১৫ বিচারপতি অপসারণ : যেভাবে কাজ করবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় সোমবার, ২১ অক্টোবর, ২০২৪
  • ৪২ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- বিচারকাজ থেকে বিরত রাখা হাইকোর্টের ১২ বিচারপতির ভাগ্য নির্ধারণ করবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল৷ সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর ওপর রিভিউ আবেদন নাকচ হওয়ায় ওই বিচারকদের বিষয়ে অভিযোগের তদন্ত হবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে৷

‘দলবাজ’ ও ‘দুর্নীতিবাজ’ বিচারপতিদের পদত্যাগ অথবা তাদের অপসারণের দাবিতে হাইকোর্ট ঘেরাও এবং বিক্ষোভের ঘটনার পর হাইকোর্ট বিভাগের ১২ জন বিচারপতিকে আপাতত বেঞ্চ না দেয়া, অর্থাৎ বিচারকাজ থেকে বিরত রাখার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন৷ এর আগে গত সরকারের আমলে আরো তিন বিচারপতির বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হয়েছিল৷ আর তাই এই ১৫ বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত করবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে

১৬ অক্টোবর বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা ‘ফ্যাসিস্ট সরকারে সহযোগী ও দলবাজ বিচারপতিদের’ পদত্যাগের দাবিতে সুপ্রিম কোর্ট ঘেরাও করলে ওই ১২ জন বিচাপতিকে চায়ের দাওয়াত দিয়ে তাদের বিচারিক বেঞ্চ কেড়ে নেন৷

একই সাথে আপিল বিভাগে বিচারপতিতের অভিসংশনের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিরুদ্ধে সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের রিভিউ পিটিশনের শুনানির দিন ধার্য করা হয় রোববার৷ ২০১৪ সালে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার বিচারপতিদের অভিসংশনের ক্ষমতা সংসদকে দিয়েছিল৷ কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ আদালত তা বাতিল করে দিয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বহাল রেখেছিল৷ আওয়ামী লীগ সরকার আপিল বিভাগে আবার সেই রায়ের ব্যাপারে রিভিউ করে৷

রোববারের শুনানি শেষে আপিল বিভাগ সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণ করা যাবে বলে সিদ্ধান্ত দেন৷ সংবিধানের এ সংক্রান্ত ৯৬ অনুচ্ছেদ পুরোটাই পুনর্বহাল করেছে আপিল বিভাগ৷

প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ রোববার এই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন৷

এই রায়ের ফলে কোনো বিচারপতির বিরদ্ধে অসমর্থতা ও পেশাগত অসদাচরণের কোনো অভিযোগ উঠলে, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া যাবে৷

আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ও রিট আবেদনকারীদের পক্ষে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ শুনানিতে অংশ নেন৷ এছাড়া সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল আদালতের অনুমতি নিয়ে শুনানিতে অংশ নেন৷

অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আপিল বিভাগের আদেশের ফলে দেশে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বহাল হলো৷ বিচারকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওই কাউন্সিলেই নিস্পত্তি হবে৷’

আর বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নেয়া ১২ জন বিচারপতির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তাদের বিরুদ্ধে যদি পেশাগত অসদাচারণ বা আর্থিক বা মানসিক অসততার কোনো অভিযোগ থাকে তাহলে তা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে অভিযোগ আকারে দিতে হবে৷ কাউন্সিল তদন্ত করে দেখবে যে, তারা দোষী না নির্দোষ৷ এরপর কাউন্সিল আবার তাদের ফাইন্ডিংস রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন, সুপারিশ করবেন৷ রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থা নেবেন৷’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলো রাষ্ট্রপতির৷ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব হলো মেকানিক্যাল৷ সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের দায়িত্ব হলো যেসব বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা দোষী না নির্দোষ তা নির্ধারণ করা৷ অভিযোগ প্রমাণ হলে শাস্তির সুপারিশ করা৷’

আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রধান বিচারপতি এবং আপিল বিভাগের দুইজন সিনিয়র বিচারপতিকে নিয়ে গঠিত হয়৷ তবে অভিযোগ করতে হয় রাষ্ট্রপতির কাছে৷ রাষ্ট্রপতি অভিযোগ সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে পাঠান৷’

‘তিনি বলেন, ‘সাধারণ মানুষ হয়তো সব সময় রাষ্ট্রপতির কাছে অভিযোগ করতে পারেন না৷ আবার অনেক অভিযোগ আছে যা সাধারণ মানুষের জানা নেই৷ সেই কারণে কাউন্সিল স্বপ্রণোদিত হয়েও তদন্ত শুরু করে রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করতে পারেন৷’

সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের তৎপরতা

২০০৩ সালের অক্টোবর মাসে হাইকোর্ট বিভাগের ওই সময়ের বিচারপতি সৈয়দ শাহিদুর রহমানের বিরুদ্ধে অসৎ উপায়ে অর্থ গ্রহণের অভিযোগ ওঠে৷ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির তৎকালীন সভাপতি ও সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ সৈয়দ শাহিদুর রহমানের বিরুদ্ধ অসদাচরণের অভিযোগ প্রকাশ্যে আনেন৷ রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে বিষয়টি তদন্ত করতে নির্দেশ দেন৷ তৎকালীন প্রধান বিচারপতি কেএম হাসানের নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বিষয়টি তদন্ত করে৷ তদন্ত শেষে কাউন্সিল অভিযোগের সত্যতা পায় এবং রাষ্ট্রপতির কাছে তার পদচ্যুতির সুপারিশ করে৷ পরে রাষ্ট্রপতি তাকে পদচ্যুত করেন৷

আরো দুটি ঘটনায় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পদক্ষেপ গ্রহণের আগেই সংশ্লিষ্ট দুজন বিচারপতি পদত্যাগ করেন৷ আকেটি ঘটনা হলো হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি লতিফুর রহমান ও সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল এরশাদের ফোনালাপ একটি পত্রিকায় ফাঁস হওয়া৷ ঘটনাটি ক্যাসেট কেলেঙ্কারি নামে অধিক পরিচিত৷ পরে বিচারপতিকে দীর্ঘদিন বেঞ্চ থেকে সরিয়ে রাখা হয় এবং তিনি পদত্যাগ করেন৷

এদিকে ২০১৯ সালের আগস্ট মাস থেকে হাইকোর্ট বিভাগের তিনজন বিচারপতিকে বিচারকাজ থেকে দূরে রাখা হয়েছে৷ সেসময় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়, রাষ্ট্রপতির সাথে পরামর্শ করে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে৷ আর বুধবার আরো ১২ জন বিচারপতিকে বিচার কাজ থেকে দূরে রেখেছেন প্রধান বিচারপতি৷ ২০১৪ সালের অক্টোবরে ষোড়শ সংশোধনী, হাইকোর্টে তা বাতিল, সুপ্রিম কোর্টে হাইকোর্টের আদেশ বহাল ও উচ্চ আদালতে রিভিউ থাকায় শেষোক্ত ১৫ জনের ব্যাপারে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যায়নি৷ এখন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বহাল হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের নিস্পত্তি হবে বলে জানান আইনজীবীরা৷

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কার্যকর থাকলে এতদিনে আরো ১৫ জন বিচারপতির ব্যাপারে তদন্ত হতে পারত৷ তিনজন বিচারপতিকে তো চার বছর ধরে বসিয়ে রেখে বেতন ভাতা দেয়া হচ্ছে৷ সব পেশায়ই পেশাগত অসদাচারণ এবং অনৈতিক কাজের অভিযোগে ব্যবস্থা নেয়ার বিধান আছে৷ বিচারপতিরাও তার বাইরে নয়৷’

তবে অ্যাডভোকেট মনজিল মেরসেদ বলেন, ‘আসলে ষোড়শ সংশোধনী হাইকোর্ট বাতিল এবং আপিল বিভাগ তা বহাল রাখায় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল আগে থেকেই বহাল ছিল৷ কারণ রিভিউয়ের ফলে আপিল বিভাগ তো হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করেনি৷ তারপর নানা জটিলতায় কাউন্সিলকে কার্যকর করা হয়নি৷ এখন তো কাউন্সিল বহাল হয়ে গেল৷’

তবে নিম্ন আদালতের বিচারকদের ব্যাপারে সুপ্রিম জুডিশয়াল কাউন্সিল নয়, সুপ্রিম কোর্ট ব্যবস্থা নেয়৷ এজন্য প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি জেনালের অ্যাডমিনিষ্ট্রেশন কমিটি আছে৷ আইন মন্ত্রণালয় বা জেলা আদালতের মাধ্যমে অভিযোগ আসে৷ কিন্তু অনেক সময় ওই অভিযোগ আটকে রাখা হয়৷ সুপ্রিম কোর্টে পাঠানো হয় না৷

মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘এই কারণেই আমরা স্বাধীন বিচার বিভাগের জন্য আলাদা সচিবালয় করার কথা বলেছি৷ যা সুপ্রিম কোর্টের অধীনে থাকবে৷’

তিনি বলেন, ‘আর কোনো দাবি বা আন্দোলনের মুখে বিচারক বা বিচারপতিদের অভিসংশন বা অপসারণ করা যাবে না৷ অভিযোগ থাকতেই পারে৷ অভিযোগের ভিত্তিতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল তদন্ত করে দেখবে৷ তাদের তদন্তের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত হবে৷ আন্দোলন বা দাবির মুখে বিচারপতিদের অপসারণ করলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা থাকবে না। সূত্র : ডয়চে ভেলে

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions