ডেস্ক রির্পোট:- ঘটনাবহুল ৫ আগস্টের দুপুরে ঢাকা থেকে দিল্লির কাছে প্রায় একইসঙ্গে দুটো অনুরোধ আসে। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর নেতৃত্বের সঙ্গে গণভবনে যে বৈঠকের পর শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে ইস্তফা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, এটা ঠিক তার পরের ঘটনা।
প্রথম অনুরোধটা আসে সরাসরি শেখ হাসিনার কাছ থেকে। তিনি ‘তখনকার মতো’ ভারতে আসতে চান, দিল্লির কাছে সেই ‘অ্যাপ্রুভাল’ (অনুমোদন) চেয়ে অনুরোধ জানান।
দ্বিতীয় অনুরোধটাও প্রায় একইসঙ্গে আসে। আর এটা বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের (সশস্ত্র বাহিনী?) কাছ থেকে। তাতে শেখ হাসিনাকে বহনকারী একটি সামরিক বিমানের জন্য ভারতে যাওয়ার ‘ফ্লাইট ক্লিয়ারেন্স’ চাওয়া হয়। সেই অনুমতি মেলার পর অবশেষে সোমবার সন্ধ্যায় শেখ হাসিনাকে নিয়ে ওই বিমান দিল্লির কাছে অবতরণ করে।
কোনও ‘অজানা’ সূত্র নয়– ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর নিজেই আজ মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) বিকালে ভারতীয় পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় তার বিবৃতিতে এই তথ্যগুলো জানিয়েছেন। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে ভারত সরকার অবশেষে তার নীরবতা ভেঙেছে।
কিন্তু দিল্লির কাছে হিন্ডন এয়ারবেসে নামার পর ঠিক কীভাবে পুরো একটা দিন কাটলো শেখ হাসিনার?
দিল্লিতে নামার পর প্রথমেই তাকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানান ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালসহ কয়েকজন কর্মকর্তা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দূত হিসেবেই অজিত ডোভাল সেখানে গিয়েছিলেন।
তারপর বিমানঘাঁটির টার্মিনাল ভবনের লাউঞ্জে চা-পান করতে করতে তাদের মধ্যে বেশ খানিকক্ষণ কথাবার্তাও হয়।
১১দিল্লির কাছে গাজিয়াবাদে হিন্ডন বিমানবন্দর, যেখানে শেখ হাসিনা সোমবার এসে নামেন
শেখ হাসিনার কন্যা সাইমা ওয়াজেদ পুতুল, যিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক মহাপরিচালক হিসেবে গত বছর থেকে অনেকটা সময় দিল্লিতেই থাকেন, ঘটনাচক্রে গতকাল শহরে ছিলেন না। বাংলা ট্রিবিউন জানতে পেরেছে, তিনি তখন থাইল্যান্ডে অবস্থান করছিলেন। দিল্লিতে নামার পর থাইল্যান্ড থেকেই মা-র সঙ্গে তার সরাসরি কথা হয়, পরে তিনি দিল্লির উদ্দেশেও রওনা হয়ে যান।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ও এর মধ্যে একাধিকবার মা-র সঙ্গে ফোনে কথা বলেন।
এখানে অবশ্য একটা জিনিস স্পষ্ট করে নেওয়া দরকার, শুরুতে ভারত ভেবেছিল শেখ হাসিনার ভারতে নামাটা একটা সাময়িক যাত্রাবিরতি মাত্র। তিনি নিজেও যখন ভারতের কাছে অ্যাপ্রুভাল চান, সেটাও ছিল ‘তখনকার মতো’ নামার অনুমতি। কাজেই দিল্লিতে কর্মকর্তারা ধরেই নিয়েছিলেন, তিনি হয়তো এখানে কয়েক ঘণ্টা কাটিয়েই তৃতীয় কোনও দেশের উদ্দেশে রওনা হয়ে যাবেন, যেটা হবে তার চূড়ান্ত গন্তব্য।
সেই তৃতীয় গন্তব্যটা যে ব্রিটেন হতে যাচ্ছে, সে ব্যাপারেও মোটামুটি ভারতীয় কর্মকর্তারা নিশ্চিত ছিলেন।
১২এই কমপ্লেক্সের ভেতরেই আপাতত রাখা হয়েছে শেখ হাসিনাকে
তার একটা প্রধান কারণ ছিল, শেখ হাসিনার সঙ্গেই ছিলেন তার বোন শেখ রেহানাও– যিনি নিজে একজন ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী। শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক ব্রিটেনের শাসক দল লেবার পার্টির একজন সিনিয়র এমপিও বটে। শেখ হাসিনা নিজেও বহুদিন লন্ডনে কাটিয়েছেন।
তারপর ব্রিটেনের যেহেতু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ক্ষমতাচ্যুত নেতানেত্রীদের রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার পুরনো ইতিহাস আছে, তাই এখানেও কোনও সমস্যা হবে না বলেই ধরে নেওয়া হয়েছিল।
বস্তুত সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ (শেখ হাসিনার বিমান হিন্ডনে অবতরণের ঘণ্টাখানেক পরেই) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র বাংলা ট্রিবিউনকে জানায়, “উনি দিল্লিতে নেমেছেন একটা ‘স্টপওভার’ হিসেবে। আমরা ধারণা করছি রাত ৯টার দিকেই তিনি আবার লন্ডনের পথে রওনা হয়ে যাবেন।”
বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর যে সিজে-১৩০ ট্রান্সপোর্ট এয়ারক্র্যাফটটি শেখ হাসিনাকে দিল্লি নিয়ে এসেছিল, সেটিই তাকে লন্ডনে নিয়ে যাবে, নাকি ভারতের কোনও বিমানে বা নিয়মিত কমার্শিয়াল ফ্লাইটে তারা যাবেন– সেটা নিয়েও আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছিল।
১৩শেখ হাসিনা ও অজিত ডোভাল (ফাইল ছবি)
কিন্তু সন্ধ্যার পর ক্রমশ এটা স্পষ্ট হতে থাকে যে ব্রিটেন যত সহজে আশ্রয়ের আবেদন মঞ্জুর করবে বলে ভাবা হয়েছিল, বিষয়টা তত সহজ হবে না। রাতের দিকে দিল্লিতে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার লিন্ডি ক্যামেরন ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে অনানুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দেন যে ওই আবেদন এখন বিবেচনাধীন আছে, সিদ্ধান্ত নিতে সময় লাগতে পারে।
তারপরই জরুরি ভিত্তিতে ফিনল্যান্ডসহ একাধিক স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়– যাতে অন্তত সাময়িকভাবে হলেও সেখানে শেখ হাসিনা আশ্রয় নিতে পারেন। কিন্তু রাতের মধ্যে এ ব্যাপারে বিশেষ আর কোনও অগ্রগতি হয়নি।
ওদিকে ততক্ষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাসভবনে ভারতের মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটির (ক্যাবিনেট কমিটি অন সিকিওরিটি বা সিসিএস) জরুরি বৈঠক বসেছে, যেখানে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে বিশদে আলোচনা হচ্ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনসহ সিনিয়র কর্মকর্তারা সেই বৈঠকে অংশ নেন।
ওদিকে রাতেই আর শেখ হাসিনার রওনা হওয়া হচ্ছে না, এটা বুঝেই তাকে ও শেখ রেহানাকে হিন্ডন এয়ারবেসের টার্মিনাল লাউঞ্জ থেকে সরিয়ে নিয়ে আসা হয়। বাংলা ট্রিবিউন জানতে পেরেছে, কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে তাকে রাখা হয় হিন্ডন থেকে কিছুটা দূরে গাজিয়াবাদের ইন্দিরাপুরমে আধাসামরিক বাহিনীর একটি অতিথিনিবাস বা ‘সেফ হাউসে’।
মঙ্গলবার বিকালে এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তারা দুজনে সেখানেই আছেন। পরে অবশ্য তাদের অন্য কোনও জায়গাতেও (যা আরও বেশি সুরক্ষিত ও গোপন রাখা সহজ) সরিয়ে নেওয়া হতে পারে।
ইতোমধ্যে ভারত সরকার এটা উপলব্ধি করেছে, খুব চট করে হয়তো শেখ হাসিনার ভারত ছেড়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এমনকি, বাংলাদেশ নিয়ে মঙ্গলবার সকালে ভারত সরকার পার্লামেন্ট অ্যানেক্সি ভবনে যে সর্বদলীয় বৈঠক ডেকেছিল, সেখানেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ইঙ্গিত দেন যে শেখ হাসিনা ‘আপাতত’ ভারতেই থাকছেন।
তিনি সেখানে আরও বলেন, শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারত সরকারের ‘প্রাথমিক আলোচনা’ হয়েছে। ‘নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার জন্য ভারত তাকে আরও সময় দিতে চায়’, এস জয়শঙ্করকে উদ্ধৃত করে এমন কথাও জানিয়েছে কোনও কোনও সূত্র।
১৪ভারতের পার্লামেন্টে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে বলছেন এস জয়শঙ্কর
এদিকে মঙ্গলবার সকাল ৯টা নাগাদ বাংলাদেশ এয়ারফোর্সের সিজে-১৩০ এয়ারক্র্যাফটটি টেক অফ করলে ভারতের সংবাদসংস্থা এএনআই খবর দেয় যে ‘শেখ হাসিনাকে নিয়ে উড়ে গেল বিমান’। কিছুক্ষণ পরেই অবশ্য তারা ভুল সংশোধন করে জানায় যে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা ওই বিমানে চেপে ঢাকায় ফিরে গেছেন, শেখ হাসিনা ওই বিমানে ছিলেন না।
ফলে আপাতত রীতিমতো একটা অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যেই দিল্লিতে ২৪ ঘণ্টা অতিবাহিত করলেন শেখ হাসিনা।
গত রাতে ও আজ তাকে দেখেছেন, এমন একজন কর্মকর্তা বলছিলেন, ‘মানসিকভাবে তিনি যতই বিপর্যস্ত হন, বাইরে থেকে তিনি তা একেবারেই বুঝতে দিচ্ছেন না। স্বাভাবিকভাবেই কথাবার্তা বলছেন, আলোচনা করছেন। শারীরিকভাবেও সুস্থই আছেন!’বাংলা ট্রিবিউন