আজাদুর রহমান চন্দন:- কোটা সংরক্ষণের দরুন সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান বৈষম্যের বিরোধিতা করে শুরু হওয়া আন্দোলনটির গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেওয়া এবং তা সফল হওয়ার অন্যতম কারণ হলো নানা ধরনের বৈষম্য-বঞ্চনা ও নিপীড়নে বিক্ষুব্ধ বিপুলসংখ্যক মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও সমর্থন।
চাকরিতে কোটা সমস্যার সমাধান আন্দোলন চলাকালেই হয়ে গেছে। কিন্তু আন্দোলন দমন করতে গিয়ে তখনকার সরকার বলপ্রয়োগের যে পথ নিয়েছিল, তার কারণে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ আরও বেড়ে যায়। ফলে চাকরিতে কোটা পদ্ধতির বড় সংস্কার করেও শেষরক্ষা হয়নি শেখ হাসিনার সরকারের। শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনের পর দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে স্বভাবতই মানুষের পাহাড়-সমান প্রত্যাশা। তবে সাধারণ মানুষের মূল চাওয়া হলো সমাজে ও রাষ্ট্রে সব ধরনের বৈষম্য নিরসন। দেশের জনগণের এই প্রত্যাশা নতুন নয়। বহুমাত্রিক বৈষম্যের শিকার হয়েই বাঙালি জনগোষ্ঠী পাকিস্তান আমলে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে এবং শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৩ বছরে অর্থনীতির কিছু সূচকে দেশ অনেক এগোলেও বৈষম্য কি কমেছে?
প্যারিসের ওয়ার্ল্ড ইনইক্যুয়ালিটি ল্যাব প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড ইনইক্যুয়ালিটি রিপোর্ট-২০২২’ অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশের মোট জাতীয় আয়ের ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ মাত্র ১ শতাংশ মানুষের হাতে কুক্ষিগত ছিল। বিপরীতে নিচুতলার ৫০ শতাংশ মানুষের হাতে ছিল মোট আয়ের ১৭ দশমিক ১ শতাংশ। অথচ ১৯৮১ সালেও দেশে জাতীয় আয়ের ১১ দশমিক ৮ শতাংশ ছিল ১ শতাংশ মানুষের হাতে, আর নিচুতলার ৫০ শতাংশ মানুষের হাতে ছিল সম্পদের ২০ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানার আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২ অনুযায়ী, দেশের সবচেয়ে বেশি ধনী ৫ শতাংশ মানুষের হাতে এখন দেশের মোট আয়ের ৩০ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ পুঞ্জীভূত।
অন্যদিকে সবচেয়ে দরিদ্র ৫ শতাংশ মানুষের আয় দেশের মোট আয়ের মাত্র দশমিক ৩৭ শতাংশ। অথচ খানার আয় ও ব্যয় জরিপ ২০১০ অনুযায়ী, দেশের আয়ে সবচেয়ে ধনী ও সবচেয়ে গরিব ৫ শতাংশের ভাগ ছিল যথাক্রমে ২৪ দশমিক ৬১ ও শূন্য দশমিক ৭৮ শতাংশ। অর্থাৎ গত এক যুগে দেশের মোট আয়ে ৫ শতাংশ ধনীর ভাগ যখন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে, সবচেয়ে দরিদ্র ৫ শতাংশের ভাগ তখন আগের চেয়ে কমে অর্ধেক হয়েছে। দেশের সম্পদ যে কিছু বিশেষ গোষ্ঠীর হাতে পুঞ্জীভূত হচ্ছে তা ক্রেডিট সুইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের দেওয়া তথ্য থেকেও বোঝা যায়। ওই তথ্যমতে, দেশে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি পরিমাণের সম্পদ আছে ২১ ব্যক্তির কাছে। গত এক যুগে অর্থনৈতিক সংকট ও ব্যাপক মূল্যস্ফীতির মধ্যে যখন দেশের বেশির ভাগ মানুষ দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতে হিমশিম খেয়েছে, তখনো দেশের ব্যাংকগুলোতে কোটিপতি হিসাবধারীর সংখ্যা বেড়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো, এই আয়বৈষম্য কমাতে অন্তর্বর্তী সরকার গত তিন মাসে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে? নাকি সংবিধান না পাল্টিয়ে আয়বৈষম্য কমানো সম্ভব নয়? নীতিনির্ধারকদের কথাবার্তা ও কাজকর্ম দেখেই এমন প্রশ্ন মাথায় এল। কারণ, অন্তর্বর্তী সরকার ইতিহাস-ঐতিহ্য, নানা আদর্শিক চিন্তা-চেতনা, দিবস ও সংবিধান নিয়ে টানাটানিতেই বেশি ব্যস্ত বলে মনে হচ্ছে। এসব জটিলতা এড়িয়েও যে বৈষম্য নিরসন সম্ভব, সে কথাটি কে কাকে বোঝাবে? এ প্রসঙ্গে বলা দরকার যে বিগত বছরগুলোয় সব স্তরের সরকারি চাকুরেদের বেতন-ভাতা যে হারে বেড়েছে, বেসরকারি খাতের চাকরিজীবীদের আয় সে হারে বাড়েনি।
আর কৃষিজীবী-শ্রমজীবী মানুষের অবস্থা তো আরও শোচনীয়। সরকারি চাকরিজীবীদের একটি অংশ আবার নামমাত্র মূল্যে রেশনসুবিধাও পেয়ে আসছে। অথচ উৎপাদনমূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ দামে সর্বজনীন ও স্থায়ী রেশনব্যবস্থা চালু করে সহজেই আয়বৈষম্য কমানো সম্ভব। এর ফলে সংশ্লিষ্ট পণ্যগুলোর ক্ষেত্রে বাজারে সিন্ডিকেট বানানোরও প্রয়োজনীয়তা থাকবে না। এ ছাড়া শাকসবজিসহ কাঁচা পণ্য বিক্রির জন্য সারা দেশে বিনা টোলে কৃষকের হাট চালু করে ওইসব পণ্যের বাজারও সহনীয় রাখার সুযোগ আছে। কিন্তু আগের মতোই সহজ সমাধানের দিকে নজর নেই কর্তৃপক্ষের।
দেশে এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, যেখানে জনগণের কাছ থেকে সংগ্রহ করা অর্থ কারখানার মালিক ও ব্যবসায়ীদের জন্য বিভিন্ন অবকাঠামো ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ার কাজে ব্যয় করা হলেও তার বিনিময়ে কারখানার মালিক ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে যথাযথভাবে প্রত্যক্ষ কর আহরণ করা হয় না। শিল্পমালিক ও ব্যবসায়ীরা শ্রমিকদের স্বল্প মজুরি দিয়েই ব্যবসা-উৎপাদন চালিয়ে যেতে পারেন। তাঁরা কর্মস্থলের নিরাপত্তার পেছনেও যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করতে নারাজ।
উল্টো তাঁরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কিংবা আমদানি-রপ্তানির নামে লুটপাট ও বিদেশে অর্থ পাচার করছেন দেদার। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে হলে এই অর্থনৈতিক কাঠামোতে পরিবর্তন আনা জরুরি। ধনিক শ্রেণির কাছ থেকে প্রত্যক্ষ কর আহরণ বাড়াতে হবে, অন্যদিকে শুল্ক ও ভ্যাটের নামে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে পরোক্ষ কর আহরণ কমাতে হবে। শ্রমজীবী মানুষের জন্য জাতীয় ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়ন করতে হবে। করব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে এবং জাতীয় ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়ন করতেও সংবিধান নিশ্চয়ই কোনো বাধা সৃষ্টি করে না!
দেশে সরকারি প্রাথমিক শিক্ষা বিনা মূল্যে পাওয়ার সুযোগ থাকলেও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার মান, শিক্ষকের মান ও সংখ্যা, শিক্ষার উপকরণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে গ্রাম ও শহরের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য বিদ্যমান। বাংলাদেশ ব্যুরো অব এডুকেশনাল ইনফরমেশন অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিকসের (ব্যানবেইস) ২০২৩ সালের তথ্যমতে, প্রাথমিকে ভর্তির হার ৯৮ শতাংশ হলেও মাধ্যমিকে ঝরে পড়ে প্রায় ৩২ দশমিক ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী।
উচ্চমাধ্যমিক থেকে ঝরে পড়ে আরও ২১ দশমিক ৫১ শতাংশ। ব্যাপক ব্যয়বহুল হওয়ায় শিক্ষা ক্রমেই সাধারণ মানুষের সামর্থ্যের বাইরে চলে গেছে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে অপ্রতুল বরাদ্দ, আর ক্রমাগত বাণিজ্যিকীকরণের কারণে দেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বৈষম্য বেড়েছে। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ যথাক্রমে জিডিপির ১ ও ২ শতাংশের কম।
অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সুপারিশ অনুসারে, সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হলে স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ৪-৫ শতাংশ বরাদ্দ থাকা দরকার। জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থার (ইউনেসকো) পরামর্শমতে, জিডিপির ৪-৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা উচিত। বাংলাদেশে জিডিপির অনুপাতে এই দুটি অতিগুরুত্বপূর্ণ খাতে বরাদ্দ এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। সামনের অর্থবছরে এই দুই খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর কোনো ঘোষণা এখনো দেয়নি অন্তর্বর্তী সরকার।
দ্রুত বিদ্যুৎ পাওয়ার আশায় বিগত সরকার ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলভিত্তিক রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনে বেশি মনোযোগ দেওয়ায় জ্বালানি বাবদ বাড়তি খরচ মেটাতে দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছিল। বিত্তবানদের কাছে এই ব্যয়ের বোঝা ততটা ভারী না হলেও সাধারণ মানুষের তাতে নাভিশ্বাস ওঠে। অথচ কম সময়ে, কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ আগেও ছিল, এখনো আছে। বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সবচেয়ে সম্ভাবনাময় উৎস হচ্ছে সৌরশক্তি।
তবে ভূমির প্রাপ্যতা বেশি হওয়ায় দেশে বড় আকারের সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা কঠিন। সে তুলনায় গ্রিডে সংযুক্ত বিভিন্ন স্থাপনার ছাদে সোলার সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন অনেক সহজ। রুফটপ সোলার ও জাতীয় গ্রিডের সমন্বিত ব্যবস্থার প্রসার ঘটাতে নেট মিটারিং সহজলভ্য করার বিকল্প নেই। কিন্তু তেমন কোনো উদ্যোগ এখনো দৃশ্যমান নয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের একটি আলোচিত পদক্ষেপ হলো পলিথিনবিরোধী কঠোরতা। এতেও কিন্তু বৈষম্য কমার বদলে বেড়েছে। এত দিন সুপারশপসহ বড় মুদির দোকানে কেনাকাটা করলে বিনা মূল্যে এক বা একাধিক বড় ব্যাগ পাওয়া যেত। এখন ক্রেতাদের চড়া দামে কিনতে হচ্ছে নিম্নমানের চটের ব্যাগ। এ নিয়ে তাঁদের ক্ষোভের অন্ত নেই। অথচ পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটের পলিমার দিয়ে তৈরি ‘সোনালী ব্যাগ’ উৎপাদন ব্যাপক হারে বাড়িয়ে বাজারে তা সহজলভ্য করা হলে কঠোর অভিযান ছাড়াই পলিথিন ব্যবহার বন্ধ করা সম্ভব। কিন্তু সংবিধান পাল্টানো নিয়ে যত তোড়জোড়, তার ১ শতাংশও দেখা যায় না ‘সোনালী ব্যাগ’ উৎপাদন বাড়ানো নিয়ে।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক