ডেস্ক রির্পোট:- ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পালিয়ে দিল্লিতে যাওয়া শেখ হাসিনার ষড়যন্ত্র থেমে নেই। হিন্দুত্ববাদী ভারতের আশ্রয়ে থেকে তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে একের পর এক ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছেন। হাসিনার তিন নম্বর টেলি সংলাপের অডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের স্থানীয় এক নেতার সাথে কথোপকথনে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমি কাছাকাছি আছি শিগগিরই আসব।’ ‘জামায়াত-বিএনপি ঘরে আগুন দিচ্ছে’ আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা এমন বক্তব্যের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যারা আগুন দিচ্ছে তাদের বাড়িঘর রয়েছে, সেগুলো ঠিক থাকে কিভাবে? তোমরা কি করো, সব কিছু বলে দিতে হয়?’ হাসিনা বিএনপি-জামায়াত নেতাদের তালিকা করার নির্দেশ দেন এবং বলেন, ‘আমি কাউকে ছাড়ব না’।
এদিকে ইসকনের ব্রেনচাইল্ড ‘সংখ্যালঘু নির্যাতন’ ইস্যু মাঠে মারা যাওয়ার পর শেখ হাসিনার ইন্ধনে গত শুক্রবার চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে আট দফা দাবিতে গণসমাবেশ করেছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সংগঠন বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চ। হঠাৎ করে গজিয়ে উঠা এই সংগঠন হুমকি দিয়েছে জেলা-উপজেলায় সমাবেশের পর ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ করে সব কিছু অচল করা হবে। দিল্লির আশ্রয়ে থাকা শেখ হাসিনা যখন একের পর এক ষড়যন্ত্র করছেন বাংলাদেশের অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টায়; তখন হঠাৎ করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পদ প্রেসিডেন্ট মোঃ সাহাবুদ্দিনকে পদচ্যুত করা ইস্যু হাজির করা হয়েছে। ব্যক্তিগত সম্পর্কের সূত্র ধরে একজন সিনিয়র সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট মোঃ সাহাবুদ্দিনের একান্ত কথোপকথন (কাণ্ডজ্ঞানহীনতা নাকি হিরো হয়ে যাওয়ার চেষ্টা!) প্রকাশ করায় মূলত এই ইস্যুর উদ্ভব ঘটে। ‘প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র প্রেসিডেন্টের হাতে নেই’-এই খবর প্রচার করায় তোলপাড় শুরু হয়। দিল্লি ও হাসিনার তাঁবেদার গণমাধ্যমগুলো মওকা পেয়ে যায়। হাসিনা যখন ড. মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপদে ফেলতে একের পর এক ষড়যন্ত্রের কার্ড ছুড়ছেন, তখন প্রেসিডেন্ট পদ থেকে মোঃ সাহাবুদ্দিনকে সরানো সাংবিধানিক সংকট দেখা দিতে পারে; যা নতুন করে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করবে। বিশেষ করে প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ করা হলে সাংবিধানিক সংকট নিয়ে হাসিনা নতুন কোনো ষড়যন্ত্রের ঘুঁটি চালাতে পারে সে আশঙ্কায় দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল বিএনপি ‘প্রেসিডেন্ট পদচ্যুত ইস্যু’ নিয়ে সাংবিধানিক সংকট ইস্যু ওপেন করতে চাচ্ছে না। দলটির নেতা তারেক রহমানের এমন অবস্থান রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচায়ক। দেশের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, সাবেক বিচারপতিরাও মনে করেন প্রেসিডেন্ট পদচ্যুত ইস্যুতে বিএনপির অবস্থান খুবই সুচিন্তিত। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, হঠাৎ গজিয়ে ওঠা জাতীয় নাগরিক কমিটি (বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব হাতছাড়া হয়ে যাওয়া কিছু সিনিয়র নেতা, এদের বেশির ভাগ নুরুল হক নূরের গণঅধিকার পরিষদের নেতা) প্রেসিডেন্ট পদ থেকে মো: সাহাবুদ্দিনকে অপসারণে কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন। এই ইস্যুতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের সঙ্গে বৈঠক করছেন। মোঃ সাহাবুদ্দিনের অপসারণ ইস্যুতে অন্তর্বর্তী সরকারকে কোনো হঠকারি সিদ্ধান্ত না নেয়ার আহ্বান জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘এই মুহূর্তে দেশে সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি হয় এমন কোনো হঠকারি সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হবে না।’ কিন্তু জামায়াত প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দিনকে পদচ্যুত করার পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছেন। অনেকটা গ্রাম্য প্রবাদের মতো ‘অল্প পানির মাছ বেশি পানিতে পড়লে যেমন লাফালাফি বেড়ে যায়, তেমনি চাওয়ার থেকে অতিরিক্ত পেলেই মানুষের অহঙ্কার বেড়ে যায়!’ অবস্থা। ফ্যাসিস্ট হাসিনা দলটির নিবন্ধন বাতিল করেছিল এমনকি পতনের আগে দলটিকে অন্যায়ভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। নিষিদ্ধ থেকে বের হয়ে এসে দলটির নেতারা অনেকটা বেপরোয়া হয়ে উঠে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র জাসদ থেকে জামায়াতে যোগদান করা এবং মেডিকেল কলেজ ব্যবসায়ী দলটির আমির রাজনৈতিক তৎপরতায় যেন একাই একশ হয়ে উঠেছেন।
কিন্তু নেতৃত্বে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ধীরস্থির। বিদেশে থাকলেও তিনি এখন আর স্রোতে গা ভাসানো নেতা নন। নেতৃত্বে দৃঢ়-অবিচল থেকেই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা হিসেবে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েই প্রেসিডেন্ট মোঃ সাহাবুদ্দিনকে ফ্যাসিস্ট হাসিনার দোসর মনে করলেও দেশে নতুন করে সংবিধানিক সংকট সৃষ্টি হোক, তেমন পরিস্থিতি এড়াতে চাচ্ছেন। তিনি সংবিধান বিশেষজ্ঞ, সাবেক বিচারপতি, দলের কেন্দ্র থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেই নির্মোহ, সাহসিকতা, ধৈর্য্য, সহনশীলতা প্রদর্শন করেই এই মুহূর্তে প্রেসিডেন্টকে অপসারণের উদ্যোগে সাড়া দিচ্ছেন না। দিল্লিতে বসে হাসিনা যখন একের পর এক ষড়যন্ত্রের কার্ড ছুড়ছেন, ‘হাসিনার ফাঁদ’ বুঝে না বুঝে অনেকেই প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দিনকে পদচ্যুত করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন, তখন হাসিনার কূটকৌশল বুঝতে পেরে অতি বিচক্ষণতার সাথে ‘এখনই প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দিন পদচ্যুত নয়’ কৌশলে হাঁটতে শুরু করেন তারেক রহমান। বিএনপির এমন সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, রাজনৈতিকভাবে তারেক রহমান যুগের চাহিদা পূরণের জন্য এতদিন বিদেশে থেকেই যে প্রস্তুতি নিয়েছেন এটি তারই প্রতিফলন। দীর্ঘদিন লন্ডনে থেকে শিক্ষা-প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উচ্চস্তরের জ্ঞানার্জন করেছেন। হিন্দুত্ববাদী ভারত ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির মারপ্যাচ পর্যবেক্ষণ করেই তিনি অগ্রসর হচ্ছেন। জাতিসংঘের কার্যাবলি, আন্তর্জাতিক শান্তি-সম্প্রীতি-সংহতি ইত্যাদি বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করার কারণে তিনি এখন স্রোতে গা ভাসানোর মতো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেন না। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দলের নেতা হিসেবে তিনি সাংবিধানিক সংকটের সৃষ্টি করে হাসিনাকে ইস্যু দিতে চাচ্ছেন না। সে জন্যই বিএনপি এখন অপছন্দের ব্যক্তি সাহাবুদ্দিনকে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরানোর কৌশলের বিরোধিতা করছে।
এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা গত ২৬ অক্টোবর মোঃ সাহাবুদ্দিনের অপসারণ ইস্যুতে বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করেছেন। রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিএনপি তাদের আশঙ্কার কথা তুলে ধরেছে। এর আগে ২৩ অক্টোবর বিএনপির নজরুল ইসলাম খান, সালাহউদ্দিন আহমেদ ও শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে কোনো সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি না করার কথা জানিয়েছেন। এ মুহূর্তে প্রেসিডেন্ট পদে শূন্যতা তৈরি হলে সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সংকট দেখা দেবে এবং হাসিনা তা লুফে নেবে, সেটি বিএনপি চায় না। ২৬ অক্টোবর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও জাতীয় নাগরিক কমিটি আহ্বায়ক নাসিরুদ্দিন পাটোয়ারী, সদস্য আকতার হোসেনসহ সাতজন নেতা বিএনপির সঙ্গে একই ইস্যুতে বৈঠক করেন। এর আগে গত ২৪ অক্টোবর একই ইস্যুতে আলোচনা করতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদের বাসায় যান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা। পরে সেখানে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীও যোগ দেন।
