ড. মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান:- পাহাড় ও অরণ্যের রাখিবন্ধনে চিরসবুজ পার্বত্য চট্টগ্রাম শুধু বাংলাদেশেরই নয়, সমগ্র পৃথিবীর অন্যতম দৃষ্টিনন্দন স্থান। বাংলাদেশের সার্বভৌম অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের অবস্থান অত্যন্ত তাৎপর্যময়। সম্পদ সমৃদ্ধ পার্বত্য চট্টগ্রামের গুরুত্ব বহুমাত্রিক, যা একসময় বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের অধীনে বৃহত্তম একটি জেলা ছিল। আঞ্চলিকভাবে ভূরাজনৈতিক ও ভূকৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এ অঞ্চল ভারত মহাসাগরের প্রবেশ পথে বঙ্গোপসাগরের উপকূল থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থিত। মেরিটাইম রুট ও সমুদ্রবন্দরের গুরুত্ব বিবেচনায় ভূখণ্ডটি নিছক একটি অঞ্চলই নয়, বরং এর উত্তরে ভারতের অংশ বিশেষসহ চীন, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর এবং উত্তর-পূর্বে ভারতের সেভেন সিস্টার্স এলাকা এবং পূর্বে মিয়ানমার—এসব কিছু মিলিয়ে এটি একটি ভূকৌশলগত অঞ্চল, যা গত কয়েক দশক থেকে দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্রের শিকার। বিশেষ করে সেখানে বসবাসরত বিভিন্ন উপজাতি, গোষ্ঠী ও বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে ঐক্য ও জাতীয়তাবাদের বিপরীতে দ্বন্দ্ব, বিভক্তি, অস্ত্রের প্রতিযোগিতা, হানাহানি, বিচ্ছিন্নতা ইত্যাদি সমস্যা লেগেই আছে বলা চলে। বাস্তবে শান্তি ফেরানোর জন্য ঐক্য ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কোনো বিকল্প নেই। সম্প্রতি খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় চোর সন্দেহে গণপিটুনিতে এক বাঙালি মুসলিম যুবকের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে সংঘর্ষ ও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। প্রাণ হারায় অন্তত আরও তিনজন। পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে যার রেশ এখনো কাটেনি। আবার খাগড়াছড়িতে গণপিটুনিতে কারিগরি স্কুল ও কলেজের শিক্ষক নিহতের জেরে দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় জেলা সদরে অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। পাহাড়ে অশান্তির বিষয়টি যদিও নতুন নয়। এখানে দেশি-বিদেশি নানাপক্ষ জড়িত থাকার বিষয়টি গণমাধ্যমে বারবার উঠে এসেছে। বিশেষ করে, ভারতের মণিপুর রাজ্যে সহিংসতার সময় বাংলাদেশেও সহিংসতা ছড়ানোর বিষয়টি কাকতালীয় না, নতুন সরকারকে বিব্রত করার আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র; তা গভীরভাবে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ১২টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বাস করে। নৃতাত্ত্বিক বিচারে তাদের অধিকাংশই মঙ্গোলীয় শ্রেণিভুক্ত। এখানে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সম্মিলিত সংখ্যা মোট জনসংখ্যার মাত্র দশমিক চার পাঁচ শতাংশ। তারা বিভিন্ন কারণে বিশেষত নিরাপদ আশ্রয় লাভের সন্ধানে তিব্বত, চীন, মিয়ানমার এবং ভারতের বিভিন্ন পাহাড়ি অঞ্চল থেকে প্রায় ৫০০ বছর আগে বাংলাদেশের ভূখণ্ড পার্বত্য চট্টগ্রামে আসে। অধিকাংশ চাকমা ও মারমা বৌদ্ধধর্মের অনুসারী, ত্রিপুরার অধিবাসীরা হিন্দু ধর্মের আর মিজো, বম ও থেয়াং খ্রিষ্টান। অন্য কিছু গোত্র আত্মা, প্রাণী ও উদ্ভিদের পূজারি। এদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে চাকমারা নবাগত। অনেকেরই নিজস্ব ভাষা থাকলেও এক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী অন্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা বোঝে না। এক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্য অন্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সঙ্গে কথা বলার সময় বাংলা ভাষা ব্যবহার করে। প্রতিটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বাংলা ভাষা বোঝে এবং নিজস্ব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বাইরে বাংলা ভাষায় কথা বলে।
ভৌগোলিক আয়তনে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলটি লেবানন, সাইপ্রাস, ব্রুনেই, কাতার, সিঙ্গাপুর, মরিশাস কিংবা লুক্সেমবার্গের আয়তনের চেয়েও বড়। আর অবস্থানগত গুরুত্ব বিবেচনা করলে পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তরে ও খাগড়াছড়ি জেলার পশ্চিমে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, পূর্বে ভারতের মিজোরামের লুসাই পাহাড়পুঞ্জ ও মিয়ানমারের অংশ, দক্ষিণে মিয়ানমার, পশ্চিমে সমতল উপকূলীয় চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলা অবস্থিত। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের ২৩৬.৮০ কিলোমিটার, মিজোরাম রাজ্যের সঙ্গে ১৭৫.৬৮ কিলোমিটার এবং মিয়ানমারের সঙ্গে ২৮৮.০০ কিলোমিটার আন্তর্জাতিক সীমান্ত রয়েছে। সমস্যা হচ্ছে আন্তঃজেলাগুলোর মধ্যে পর্যাপ্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা, মোবাইল নেটওয়ার্ক, সুপেয় পানির তীব্র সংকট, বিদ্যুৎ সংকট, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখনো কার্যকরভাবে গড়ে ওঠেনি, যার ফলে সীমান্ত এলাকা মাদক পাচার, অস্ত্র চোরাচালান ও সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে, যা পাহাড়কে হঠাৎ হঠাৎ অশান্ত করে তোলে; যা পাহাড়ি কিংবা বাঙালি কারোরই কাম্য নয়।
ইতিহাস বলে, ১৮৬০ সালের আগে পার্বত্য চট্টগ্রামের কোনো স্বতন্ত্র অস্তিত্বই ছিল না। তখন এটি ছিল চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্ভুক্ত। ব্রিটিশ শাসকদের ‘ভাগ করো শাসন করো’ নীতির কৌশল হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বতন্ত্র অস্তিত্বের জন্ম দেয়। ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ জুনের নোটিফিকেশন নাম্বার ৩৩০২ এর ভিত্তিতে এবং একই সালের ১ আগস্ট ১৮৬০, রেইডস এর ‘ফ্রন্টিয়ার অ্যাক্ট ২২ এফ ১৮৬০’ অনুসারে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী তাগিদে ব্রিটিশ বেনিয়া গোষ্ঠী বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলাকে বিভক্ত করে এর পাহাড় প্রধান অঞ্চলকে স্বতন্ত্র ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম’ জেলায় রূপান্তর করে। ১৯০০ সালের ম্যানুয়েলের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলাকে তিনটি সার্কেলে বিভক্ত করে প্রশাসনিক ও রাজস্ব সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড পরিচালনার ব্যবস্থা করা হয়। ১৯০০ সালের ১ মে ব্রিটিশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি প্রভাব খর্ব করার লক্ষ্যে এবং ওই এলাকার স্থায়ী প্রশাসনিক ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে ‘নোটিফিকেশন ১২৩ পিডি’ চিটাগাং হিল ট্রাক্টস, রেগুলেশন ১৯০০ চালু করে। ব্রিটিশ বেনিয়া ঔপনিবেশিকদের এই কৌশলের কারণ ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি প্রভাব ও বসতি স্থাপন প্রক্রিয়া বন্ধ করা এবং সেখানে খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচার করা। প্রায় জনশূন্য এবং সম্পদ সমৃদ্ধ পার্বত্য চট্টগ্রামের ওপর বার্মা, আরাকান, চীন ও উত্তর-পূর্ব ভারতের দূরবর্তী অঞ্চল থেকে আসা বসতি স্থাপনকারী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের যতটুকুই দাবি ছিল অঞ্চলটির কাছের সংলগ্ন চট্টগ্রামের সমতলবাসী বাঙালি জনগোষ্ঠীর ওই অঞ্চলটির ওপর অধিকার বা দাবি কোনো যুক্তিতেই কম ছিল না। কিন্তু স্বার্থান্বেষী বেনিয়া ইংরেজরা ন্যায়পরায়ণতার যুক্তিকে লঙ্ঘন করে ষড়যন্ত্রের বীজ বপন করেছিল, যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে আমরা এখনো লক্ষ করছি।
১৯৫৬ সালে পৃথক অঞ্চলের বিধানের সমাপ্তি ঘটে। এই সালে প্রাদেশিক সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ মর্যাদা খর্ব করে এবং এর সম্পূর্ণ বিলুপ্তি ঘটে ১৯৬৪ সালে আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র সংবলিত শাসনতন্ত্র প্রবর্তনের মাধ্যমে। মৌলিক গণতন্ত্রের আওতায় পার্বত্য চট্টগ্রাম সমতলের রাজনৈতিক ধারায় মিশে যাওয়ায় সমতলের শাসনবহির্ভূত অঞ্চলের মর্যাদারও স্বাভাবিক অবসান ঘটে। ওই বছর ম্যানুয়েলের ৫১ অনুচ্ছেদ রহিত করে পাকিস্তানের সর্বত্র সব নাগরিকের অবাধ বিচরণ নিশ্চিত করা হয় ঢাকা হাইকোর্টের এক রায়ে। তখন থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি বসতি গড়ে উঠতে থাকে। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি মাত্র বৃহত্তর জেলা ছিল। ১৯৮৩ সালে রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি—এ তিনটি প্রশাসনিক পার্বত্য জেলায় বিভক্ত করা হয়।
বাঙালি-পাহাড়ি দ্বন্দ্ব, ভূমিসংক্রান্ত বিরোধ, বিভিন্ন দল ও উপদলগুলোর চাঁদাবাজি, অস্ত্র ও উগ্রবাদী গোষ্ঠীর প্রভাব বিস্তার, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব, ধর্মীয় উসকানি, স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র ইত্যাদি কারণগুলোই প্রতিবার কোনো না কোনোভাবে পাহাড়কে অশান্ত করছে। পাহাড়ি কিংবা বাঙালি কেউ পাহাড়ে অশান্তি চান না। কিন্তু পাহাড়কে নিয়ে অপরাজনীতি চলেছে যুগ যুগ ধরে। তাই পাহাড়ে শান্তি ফেরানোর চ্যালেঞ্জ যে কোনো সরকারের কাছে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে বিশ্লেষকদের মত। ১৯৯৬ সালে যে পার্বত্য শান্তি চুক্তি করা হয়েছিল, তা ছিল পাহাড়কে শান্ত করার একটি পদক্ষেপ মাত্র, যা পাহাড়ে শান্তি স্থাপনের মূল নিয়ামক হয়ে ওঠেনি এখনো। তাই পাহাড়ে শান্তি ফেরাতে পাহাড়ি-বাঙালি ভেদাভেদ ভুলে সবার সমঅধিকার নিশ্চিতকরণ, ভূমিসংক্রান্ত বিরোধের যৌক্তিক নিষ্পত্তি, দল-উপদলের আধিপত্যকে যথাযথ আইনের আওতায় আনা, ধর্মীয় উসকানি কিংবা নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দেশি-বিদেশি সব অপচেষ্টাকে নস্যাৎ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে অটুট রাখতে হবে। পাহাড় আর অরণ্যের মেলবন্ধনে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সম্পদ ও পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটিয়ে এর আঞ্চলিক গুরুত্ব ও ভৌগোলিক সার্বভৌমত্বকে যথাযথ ব্যবহার করে বাংলাদেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে হবে।
লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষক ও কলামিস্ট, মহাপরিচালক, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট