ডেস্ক রির্পোট:- রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর সায়দাবাদ এলাকায় তিন শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। নিহতদের মধ্যে দুজনের পরিচয় পাওয়াগেছে। তারা হলেন- মো. সাইদুল ইসলাম ইয়াসিন (১৯) মো. সাঈদ আরাফাত শরীফ (২০)। অপরজনের পরিচয় এখনো জানা যায়নি। নিহত ইয়াসিনের মা শিল্পী আক্তার জানান, আমরা যাত্রাবাড়ীর ধলপুর বউবাজার এলাকায় বাসা ভাড়া থাকি। আমার ছেলে কুতুবখালী এলাকার একটি মাদ্রাসায় লেখাপড়া করতো। সে কোরানে হাফেজ ছিল। গত ১৫ দিন ধরে ইয়াসিন ফারহান নামে একজনের সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় কাজ করছিল। কখনো রাস্তার যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করতো। কখনো আবার বাজারের দ্রব্যমূল্যের খোঁজ নিতো।
মঙ্গলবার সকালেও সে ওই সেচ্ছাসেবকের কাজ করতে বাসা থেকে বের হয়। এরপর ওর সঙ্গে আমার ফোনে বেশ কয়েকবার কথা হয়। রাত ২টার সময় আমি ওকে ফোন করি বাড়ি আসার জন্য। ও আমাকে বলে আমি যাত্রাবাড়ী থানার সামনে ট্রাফিকের ডিউটি করছি মা। আমি তখন ওর কাছে শুনি-তুমি কী খাওয়া-দাওয়া করছো? না হরে বাসায় চলে আসো। খেয়ে নেও। তখন ও আমাকে বলে-মা আমি এখনই খাবো। এরপর রাত সাড়ে চারটার দিকে আমি আবারও ইয়াসিনকে ফোন দিয়ে বলি বাবা আমি আর জেগে থাকতে পারছি না। তুমি বাসায় চলে আসো। তুমি কী খাবার খেয়েছে কিনা? তখন সে আমাকে বলে, আমি খেয়ে নিছি। এতো রাতে এখন আর বাসায় যাবো না। তুমি ঘুমাও। আমি সকালে চলে আসবো। এরপর আমি ঘুমিয়ে যাই। সকালে হঠাৎ আমার কাছে একটা ফোন আসে। আমার আগে যেই বাসায় ভাড়া থাকতাম সেই বাসার মালিকের স্ত্রী সকাল ৬টার দিকে আমাকে ফোন দিয়ে বলেন-ভাবি আপাদের খোঁজ করতে তিনটা ছেলে আসছিল।
তারা বলেছে- ইয়াসিন নাকি কী করেছে, ওকে যাত্রাবাড়ী থানায় নিয়ে গেছে। ওকে অনেক মারধর করেছে। আপনারা থানায় যান। ফোন পেয়ে আমি তখন তড়িঘড়ি অটো রিকশা নিয়ে থানার দিকে রওনা দিই। রিকশা রাস্তার উল্টো পাশে নামিয়ে দেয়। সেখান থেকে দৌড়ে আমি থানায় যাই। দেখি- অনেক মানুষ ওদেরকে ঘিরে রেখেছে। আর আমার কলিজার টুকরো ছেলেটা মাটিতে পড়ে রয়েছে। ওর সারাগায়ে কালি মাখানো। চোখ উল্টাচ্ছে। কথা বলার মতো শক্তি নেই। তখন আমি সকলকে বলি, আমার ছেলে কী করেছে তাতো আমি জানি না। সে সব পরে বিচার করবো। আগে আমার ছেলেটাকে হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করে দেন। ওর যানটা বাঁচান। তখন কয়েকজন শিক্ষার্থী আমার ছেলেকে গাড়ীতে তুলে দেয়। তখনও ইয়াসিন আমার সঙ্গে কথা বলছিল। ও বলছিল- মা আমাকে আশেপাশের হাসপাতালে নিয়ে যাও। আমি কিছু করিনি। ওরা ধর্ষণের মিথ্যা অপবাদ দিয়ে আমাদেরকে পিটাইছে। ওরা আমাদেরকে এখানে আর কাজ করতে দেবে না। এই জন্যই ওরা আমাদেরকে এভাবে অপবাদ দিয়ে মেরেছে। আমি মনে হয় আর বাঁচবো না। আমি তখন ওকে বলি-বাবা তুমি মনে সাহস আনো । তোমার কিছুই হবে না। আমরা এখনই হাসপাতালে পৌছে যাবো। তুমি কোনো অপরাধ করোনি তোমার মা আছে তোমার সঙ্গে। এরপর ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যায় আমার ছেলে। বেলা ১১টায় ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করে। নিহত ইয়াসিনের মা শিল্পী আক্তার বলেন, আমার ছেলে দিন-রাত পরিশ্রম করেছে এই দেশের জন্য। আমার ছেলেও তো মানুষ। একটা পশুকেও তো এভাবে কেউ পিটিয়ে মারতে পারে না। আর আমার ফুলের মতো সন্তানকে এভাবে মেরে ফেলা হলো। যারা এই কাজটা করলো, তারা কী মানুষের জন্ম? তিনি বলেন, আমার ছেলে একজন কোরানে ফাফেজ। সে কখনো ধর্ষনের মতো কাজ করতে পারে না। ষড়যন্ত্র করে আমার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা এর বিচার চাই। নিহত ইয়াসিনের বাবা সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আমার এক ছেলে এক মেয়ে। কেউ কখনো আমারে ছেলে-মেয়ের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ তোলেনি। কুতুবখালী বড় মদ্রাসার ছাত্র সে। আর তাকেই এভাবে ষড়যন্ত্র করে অপবাদ দিয়ে পিটিয়ে মারা হলো! আমরা এই হত্যাকারীদের বিচার চাই।
সাঈদের চাচাতো ভাই সাইফুল বলেন, নিহত মো. সাঈদ আরাফাত শরীফ নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার কদমির চর গ্রামের কবির হোসেনের ছেলে। বর্তমানে তারা যাত্রাবাড়ীর টনি টাওয়ার এলাকায় ভাড়া থাকতেন। তিনি বলেন, আমার ভাই গত বছর ক্লাস আইটে পড়তো। পড়া-লেখায় ভালো না হওয়াই এই বছর গ্যাপ দিয়েছে। এই ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই ও এর সঙ্গে জড়িত ছিল। এই জন্য ৪৮ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের এক নেতা ওকে দেখে নেয়ার হুমকি দেয়। এরপর সরকার পতন হলে সাঈদকে আমরা এলাকায় নিয়ে যাই। সেখানে থাকাকালীন ওর বন্ধুরা ট্রাফিকের দায়িত্ব ও রাতে পাহাড়া দেয়ার জন্য ফোন করে আসতে বলে। ও সপ্তাহখানেক ধরে ডাকাত আতঙ্কে তারা রাত জেগে এলাকায় পাহাড়া দিতো। কয়েকদিন আগে তারা একটা ডাকাত ধরছিল। তখন স্থানীয় সুমন কাউন্সিলর ওকে বিভিন্নভাবে হুমকি দেয়। আমি ওকে বলি- তুই একটু সাবধানে চলাচল কর। এরপরও মঙ্গলবার রাতেও সে পাহাড়া দিতে যায়। পরে সকালে আমরা খবর পাই- আমার ভাইকে গণধর্ষণের অভিযোগে কে বা কারা পিটিয়ে হত্যা করেছে। তিনি বলেন, এইটা সম্পূর্ণ্য মিথ্যা কথা। আমার ভাই এই কাজ করতে পারে না। সে এই ধরণের মানুষই না। ওকে ষড়যন্ত্র করে হত্যা করা হয়েছে। আমরা এই হত্যাকারিদের বিচার চাই।
এবিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক মো. বাচ্চু মিয়া মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, যাত্রাবাড়ি থেকে মারধরের শিকার তিনজন তরুণকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসা হয়েছিল। আমরা জানতে পেরেছি যাত্রাবাড়ী সায়দাবাদ এলাকায় ধর্ষণের অভিযোগে গণধোলাইয়ের শিকার হয় ওই তিন শিক্ষার্থী। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় সকাল ১১টার দিকে তাদেরকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসলে চিকিৎসক তাদেরকে মৃত ঘোষণা করেন। মরদেহগুলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মর্গে রাখা হয়েছে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট থানাকে অবগত করা হয়েছে।