বিএনপি নেতাদের সঙ্গে দুটি বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা প্রেসিডেন্ট পদ থেকে মোঃ সাহাবুদ্দিনকে সরানোর দাবির পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। তাদের যুক্তি হচ্ছে, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের দালিলিক প্রমাণ নেই বলে প্রেসিডেন্ট মোঃ সাহাবুদ্দিন যে বক্তব্য দিয়েছেন, এরপর তিনি প্রেসিডেন্ট পদে থাকার নৈতিকতা হারিয়েছেন। তাকে সরানো না হলে অন্তর্বর্তী সরকার প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাবে। সে জন্য তারা আলোচনার মাধ্যমে তাদের দাবির পক্ষে রাজনৈতিক দলগুলোকে বোঝাতে চাইছেন। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট মোঃ সাহাবুদ্দিনের প্রতি বিএনপির কোনো সহানুভূতি নেই কিন্তু তাকে সরানোর চেষ্টার পেছনে অন্য কোনো যড়যন্ত্র আছে কি-না, অথবা সরানোর পর কী পরিস্থিতি হতে পারে, এসব নিয়ে সংশয় আছে বিএনপিতে।
গতকাল যুবদলের ৪৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে মরহুম শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এই মুহূর্তে দেশে সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি হয় এমন কোনো হঠকারি সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হবে না। বিএনপির সর্বোচ্চ ফোরাম রয়েছে, সেখানে এ নিয়ে আলোচনা হবে। কোনোরকম হঠকারি সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। প্রয়োজন অতি দ্রুত নির্বাচনকেন্দ্রিক সংস্কার শেষে নির্বাচন করা। একটি সাংবিধানিক রাজনৈতিক শক্তির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
গত ২৬ অক্টোবর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেন, আমরা সবাই জানি এই প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দিন ফ্যাসিবাদের প্রোডাক্ট। তবে দেশে যাতে কোনো সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি না হয় এ জন্য অনেক চিন্তা করে কাজ করতে হবে। দুনিয়া কাঁপানো বিপ্লবের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে তারা নিশ্চয়তা দেবে একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের। নিঃসন্দেহে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের একজন কৃতী মানুষ, বাংলাদেশের জন্য যিনি সুনাম বয়ে নিয়ে এসেছেন। নির্বাচন নিয়ে এত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কেন? নির্বাচনের জন্য আপনারা যে তারিখটা দেবেন সেটি বলে দিন। এর মধ্যে যতটুকু সংস্কার করা দরকার করুন।
রাজধানীর বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে জামায়াতের এক অনুষ্ঠানে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, দেশে নানা ধরনের সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি করার জন্য পাঁয়তারা চলছে। সংবিধানের সংকট যদি হয়, রাজনৈতিক সংকট যদি হয়, সেই সংকটের পেছনে কী শক্তি আছে সেটি আমাদের আগেই এনালাইসিস করতে হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দিনের পদচ্যুতি ইস্যুতে বিএনপি যে অবস্থান নিয়েছে তা সময়োপযোগী এবং সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত। এখন হিসাব করে পা ফেলতে হবে। ফ্যাসিস্ট হাসিনার ষড়যন্ত্র ঠেকাতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করার মানসিকতা থাকতে হবে। তারেক রহমান সে বিচক্ষণতা দেখাচ্ছেন।ইনকিলাব