কেবলই বাড়ছে ওষুধের দাম

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৪
  • ২২ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা সিফাত হ্যাসন। সড়ক দুর্ঘটনায় আহত বড় ভাইয়ের জন্য গত মাসেও স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যথানাশক টেরাক্স ১০ প্রতিটি কিনেছিলেন ১২ টাকায়। চলতি মাসে আরও চার দিনের ওষুধ কিনতে গিয়ে দেখেন, একই ওষুধ এখন ৮ টাকা বেড়ে ২০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। টেরাক্স ১০ মূলত অস্ত্রোপচার-পরবর্তী মাঝারি থেকে তীব্র ব্যথায় ব্যবহার করা হয়। ৫০ পিসের এক বক্স ওষুধের দাম এক মাসের ব্যবধানে ৬০০ থেকে ১ হাজার টাকায় পৌঁছেছে। অল্প সময়ের ব্যবধানে রোগীকে ৪০০ টাকা বেশি দিয়ে কিনতে হচ্ছে।

শতাংশের হিসাবে প্রায় ৪০ শতাংশ দাম বেড়েছে।

শুধু একটি ওষুধ নয়, এসিআইয়ের চুলকানি বা খোস-পাঁচড়ার চিকিৎসায় ব্যবহৃত টেট্রাসল ২৫ শতাংশ সল্যুসনের ৩০ এমএল বোতলের দাম ছিল ৬৮ টাকা, যা বেড়ে এখন হয়েছে ১২৫ টাকা। দাম বেড়েছে ৮৩ দশমিক ৮২ শতাংশ। ইনসেপ্টার অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্টের জন্য ব্যবহৃত উইন্ডেল গ্লাস রেস্পিরেটর সল্যুসনের তিন এমএলের বোতলের দাম ২০ টাকা থেকে বেড়ে ২৫ টাকা হয়েছে। দাম বেড়েছে ২৫ শতাংশ। একই কোম্পানির অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্টের জন্য ব্যবহৃত বুটিকট নেবুলাইজার সাসপেনশন বুডেসোনাইড দুই এমএলের দাম ৪০ টাকা থেকে বেড়ে ৪৫ টাকা হয়েছে। দাম বেড়েছে ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ।

ডায়াবেটিক রোগীর চিকিৎসায় ব্যবহৃত ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সিজ (বিডি) লিমিটেড হিউমুলিন এন ইনজেকশন ৩ মিলি কুইকপেন ৫টির এক প্যাকের দাম ৩ হাজার ৫০০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ৬০০ টাকা। বেড়েছে প্রায় তিন শতাংশ। একই কোম্পানির ডায়াবেটিক রোগীর চিকিৎসায় ইনজেকশন হিউমুলিন আর ৩ মিলি কুইকপেনের দাম ৮৫০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৮৯০ টাকা। দাম বেড়েছে প্রায় ৫ শতাংশ। অপসোনিন ফার্মার গ্যাস্ট্রিকের ট্যাবলেট ফিনিক্স ২০ এমজি প্রতি পিসের দাম ৭ টাকা থেকে বেড়ে ৮ টাকা হয়েছে। দাম বেড়েছে ১৪ দশমিক ২৯ শতাংশ। বায়োফার্মার ট্যাবলেট নিউরেপ ভিটামিন বি১, বি৬ ও বি১২ প্রতি পিস ৬ টাকা থেকে বেড়ে ৮ টাকা হয়েছে। ১০টির এক পাতা ট্যাবলেটের দাম ৬০ থেকে ৮০ টাকা করা হয়েছে। দাম বেড়েছে ৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ। উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ৫০০ টাকা দামের কাভারসিল ৪ এমজির ট্যাবলেট এক পাতা (৩০টি) ৫৫০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। বাইজোরান ৫/২০ (৬০ পিসের বক্স) ট্যাবলেট কিছুদিন আগেও ছিল ৩০০ টাকা। এখন নেওয়া হচ্ছে ৩৬০ টাকা। বাইজোরান ৫/৪০ বক্স ছিল ৫৫০ টাকা, এখন নেওয়া হচ্ছে ৬০০ টাকা। জ্বর-ঠান্ডার এইচ সিরাপ ২৫ টাকা ছিল। বাড়িয়ে করা হয়েছে ৩৫ টাকা। নাপা সিরাপের দামও একইভাবে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। নাপার মতো সাধারণ ওষুধও পাতা ১০ টাকা থেকে ১২ টাকা, নাপা এক্সটেন্ড প্রতি ট্যাবলেট দেড় টাকা থেকে বাড়িয়ে ২ টাকা করা হয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের দাম নিয়েও চলছে স্বেচ্ছাচারিতা। সেফাক্লাভ ৫০০ মিলিগ্রাম প্রতিটি ওষুধের দাম ৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬০ টাকা করা হয়েছে। এক পিস ওষুধে ১০ টাকা করে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। একজন রোগীকে অ্যান্টিবায়োটিকের এক কোর্স সম্পন্ন করতে আগের তুলনায় ৫০০ টাকারও বেশি অতিরিক্ত পরিশোধ করতে হচ্ছে। ভিটামিন জাতীয় ট্যাবলেটের দামও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ৩০টি ট্যাবলেটের বিভিন্ন কৌটা ২৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩৬০ টাকা করা হয়েছে।

গত এক সপ্তাহ সরেজমিন রাজধানীর মিটফোর্ড, বংশাল, নাজিরাবাজার, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকা, শাহবাগ, মোহাম্মদপুর, শ্যামলী ও বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার একাধিক ফার্মেসি ঘুরে ও ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

জানা যায়, ডলারের সঙ্গে টাকার অবমূল্যায়ন, ডলার সংকট, উৎপাদন ব্যয়, প্যাকেজিং মূল্য ও পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে ওষুধের দাম বাড়ানো হয়। অথচ গত তিন মাসের বেশি সময় ধরে দেশের অভ্যন্তরে ডলারের মূল্য স্থিতিশীল রয়েছে। তবুও জীবন রক্ষার ওষুধের দাম শুধু বাড়ছে। প্রেশার, ডায়াবেটিসসহ একেকজন রোগীর ওষুধ খরচ মাসিক ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে। ওষুধ ক্রেতাদের অভিযোগ, নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজারের মতো যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে বাড়ানো হচ্ছে ওষুধের দাম।

ওষুধের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি স্বীকার করেছেন ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও। তাদের ভাষ্যমতে, বিভিন্ন কোম্পানির প্রচলিত ওষুধের দাম সামঞ্জস্য করা হয়েছে। কোম্পানি ভেদে অনেকের দাম তুলনামূলক কম-বেশি ছিল। সেখানে সমন্বয় করা হয়েছে। তবে এই মূল্যবৃদ্ধি পাঁচ থেকে ১০ শতাংশের বেশি করা হয়নি।

পাইকারি ও খুচরা ওষুধ বিক্রেতাদের অভিযোগ, ওষুধের মূল্য নির্ধারণে সরকারের তেমন কোনো ভূমিকা নেই। এই সুযোগে যে যার মতো করে দাম বাড়িয়ে দেয়। দাম বাড়ার কারণে দোকানদারদেরও বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। অনেক সময় ক্রেতাদের সঙ্গে দাম নিয়ে তাদের তর্কবিতর্কও করতে হয়। মোহাম্মদপুর এলাকার কেয়া ফার্মেসির স্বত্বাধিকারী ইমন আহমেদ কালবেলাকে বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যেও কম-বেশি কিছু ওষুধের দাম বেড়েছে। তবে এখন দাম কিছুটা কমই বাড়ছে। দাম বাড়ার কারণে অনেক সময় কাস্টমারদের কাছে আমাদের কৈফিয়ত দিতে হয়। ওষুধ বিক্রি করতে হাজারও প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর জানায়, দেশে প্রায় দেড় হাজারের বেশি এসেনসিয়াল ড্রাগসের (জীবনরক্ষাকারী ওষুধ) ২৭ হাজারেরও বেশি ব্র্যান্ডের ওষুধ উৎপাদন করা হয়। এগুলোর মধ্যে মাত্র ১১৭টি ওষুধের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে দেয় সরকার। অন্য সব ওষুধের মূল্য উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো নিজেরাই নির্ধারণ করে। তবে সে তালিকায় নেই গ্যাস্ট্রিক, হৃদরোগ কিংবা ডায়াবেটিসের মতো নিত্যব্যবহৃত ওষুধ। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইচ্ছামতো মুনাফা করছে ওষুধ কোম্পানিগুলো। তাই ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য নতুন সরকারের নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

জনস্বাস্থ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, ওষুধ হচ্ছে কমার্শিয়াল প্রোডাক্ট। স্বাভাবিকভাবেই দাম বাড়বে। শুধু ওষুধ নয়, সব কিছুর দাম বেড়েছে। কিন্তু সেই দাম কতটা যৌক্তিকভাবে বেড়েছে, সেটাই প্রশ্ন। ওষুধ তো আর চাল-ডালের মতো নয় যে, বেশি দামেরটা না কিনে কম দামেরটা কিনে খাওয়া যায় বা অল্প পরিমাণে খেয়ে থাকা যায়। চিকিৎসক যেভাবে প্রেসক্রাইব করবেন সেভাবেই রোগীকে খেতে হবে। তাই জীবনরক্ষাকারী সব ওষুধকে অত্যাবশ্যক তালিকায় রেখে এগুলোর দামের বিষয়ে সরকারের উচিত হস্তক্ষেপ করা।

তিনি বলেন, ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য যে ধরনের নজরদারি প্রয়োজন, সেটা আমাদের দেশে নেই। এটি না থাকায় কোম্পানিগুলো আইনের নানা ফাঁকফোকর দিয়ে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। অথচ ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ওষুধের দাম নির্ধারণে একটি আলাদা ব্যবস্থাপনা বা অথরিটি আছে। তারা ঠিক করেন কোন ওষুধের দাম কী হবে। কিন্তু আমাদের দেশে ব্যতিক্রম। সবই ঔষধ প্রশাসন করে। ওষুধের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে কমিশন-বাণিজ্য এবং ওষুধের বিজ্ঞাপন খরচ কমিয়ে বাড়তি দাম নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। সব ধরনের ওষুধের মূল্য সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ফর্মুলার ভিত্তিতে নির্ধারণ করতে হবে। এজন্য কঠোর নজরদারি বাড়ানোসহ কার্যকর কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আসরাফ হোসেন বলেন, সম্প্রতি কিছু ওষুধের দাম বৃদ্ধির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে মেক্সিমাম প্রাইসের চেয়ে বেশি বৃদ্ধির সুযোগ দেওয়া হয়নি। ধরুন, বেক্সিমকোর একটা ওষুধের দাম আছে ৮ টাকা। অন্য একটি কোম্পানির একই ওষুধের দাম আছে ৫ টাকা। তারা আবেদন করেছে, ব্যয় মিটিয়ে আমরা পোষাতে পারছি না। আমাদের অন্তত ৬ টাকা মূল্য নির্ধারণ করে দিন। এ রকম তো হতেই পারে। কিন্তু আমরা একই শ্রেণির ওষুধ বাজারে প্রচলিত যা রয়েছে তার চেয়ে বেশি দামে কাউকে বৃদ্ধির অনুমতি দিইনি। ধরুন, এরিস্ট্রোফার্মার ছয় টাকার একটা ওষুধ আছে। একই উপাদান (ইনগ্রিডিয়েন্ট) ব্যবহার করে অপর একটি কোম্পানি চার টাকায় বিক্রি করছে। এখন সে যদি দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করে আমরা তো তাকে এক টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব অনুমোদন করতে বাধ্য। দামটা শুধু সমন্বয় (অ্যাডজাস্টমেন্ট) হয়েছে। তাও আমরা প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছি। এর বেশি বাড়াতে সম্মতি দিইনি।
কালবেলা

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions