ড. নিয়াজ আহম্মেদ:- সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শুরুতে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকলেও বর্তমানে বেশ কিছু নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। এমনকি পণ্যমূল্য নির্ধারণ করে দেওয়ার পরও দাম বাড়ছে। সেপ্টেম্বরে মুদ্রাস্ফীতি প্রায় ১ শতাংশ কমার পরও বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য স্বাভাবিক থাকছে না।
ফলে সাধারণ ও অতিদরিদ্র এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে মধ্যবিত্তের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। পণ্যমূল্য নির্ধারণ করা হয় চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে। এর সঙ্গে যুক্ত চাহিদা মেটানোর প্রক্রিয়া, যাকে আমরা সাপ্লাই চেইন নামে অভিহিত করি। এই প্রক্রিয়াগুলো যদি সঠিকভাবে কাজ না করে, তাহলে দাম বাড়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।
এটিকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বলা হয়। কিন্তু এর বাইরেও অনেক বিষয় রয়েছে, যা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে দাম বাড়তে থাকে। আমরা এটিকে কৃত্রিম সংকট এবং কৌশল বলতে পারি। পণ্য আছে, কিন্তু মজুদ করে রেখে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা।
রাস্তা ও পরিবহনে চাঁদাবাজি এবং অধিক মুনাফা লাভের জন্য পণ্যমূল্য বেশি করে নির্ধারণ করা। এ কথা সত্য পাইকারি ও খুচরা মূল্য এক হবে না। কিন্তু এই দুই মূল্যের ব্যবধান যদি অনেক বেশি হয়, তখন সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। পণ্য সরবরাহে যে লাভ, তা উৎপাদক থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যন্ত যদি সমান এবং সহনশীল হয়, তাহলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা স্বাভাবিক থাকে। আর এই জায়গায় যদি আমরা পদক্ষেপ নিতে পারি, তাহলে মানুষের জীবনযাত্রা ও ক্রয়ক্ষমতায় স্বস্তি আসবে।
আমাদের মতো দেশে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ চাহিদার তুলনায় দেশীয় উৎপাদনকৃত পণ্যের জোগান স্বল্পতা। বাজারে পণ্যের দাম ঠিক রাখতে আমদানি করা কিছু পণ্যে কখনো কখনো সরকার শুল্ক ছাড় দিয়ে থাকে। এতে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, সাধারণ মানুষ পণ্য ক্রয়ে এর কোনো সুফল পায় না। শুল্ক হ্রাস করার পরও অনেক সময় আগের দামে পণ্য কিনতে হয়। আমরা যদি কৃষিকে লাভজনক করতে পারতাম, তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান হতো। অর্থনীতির সাধারণ সূত্র পণ্যের জোগান বাড়া মানে পণ্যমূল্য কমে যাওয়া। ধরুন, আমাদের যে পরিমাণ পেঁয়াজ দরকার, সেই পরিমাণ যদি উৎপাদন করা সম্ভব হতো, তাহলে আমাদের আমদানির প্রয়োজন হতো না। হঠাৎ করে দাম বাড়ার আশঙ্কাও তৈরি হতো না। কোনো দেশের ওপর দাম বাড়া কিংবা কমার সুযোগ তৈরি হতো না। সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে আমাদের যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।
নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ জরুরিবর্তমান সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। আমরা স্বীকার করছি তাদের রাষ্ট্র পরিচালনায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হচ্ছে। পাশাপাশি দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণেও একটু পদক্ষেপ নিতে হবে। বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ কঠোরভাবে নিতে হবে। পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ, সাপ্লাই চেইনকে কার্যকর করা এবং সঠিক বাজার ব্যবস্থাপনা। আর সবার ওপর আসল সত্য হলো, পুরো প্রক্রিয়া এমন হতে হবে, যেন কেউ অধিক মুনাফা অর্জন করতে না পারে। পাইকারি থেকে খুচরা বিক্রেতা সবার ক্ষেত্রে এই বিষয়টি প্রযোজ্য। দেখা যায়, স্বল্প দূরত্বেও পণ্যমূল্যের ব্যবধান অনেক বেশি। এই ব্যবধান কমাতে হবে। প্রথমে আমাদের চাহিদা নির্ধারণ করতে হবে। এ বছর কী পরিমাণ পেঁয়াজ, রসুন, ডাল ও আলু দরকার, তার চাহিদা নির্ধারণ করতে হবে। সেই পরিমাণ যদি আমরা উৎপাদন করতে পারি, তাহলে চাহিদা পূরণ করা সহজ। অবশ্য উৎপাদন খরচও নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। ভর্তুকি দিয়েও উৎপাদন খরচ কমাতে পারলে এর সুফল ভোক্তা পাবে। আমাদের বিশাল জনসংখ্যার জন্য কাজটি করা একটু কঠিনই বটে। পাশাপাশি আমাদের রয়েছে প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম দুর্যোগ। সব কিছুর ওপর কৃষিতে আকৃষ্ট করা গেলে আমরা অনেক সুফল পেতে পারি।
দ্বিতীয়ত, বাজার ব্যবস্থাপনার ওপর বেশি জোর দিতে হবে। একটি পণ্যের ক্রয়মূল্য, শুল্ক ও পরিবহন খরচের পর তার মূল্য নির্ধারিত হওয়ার কথা। একজন ব্যবসায়ী ক্রয়মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ মুনাফা করতে পারেন। কিন্তু এর বেশি যদি মুনাফা করেন, তাহলে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি হওয়া স্বাভাবিক। সব পণ্যের ক্ষেত্রে বিষয়টি প্রযোজ্য। সঠিক বাজার ব্যবস্থাপনা এবং মনিটরিংয়ের মাধ্যমে আমরা এই বিষয়টিকে মোকাবেলা করতে পারি। এ জন্য অনেক জনবল দরকার। পরিবহন খরচ এবং চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ যেমন জরুরি, তেমনি বাজার ব্যবস্থাপনাও জরুরি। অনেক সমস্যার সমাধান আমরা জানি এবং মোকাবেলা করার কৌশলও আমাদের অজানা নয়, কিন্তু সমস্যা সমাধান করতে পারি না। পণ্যমূল্য কমাতে হলে দেশীয় পণ্যের উৎপাদন বাড়াতে হবে। কৃষিতে উৎসাহিত করা এবং ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে তা সম্ভব। পণ্যমূল্য কমাতে হলে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ এবং বাজার ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ও মনিটরিং জোরদার করতে হবে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ও প্রশাসনের নজরদারির মাধ্যমে তা সম্ভব। পণ্যমূল্য কমাতে হলে ব্যবসায়ীদের নৈতিকতাসম্পন্ন হতে হবে। ব্যবসায়ীদের ওপর কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ এবং নৈতিক শিক্ষা এ ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। আমরা পারব না এমন কিছু নয়।
আমাদের বিশ্বাস বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার মানুষের বহু আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। তাদের কাছে আমাদের প্রত্যাশাও অনেক। এর মধ্যে জীবনধারণের জন্য খাদ্য ও পণ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখা অন্যতম। আমরা আশা করি, সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা স্বাভাবিক রাখতে সক্ষম হবে। আর ব্যবসায়ীদের কাছে অনুরোধ থাকবে, সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে মুনাফা যেন তাঁরা কম করেন।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
neazahmed_2002@yahoo.com