ডেস্ক রির্পোট:- অভিজ্ঞতা ছাড়াই অদৃশ্য ‘জাদুর কাঠি’র বলে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) থেকে ৮ হাজার ৬৫০ কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স (এনডিই)। তারা সড়কে কমপক্ষে ১৫৫টি কাজ পেয়েছে মাত্র ৬ বছরে। সওজে স্বল্পসময়ে বেশি কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি এনডিই। সম্প্রতি তাদের অনিয়ম, টেন্ডার জালিয়াতিসহ নানা অনিয়ম ও মানি লন্ডারিংয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। কমিশন বিষয়টি আমলে নিয়ে
প্রাক-অনুসন্ধান শুরু করেছে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।
এনডিই অভিজ্ঞতা ছাড়াই কোন জাদুর বলে এত কাজ পেত জানতে চাইলে সওজের এক প্রকৌশলী জানান, ঠিকাদারি কাজ পেতে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করত এনডিই। তাদের বড় বড় কাজ দিতে ওবায়দুল কাদের সরাসরি নির্দেশ দিতেন। প্রতিষ্ঠানটির ব্যাপক প্রভাব বিস্তারের নেপথ্যে ছিলেন শেখ হাসিনা সরকারের সাবেক সামরিক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক, শেখ হাসিনার আত্মীয় ববি সিদ্দিকী ও সংসদের সাবেক চিফ হুইপ নূরে আলম চৌধুরী লিটন। এনডিইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রায়হান মোস্তাফিজ সাবেক চিফ হুইপ নূরে আলম চৌধুরী লিটনের ভায়রা। সেই সুবাদে আওয়ামী লীগ সরকারের শেষদিকে সড়কে একক রাজত্ব কায়েম করে এনডিই। তাদের কাজ না দিলে কর্মকর্তাদের সরকারের রোষানলে পড়তে হতো।
দুদকে জমা হওয়া অভিযোগে বলা হয়েছে, সওজের ঠিকাদারি কাজে বিস্ময়কর নাম ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড বা এনডিই। ২০১৭ সালের শেষদিকে প্রতিষ্ঠানটি সড়কে ঠিকাদারি শুরু করে। মাত্র ৬ বছরে তারা সড়কে একক ও যৌথভাবে ৮ হাজার ৬৫০ কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে নেয়, যা সওজের মোট ঠিকাদারি কাজের ১০ শতাংশ।
সওজের বরাত দিয়ে অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, ২০১১-১২ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত সওজে ১৫টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মোট ঠিকাদারি কাজের ৯০ শতাংশ করানো হয়। এই সময়ে সড়ক ও সেতু নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণে ৮৩ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় করেছে সরকার, যার মধ্যে প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি কাজ একক ও যৌথভাবে পেয়েছে মাত্র ১৫টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সর্বাধিক ১১ হাজার ১১৮ কোটি কোটি টাকার কাজ করেছে হাসান টেকনো বিল্ডার্স। তাদের কাজের সংখ্যা ৫৬৩। অপরদিকে ১০ হাজার ৯৯৫ কোটি টাকার ৫২৬টি কাজ করেছে রানা বিল্ডার্স। ৮ হাজার ৬৫০ কোটি টাকার ১৫৫টি বড় কাজ করে আর্থিক দিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে এনডিই। ১ হাজার ৩০৯টি কাজ করে মোজাহার এন্টারপ্রাইজ পেয়েছে ৬ হাজার ৫৩১ কোটি টাকা। মঈনদ্দিন (বাঁশি) পেয়েছে ৬ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকার ৭০২টি কাজ। তাহের ব্রাদার্স ১৫৭ কাজে পেয়েছে ৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকার। মো. আমিনুল হক (প্রা.) লিমিটেড ৩ হাজার ৮৯৪টি কাজ পেয়ে ৪ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা নিয়েছে। মাসুদ হাইটেক ১৬০টি কাজ করে নিয়েছে ৪ হাজার ৩৮১ কোটি টাকা। স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স ৫১টি কাজ পেয়ে ৪ হাজার ৯৩৩ কোটি টাকা পেয়েছে। এমএস সালেহ আহমেদ ১৭১টি কাজ করে পেয়েছে ২ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা। এমএম বিল্ডার্স পেয়েছে ২ হাজার ৮২৩ কোটি টাকার ৬৫টি কাজ। সমানসংখ্যক কাজ করে ২ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা পেয়েছে রিলায়েবল বিল্ডার্স। তমা কনস্ট্রাকশন ৫৯ কাজে পেয়েছে ২ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা। মাহফুজ খান লিমিটেড ১৭৬টি কাজে পেয়েছে ২ হাজার ২৮২ কোটি টাকা। আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন ১ হাজার ৯৩১ কোটি টাকা ব্যয়ের ১ হাজার ৭০০টি কাজ করেছে। এগুলো ছিল সড়কে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হওয়া মোট কাজের প্রায় ৯০ শতাংশ। ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২৪ পর্যন্ত সওজে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে ৪০ হাজার ২৩২টি। এর মধ্যে প্রায় ৩৬ হাজার ৫০০টি দরপত্র ছিল ১ লাখ থেকে এক কোটি টাকার মধ্যে। এসব দরপত্রে ব্যয় হয় ৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। আর ৪ হাজার দরপত্রের মূল্য ছিল ১ কোটি টাকা থেকে ৫০০ কোটি টাকা বা তারও বেশি। মূলত এই বড় কাজগুলোতেই জালিয়াতি, অনিয়ম ও প্রভাবশালীদের তদবির হয়েছে বেশি।
অভিযোগের তথ্যমতে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এনডিই ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে নেওয়ার পর নিম্নমানের কাজ করে টাকা তুলে নিত। বেশি কাজ দেখিয়ে বাড়তি বিল আদায়ের অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। গত ৬ বছরে শেখ পরিবারের ঘনিষ্ঠতার সুযোগ ব্যবহার করে হাজার হাজার কোটি টাকার কাজ করে নিয়েছে তারা। অভিযোগে আরও বলা হয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে প্রতিহত করতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের প্রচুর অর্থের জোগান দিয়েছেন এনডিই। তাদের কর্মকর্তাদের লাইসেন্সকৃত অস্ত্র দিয়ে বডিগার্ড নামে ক্যাডার বাহিনী দিয়ে গুলশান-বনানী ও বারিধারা এলাকায় আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালিয়েছে। এরা আবার বিএনপি নেতাসহ বিভিন্ন মহলকে ম্যানেজের মাধ্যমে নতুন করে বড় বড় কাজ বাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এনডিই রেডিমিক্সও বড় জালিয়াতি করেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমান থেকে পাথর এবং চীন থেকে রেডি মিক্সড সরঞ্জাম আনে। ওইসব আমদানিতে দর কম দেখিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠাত। এর মাধ্যমে প্রচুর অর্থ বিদেশে পাচার করেছে।
সওজে কাজের অনিয়ম প্রসঙ্গে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিগত সরকারের সময়ে কোন ঠিকাদারি কাজ কাকে দেওয়া হবে, সেটা আগে থেকেই নির্ধারণ করা হতো। দরপত্র ডাকা ছিল আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। এমনটি আর চলবে না। প্রতিযোগিতা বাড়াতে আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের কাজ চলছে। আগে যারা অনিয়ম-দুর্নীতি করেছে, তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দুদকের মহাপরিচালক জানান, সওজের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তারা কিছু কাজও শুরু করে। পরে বিগত সরকারের সময় নানামুখী চাপে কমিটির কার্যক্রম বেশিদূর এগোতে পারেনি। এখন দুদক যখন যে অভিযোগ পাচ্ছে, সেটা আমলে নিয়ে তদন্ত করছে। আর প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দুর্নীতি তদন্তের জন্য কমিটি করার বিষয়ে আলোচনা পর্যালোচনা চলছে।
প্রভাব খাটিয়ে কাজ নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে এনডিইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রায়হান মুস্তাফিজ বলেন, আমরা শেখ পরিবারসহ বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলকে ম্যানেজ করে কাজ নিয়েছি কি না সেটা আপনারা তদন্ত করে দেখুন। আমি যদি বলি না, আমরা কাউকে ম্যানেজ করিনি, সেটা বলা যেমন ঠিক হবে না, তেমনি প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করেছি এটাও বলতে পারব না। কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম থাকলে শুধু কি আমরা দায়ী? সওজের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী, টেন্ডার কমিটিসহ আরও যারা আছেন সবাই দায়ী। তিনি আরও জানান, এনডিই ১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। আগে গণপূর্ত অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন দপ্তরে কাজ করে। ২০১৭-১৮ সাল থেকে সড়কে কাজ শুরু করে দ্রুততম সময়ে ৮ হাজার ৬৫০ কোটি টাকার কাজ করে।