ টাকা মূল্যের ৫ কাঠা জমির মালিক তিনি। দুর্নীতি, অনিয়ম ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে এসব সম্পত্তিসহ হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। সম্প্রতি রাঙ্গামাটির ১০টি উপজেলার একদল পাহাড়ি-বাঙালি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) এসব তথ্যসহ একটি লিখিতভাবে অভিযোগ জমা দেয়।
স্থানীয় দুদক কার্যালয়ের সূত্র জানিয়েছে, অভিযোগকারীরা অভিযোগের একটি অনুলিপি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়েও পাঠিয়েছেন। তবে অভিযোগকারীরা তাদের নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়েছেন।
অভিযোগে বলা হয়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বেপরোয়া হয়ে উঠেন দীপংকর তালুকদার। রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠনের সময় মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে চেয়ারম্যান ও সদস্য মনোনয়ন দিতেন। পরিষদ গঠনের পর নিজের মনোনীত চেয়ারম্যান ও সদস্যদের দিয়ে সরকারি বরাদ্দের টাকা লুটপাট করে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন। প্রায় ৩০ বছরের কাছাকাছি সময় সংসদ সদস্য হিসেবে ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তিনি।
ক্ষমতায় অন্ধ হয়ে নিজ দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, অসদাচরণ, বঞ্চনা, নির্যাতন এমনকি খুনের গুরুতর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও কৃষক লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা অনিল চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যাকে হত্যার অভিযোগে দীপংকর তালুকদারের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল তার পরিবার। ২০১২ সালের ১০ জানুয়ারি অপহরণের শিকার হন বীর মুক্তিযোদ্ধা অনিল চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা। তৎকালীন পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদারের ইন্ধনে অপহরণের পর তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ করেন অনিলের স্ত্রী সান্তনা চাকমা ও ছোট ছেলে নান্টু বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা।
অনিল চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যার স্ত্রী সান্তনা চাকমা বলেন, হত্যা মামলা করার পর দীপংকর তালুকদারের চাপে মামলাটি প্রত্যাহার করতে হয়েছে। পরে আদালত মামলাটি একেবারে খারিজ করে দিয়েছে।
আওয়ামী লীগের বঞ্চিত ও ত্যাগী নেতাকর্মীরা অনেকেই দীপংকর তালুকদারকে ‘ভয়ংকর তালুকদার’ হিসেবে সম্বোধন করেন। গণমাধ্যমের কাছে তিনি ‘অহংকারী দীপংকর’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। জনসংহতি সমিতিসহ বহু পাহাড়ি লোকজন তাকে ‘জাতির কুলাঙ্গার’ হিসেবেও অভিহিত করেন।
গত ১ অক্টোবর দুর্নীতি দমন কমিশনের সচিব বরাবর লিখিত অভিযোগে বলা হয় ২০১৫-২০২৪ সাল পর্যন্ত জেলা পরিষদের চাকরিতে নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে শত কোটি টাকা ঘুষ গ্রহণ করেছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের নামে ওই সময় জেলা পরিষদ থেকে ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। পরিষদের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মচারী বদলি থেকেও ২৫ কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছিলেন দীপংকর তালুকদার। ২০১৫ এবং ২০১৯ সালে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠনে সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যান ও সদস্যদের মনোনয়ন দেওয়ার সময় ৮০ কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছেন বলেও উল্লেখ করা হয় দুর্নীতি দমন কমিশনে জমা দেওয়া অভিযোগে।
এ ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে পার্বত্যবাসীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বরাদ্দকৃত খাদ্যশস্য থেকে ২০১৫ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ২০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন দীপংকর তালুকদার। এতে তাকে সহযোগিতা করেছেন রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা, অংসুই প্রু চৌধুরী, বৃষকেতু চাকমা,পরিষদ সদস্য হাজী মুছা মাতাব্বরসহ জেলা পরিষদের বেশ কয়েকজন সদস্য এবং পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান-সদস্যদের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিয়োগ-বাণিজ্য, উন্নয়ন প্রকল্প ও খাদ্যশস্য থেকে হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে দীপংকর তালুকদারের বিরুদ্ধে।
২০২৪ সালে নির্বাচন কমিশনের কাছে জমা দেওয়া হলফনামায় তার পরিবারের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ দেখিয়েছিলেন ৫ কোটি টাকার ওপরে। ওই হলফ নামায় দেখা যায় দীপংকর তালুকদারের নামে অস্থাবর সম্পত্তি ১ কোটি ৭৭ লাখ ৬৯ হাজার ও নির্ভরশীল ও স্ত্রীর নামে ১০ লাখ ৪৪ হাজার নগদ টাকা। স্ত্রীর নামে ৭৪ লাখ, নিজ নামে ৩৪ লাখ ও নির্ভরশীলদের নামে ৪ লাখ ৭৭ হাজার টাকা ব্যাংকে জমা আছে। সঞ্চয়পত্র, এফডিআর, স্বর্ণালংকার মিলেও কোটি টাকার সম্পদের বিবরণ পাওয়া যায়। রাঙ্গামাটির রাজস্থলী উপজেলার গাইন্দ্যা মৌজায় ২১ একর ৩০ শতক জমি, সদর উপজেলার রাঙাপানি এলাকায় ২ একর ২৩ শতক জমি আরও বেশকিছু জমিজমার মালিক হয়েছেন তিনি।
স্ত্রী-পুত্র, ছোটবোনের জামাই, নিকটাত্মীয়দের নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দোকানের প্লট, বাগান-বাগিচা গড়ে তুলেছেন দীপংকর তালুকদার। স্ত্রী-সন্তানের নামে ব্যাংকে হাজার কোটি রেখেছেন বলেও অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়।
ওই লিখিত অভিযোগ দীপংকর তালুকদারের পাশাপাশি রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা,বৃষকেতু চাকমা, অংসুই প্রু চৌধুরী, রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী মুছা মাতব্বর, সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক রেমলিয়ানা পাংখোয়ার বিরুদ্ধে হাজার কোটি টাকা লুটপাট ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ দেওয়া হয়। দুর্নীতি দমন কমিশনের সচিব ছাড়াও প্রধান উপদেষ্টা, আইন উপদেষ্টা, স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা ও দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান বরাবরে অভিযোগ পত্রের অনুলিপি পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন অভিযোগকারীরা।
এ বিষয়ে জানতে দীপংকর তালুকদারের ব্যবহার করা হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি কোনো জবাব দেননি। তবে তার ঘনিষ্ঠ সহচর রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী মুছা মাতব্বর বলেন, আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে এসব মিথ্যা অভিযোগ এবং মামলা এখন সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। ‘দুর্নীতি দমন কমিশন আমাকে নোটিশ দিয়েছে। আমি নোটিশের জবাব দিয়েছি। দাদাকে (দীপংকর তালুকদারকে) সম্ভবত নোটিশ পাঠানো হয়েছে।’
দীপংকর তালুকদারের দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশনের রাঙ্গামাটি সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক জাহিদ কালাম বলেন, দীপংকর তালুকদােের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগের ভিত্তিতে অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। আমাদের সময়