ডেস্ক রির্পোট:- নিয়োগ-পদোন্নতি ঘিরে অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির যেন হাট বসেছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। গত ১৫ বছরে দায়িত্ব পালন করা তিন উপাচার্যের বিরুদ্ধেই ওঠে নানা অভিযোগ। নিয়মনীতি উপেক্ষা করে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ারুল আজিম আরিফ তাঁর পুত্র, দুই পুত্রবধূ, শ্যালিকাসহ ছয় স্বজনকে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি দিয়েছেন। দলীয় পরিচয়কে প্রাধান্য দিয়ে চার বছরে নিয়োগ দিয়েছেন প্রায় ৩০০ শিক্ষক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক উপাচার্য ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী পদে ১৪২ জনকে স্থায়ী ও অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দেন। ছাত্রলীগের সাবেক নেতা, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত ছাত্র এবং মামলার আসামিকেও চাকরি দেওয়ার অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে। সবচেয়ে বেশি বিতর্ক ছিল সদ্য বিদায় নেওয়া উপাচার্য ড. শিরীণ আখতারের বিরুদ্ধে। দায়িত্বের চার বছরে তিনি ৫৪০ শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন। তাঁর সময়ে অন্তত পাঁচটি নিয়োগ বাণিজ্যের অডিও ফাঁস হয়। এগুলোতে ১৬ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেনের তথ্য রয়েছে। নিয়োগে স্বজনপ্রীতি ও লেনদেনের অভিযোগ এনে সে সময় প্রশাসনিক ২২ পদ থেকে ১৯ শিক্ষক একযোগে পদত্যাগ করেছিলেন।
দায়িত্বের শেষ দিনেও এই উপাচার্য ৩৭ কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে বাধিয়ে দিয়েছিলেন হুলস্থূল। এসব কারণে চবি প্রতিষ্ঠার ৫৮ বছরে সবচেয়ে ঘটনাবহুল ছিল গত ১৫ বছর। এই সময়ের বিভিন্ন অনিয়ম খতিয়ে দেখছে দুর্নীতি দমন কমিশন।
এ প্রসঙ্গে মেরিন সায়েন্স অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘উপাচার্যদের এসব অভিযোগের বিষয়ে যথাযথ প্রমাণের ভিত্তিতে তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।’ জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ও ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ড. এস এম নছরুল কদির বলেন, ‘এই তিন উপাচার্যের দুর্নীতি ও নিয়োগ বাণিজ্যের তথ্য নিয়মিত পত্রিকায় দেখেছি। এসব অন্যায়ের বিচারকাজ দ্রুত শুরু হওয়া প্রয়োজন। নতুন প্রশাসনকে এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে হবে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদক চট্টগ্রামের এক উপপরিচালক বলেন, ‘চবিতে নিয়োগসহ নানা বিষয়ে অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি হওয়ার অভিযোগ পেয়েছি আমরা। এগুলো খতিয়ে দেখছি। প্রয়োজনে আইনগত পদক্ষেপ নেব।’
স্বজন নিয়ে বিতর্কে জড়ান আনোয়ারুল আজিম
শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ প্রক্রিয়া বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে হওয়ার কথা। কিন্তু ২০১১ সালের ১৪ জুন উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়ে ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক আনোয়ারুল আজিম আরিফ এসব নিয়মের তোয়াক্কা করেননি। তাঁর ছেলে ইফতেখার আরিফের যোগ্যতা না থাকায় উপাচার্যের ক্ষমতাবলে অ্যাডহক ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন। তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের মর্যাদা দিতে কলেজটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইনস্টিটিউট ঘোষণা করেন। একইভাবে নিজের শ্যালিকা ইসরাত শামীমকে উপাচার্যের দপ্তরেই সেকশন অফিসার (পিএ) পদে নিয়োগ দিয়েছেন।
নিয়মনীতি না মেনে আরও এক শ্যালিকা ও দুই পুত্রবধূকেও বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মকর্তার পদে বসিয়েছেন তিনি। ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে খেলোয়াড় কোটায় শিক্ষার্থী ভর্তি করার কথা ছিল ৪০ জন। কিন্তু উপাচার্যের ক্ষমতা বলে তিনি তখন আরও ১৫টি সিট বাড়িয়ে ভর্তি করান ৫৫ জনকে। এ ক্ষেত্রে বিপুল অর্থের লেনদেন হয়েছে বলে অভিযোগ করেছিলেন আওয়ামী লীগ সমর্থক শিক্ষকরা। ২০১৫ সালের ৪ মে আনোয়ারুল আজিম আরিফের অপসারণ ও নানা অনিয়মের বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানায় মুক্তিযোদ্ধা অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ।
১৪২ নিয়োগ বিতর্কিত করে ড. ইফতেখারকে
২০১৫ সালে ভিসি হন ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী। দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কর্মচারী নিয়োগের হিড়িক ছিল তাঁর সময়ে। অনিয়মের অভিযোগে ইউজিসি তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করে। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী পদে ১৪২ জনকে স্থায়ী ও অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দেন তিনি। তাদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাবশালী শিক্ষক-কর্মকর্তার আত্মীয়স্বজনের পাশাপাশি ছাত্রলীগের সাবেক নেতা, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত ছাত্র এবং মামলার আসামি রয়েছেন। ২০২৪ সালের ১৯ মার্চ দায়িত্ব ছাড়েন তিনি। কিন্তু এর আগ মুহূর্তে নিয়োগ দেন তিনি ২৩ কর্মচারী। এ নিয়ে ছিল নানা অভিযোগ।
সবচেয়ে বেশি সমালোচিত শিরীণ আখতার
চবির প্রথম নারী উপাচার্য হিসেবে ২০১৯ সালের নভেম্বরে নিয়োগ পান ড. শিরীণ আখতার। এর আগে পাঁচ মাস ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর সময়ে অন্তত পাঁচটি নিয়োগ বাণিজ্যের অডিও ফাঁস হওয়ায় ব্যাপক সমালোচনা হয়। এসব কথোপকথনে নাম আসে তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) খালেদ মিছবাহুল, হিসাব নিয়ামক দপ্তরের কর্মচারী আহমদ হোসেন ও উপাচার্যের কন্যা রিফাত মোস্তফা টিনার। নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগে তদন্ত কমিটি মামলার সুপারিশ করলেও তা হতে দেননি অধ্যাপক শিরীণ আখতার। তাঁর মেয়াদকালে সিন্ডিকেটের অনুমোদনে ১৩০ শিক্ষক ও ২৩৮ কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়। কোনো বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে তৃতীয় শ্রেণির ১১৫ জন ও চতুর্থ শ্রেণির ৫৭ জন কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে কোনো নিয়মই মানা হয়নি। স্বজনপ্রীতি ও আর্থিক লেনদেন হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগে শিরীণ আখতারের পদত্যাগের দাবিতে গত বছর টানা এক মাস কর্মসূচি পালন করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির একাংশ। নিয়োগ বাণিজ্যের প্রতিবাদে গত বছর মার্চে প্রশাসনিক ২২ পদ থেকে ১৯ শিক্ষক একযোগে পদত্যাগ করেন। এমন ঘটনা চবিতে হয়নি আগে কখনও।
ছাত্রলীগের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল না তিন উপাচার্যের
চবি ক্যাম্পাস আগে ছিল ছাত্রশিবিরের নিয়ন্ত্রণে। তাদের হটিয়ে গত ১৫ বছর দাপট দেখিয়েছে ছাত্রলীগ। তিন উপাচার্যের আমলেই অপ্রতিরোধ্য ছিল সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন। কথায় কথায় সংঘর্ষে জড়াত ছাত্রলীগের দুটি পক্ষ। শুধু শিরীণ আখতারের সময়ে ছাত্রলীগের বিভিন্ন পক্ষ শতাধিকবার সংঘর্ষে জড়ায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাব খাটাত অছাত্র এবং বহিষ্ককৃতরাও। বারবার উদ্যোগ নিলেও হলে বৈধভাবে সিট বরাদ্দ হয়নি। চাঁদাবাজি, যৌন নিপীড়ন, শিক্ষার্থী ও সাংবাদিকদের মারধরসহ নানা অপকর্ম হয়েছে এই উপাচার্যের সময়ে। নানা ঘটনায় ছাত্রলীগের ৫৮ নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করলেও পরবর্তী সময়ে ৫৬ জনকেই মাফ করে দেন তিনি। ছাত্রলীগ নেতাদের কাছে জিম্মি ছিলেন শিরীণ আখতার। দায়িত্বের শেষ দিনে তিনি ৩৭ কর্মচারী নিয়োগ দেন। তাদের বেশির ভাগই ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা ও তাদের সুপারিশ করা ব্যক্তি। দায়িত্বের চার বছরে ৫৪০ শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন শিরীণ আখতার। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হয়েছে অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতি।
এসব বিষয়ে ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘আমার আগের অন্য সব উপাচার্য যেভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন আমিও সেভাবে কার্যকাল শেষ করেছি। সিন্ডিকেট ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের বাইরে গিয়ে আমি কোনো নিয়োগ দেইনি। আমার বিরুদ্ধে অর্থ লেনদেনের কোনো অভিযোগ কেউ প্রমাণ করতে পারবে না।’
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে যোগাযোগ করা হলেও ড. আনোয়ারুল আজিম আরিফ ও ড. শিরীণ আখতার সাড়া দেননি। তবে দায়িত্ব ছাড়ার সময় দুই উপাচার্যই নিজেদের নির্দোষ দাবি করেছিলেন। সমকাল