ডেস্ক রির্পোট:- লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা চলছে। সরকার কি এসব মামলা প্রত্যাহার করবে, নাকি তাঁকে কারাভোগ করতে হবে? ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে এসব প্রশ্ন।
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে তারেক রহমানের ‘রাজনৈতিক মামলা’ প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে আসছে বিএনপি। সরকারের মেয়াদ দুই মাস পূর্ণ হওয়ার পরও এ বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় ক্ষুব্ধ দলের নেতাকর্মী। বিএনপি নেতা ও আইনজীবীরা আভাস দিচ্ছেন, মামলা প্রত্যাহারের পর আগামী বছরের শুরুতে দেশে ফিরতে পারেন তারেক রহমান।
এ পরিস্থিতিতে গতকাল সোমবার তারেক রহমানের সব মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম। অন্যথায় তারা ফের আন্দোলনে নামবে বলে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট বার ভবনে সংবাদ সম্মেলনে আইনজীবী ফোরামের সভাপতি জয়নুল আবেদীন এ হুঁশিয়ারি দেন।
জানা গেছে, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে এখনও রাষ্ট্রদ্রোহসহ ৮০ মামলা বিচারাধীন। ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং পরবর্তী সময় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে এ পর্যন্ত এসব মামলা হয়। গত ছয় বছরে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, অর্থ পাচার, মানহানিসহ পাঁচ মামলায় সাজাও হয়েছে তাঁর। পলাতক দেখিয়েই মামলাগুলোর বিচার সম্পন্ন করেছেন বিভিন্ন আদালত।
মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তারেক রহমানকে দেশে ফিরে আদালতে হাজির হতে হবে। এর পর যেসব মামলায় তাঁর সাজা হয়েছে, ওই সব আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন নিতে হবে। তবে সরকার নির্বাহী আদেশে তাঁর সব সাজা বাতিল বা স্থগিত করতে পারেন। অবশ্য অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তারা সব রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার করবে। তবে গত দুই মাসে তারেক রহমানের কোনো মামলা প্রত্যাহার করা হয়নি। এ নিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীর মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
জানা গেছে, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ওয়ান-ইলেভেন সরকারের আমলে ১৭টি মামলা হয়। পরে শেখ হাসিনার সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা, অর্থ পাচার এবং দেশব্যাপী বিভিন্ন জেলা-থানায় মানহানির মামলাসহ আরও অন্তত ২০টি মামলা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন জেলা ও থানায় তাঁর বিরুদ্ধে আরও ৫০টি মামলা রয়েছে। তবে বিভিন্ন সময় জেলা ও থানা পর্যায়ে বিচ্ছিন্নভাবে দায়েরকৃত এসব মামলার সঠিক পরিসংখ্যান নেই বিএনপির আইনজীবীদের কাছে।
অবশ্য গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বেশ কয়েকটি মামলা তুলে নিয়েছে বাদীপক্ষ। বর্তমানে তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে আরও ৮০টি মামলা।
দলীয় সূত্র বলছে, কোনো অনুকম্পা বা নির্বাহী আদেশ নয়, আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মামলাগুলো মোকাবিলা করতে চান তারেক রহমান। এ জন্য তাঁর পক্ষে একটি শক্তিশালী আইনজীবী প্যানেল কাজ করছে। আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মামলাগুলো চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হলেই দেশে ফিরবেন তিনি।
আইনজীবী ফোরামের নেতারা দাবি করেন, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে কয়েকটি মিথ্যা মামলার ফরমায়েশি রায় ঘোষণা করা হয়েছে। আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, অবিলম্বে তারেক রহমানের সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করার দাবি জানাচ্ছি। অন্যথায় আইনজীবী সমাজ আবারও রাস্তায় নামতে বাধ্য হবে।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, আদালতে তাঁর সাজা হয়েছে। মামলা প্রত্যাহারের বিষয়টি সম্পূর্ণ আদালতের সিদ্ধান্ত। তবে যেহেতু এগুলো রাজনৈতিক মামলা, আদালতের কাছে না গিয়ে সরকারও এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে পারে। এটা সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও তারেক রহমানের আইনজীবী প্যানেল সদস্য মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, বর্তমানে জনগণের সরকার ক্ষমতায়। তাদের আইনি দায়িত্ব এসব মামলা দ্রুত প্রত্যাহার করা। অবিলম্বে সরকার এসব মামলা প্রত্যাহার করবে– এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, বর্তমান সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তারেক রহমানসহ সব রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার করা হবে। আমরা এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে তাঁর কোনো মামলা প্রত্যাহারের আলামত দেখছি না। এ কারণে দেশের মানুষ এ ব্যাপারে ধোঁয়াশার মধ্যে আছে।
অর্থ পাচার মামলায় কারাদণ্ড
সিঙ্গাপুরে অর্থ পাচারের অভিযোগে করা মামলায় ২০১৩ সালে ঢাকার একটি আদালত তারেক রহমানকে খালাস দেন। ওই মামলায় তারেকের বন্ধু ও ব্যবসায়ী গিয়াসউদ্দিন আল মামুনকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
বিচারিক আদালতের ওই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করে দুদক। ২০১৬ সালে বিচারিক আদালতের রায় বাতিল করে তারেক রহমানকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি ২০ কোটি টাকা জরিমানা করেন। এটি ছিল তারেক রহমানের প্রথম সাজা। মামলাটি চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে আপিল বিভাগে।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা হয়। সেই হামলায় তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এবং দলটির কয়েকজন শীর্ষ নেতা অল্পের জন্য বেঁচে গেলেও নিহত হন ২৪ জন। আহত হন চার শতাধিক নেতাকর্মী।
ওই ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলায় ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল রায়ে ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। একই দিনে ওই ঘটনা থেকে উদ্ভূত বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায়ও তারেক রহমানকে ২০ বছর কারাদণ্ড দেন ঢাকার আদালত।
বর্তমানে ডেথ রেফারেন্স মামলাটি অনুমোদন এবং আপিলের শুনানি চলছে হাইকোর্টে। তবে চলমান পরিস্থিতিতে বেঞ্চ পুনর্গঠনের পর আসামি পক্ষ এ মামলায় সময় আবেদন করে।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দণ্ড
২০০৮ সালে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন। এতিমদের জন্য বিদেশ থেকে আসা ২ কোটি ১০ লাখ টাকা ট্রাস্টের কাজে ব্যবহার না করে নিজেদের হিসাবে জমা রাখার মাধ্যমে আত্মসাৎ করার অভিযোগে এই মামলা দায়ের করা হয়।
২০১৮ সালে এ মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন বিচারিক আদালত। একই সঙ্গে তারেক রহমানসহ অন্য পাঁচ আসামিকে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। দেশের বাইরে থাকায় এবং সাজা ভোগ না করায় তারেক রহমানের সাজা এখনও বহাল আছে। মামলাটি বর্তমানে আপিল বিভাগে বিচারাধীন।
জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের মামলা
২০০৭ সালে তারেক রহমান, তাঁর স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমান ও তাঁর মা সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানুর বিরুদ্ধে একটি মামলা করে দুদক। এতে দাবি করা হয়, তারেক রহমান ও তাঁর স্ত্রীর ঘোষিত আয়ের বাইরেও ৪ কোটি ৮০ লাখ টাকারও বেশি পরিমাণ অর্থের অবৈধ সম্পদ রয়েছে। গত বছরের আগস্টে এ মামলায় তারেক রহমানকে ৯ বছর এবং তাঁর স্ত্রীকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেন ঢাকার বিচারিক আদালত। এ মামলায় তারেক রহমানের ৯ বছরের সাজা এখনও বহাল আছে।
নড়াইলে মানহানির মামলায় সাজা
২০১৪ সালে লন্ডনের এক সমাবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাজাকার ও পাকবন্ধু বলে মন্তব্য করেন তারেক রহমান। এ নিয়ে নড়াইলে তাঁর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা হলে ২০২১ সালে তাঁকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেন নড়াইলের আদালত। ঢাকার আদালতেও মানহানির অভিযোগে কমপক্ষে ১০টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে। বঙ্গবন্ধুকে কটূক্তি ও ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগে এসব মামলা দায়ের হয়েছে।
রাষ্ট্রদ্রোহের বেশ কয়েকটি মামলা
একুশে টেলিভিশনের চেয়ারম্যান আবদুস সালামের সঙ্গে যোগসাজশের মাধ্যমে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি সৃষ্টির অভিযোগে ২০১৫ সালে তেজগাঁও থানায় তারেক রহমানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করা হয়। এ মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও রয়েছে। এ ছাড়া নোয়াখালীসহ বিভিন্ন জেলায় রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে আরও বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে। এসব মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন
ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের একাধিক মামলাও রয়েছে তারেকের বিরুদ্ধে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকির অভিযোগে ২০২০ সালে ঢাকার সিএমএম আদালতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন জননেত্রী পরিষদের সভাপতি এ বি সিদ্দিকী।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, তারেক রহমান আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই আইনি প্রক্রিয়াতেই মামলাগুলো মোকাবিলা করবেন। তাঁর আইনজীবী হিসেবে মামলাগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি। আশা করি, ন্যায়বিচার পেলে সবকটি মামলায় তিনি বেকসুর খালাস পাবেন।
ওয়ান ইলেভেনের সরকারের সময় ২০০৭ সালের ৭ মার্চ গ্রেপ্তার করা হয় তারেক রহমানকে। পরের বছর ৩ সেপ্টেম্বর শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পেয়ে সপরিবারে লন্ডন চলে যান তিনি। তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। সমকাল