শিরোনাম
‘চার মাসে সেনাবাহিনীর ১২৩ সদস্য হতাহত’ এবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার চাইবে পিলখানায় শহীদ পরিবারের সদস্যরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মন্ত্রণালয়ের ৯ নির্দেশনা রাঙ্গামাটি শহর থেকে উদ্ধারকৃত বন মুরগি কাপ্তাই ন্যাশনাল পার্কে অবমুক্ত বান্দরবানে মোটরসাইকেল চোর সিন্ডিকেটের হোতা রাহুল তঞ্চঙ্গ্যা গ্রেফতার রাঙ্গামাটিতে চট্টগ্রামে আইনজীবি হত্যার প্রতিবাদ মানববন্ধন বান্দরবানে নাশকতা মামলায় দুই চেয়ারম্যান কারাগারে বিচারপতি নিয়োগে কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে ছাপিয়ে ২২৫০০ কোটি টাকা ৬ ব্যাংককে দেওয়া হলো, রবিবার থেকে সংকট কাটছে আইনজীবী সাইফুল হত্যা ও চিন্ময় কৃষ্ণ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনার বিবৃতি

কেন মানুষ চিকিৎসা নিতে বিদেশ যায়?

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় শনিবার, ১৩ জুলাই, ২০২৪
  • ৮১ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসার জন্য বিদেশমুখী প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। নানা কারণে বিদেশ যাচ্ছেন রোগীরা। দেশে চিকিৎসা করাতে গিয়ে ঘাটে ঘাটে ভোগান্তিতে পড়েন তারা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আস্থার সংকট রয়েছে চরমে। বিদেশ থেকে ফিরে আসা রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিদেশে স্বল্পমূল্যে চিকিৎসা করানো, উচ্চমানের চিকিৎসা সুবিধা পাওয়া যায়। দ্রুত রোগ নির্ণয় ও সঠিক চিকিৎসা হয়। চিকিৎসকরা আন্তরিক ব্যবহার করেন। পর্যাপ্ত সময় ও মনোযোগ দেন চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্টরা। প্রতি বছর দেশের কী পরিমাণ নাগরিক চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাচ্ছেন, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে এর কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলেছেন, চিকিৎসার জন্য বিদেশমুখী প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে।

দু’-তিন বছরের তুলনায় কয়েকগুণ বেড়েছে সংখ্যাটি। তাদের এক গবেষণার প্রাথমিক তথ্যে দেখা গেছে, বছরে ৯ থেকে ১০ লাখ মানুষ বিদেশে চিকিৎসার জন্য যাচ্ছেন।

এক্ষেত্রে বিদেশগামী রোগীদের চিকিৎসাসেবার গন্তব্য হিসেবে শীর্ষে থাকা দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে ভারত, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও তুরস্ক। এ ছাড়া চীন, জাপান, কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ায় গিয়েও অনেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
নানা কারণে দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছেন বাংলাদেশিরা। কারণগুলো হলো বিদেশে অভিজ্ঞ চিকিৎসক, কম চিকিৎসা ব্যয়, সঠিক রোগ নির্ণয় ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা, চিকিৎসা চলাকালে চিকিৎসা সহ নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা, রোগীদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা, ভালো ব্যবহার, মানসম্মত চিকিৎসা, রোগীদের জন্য চিকিৎসকদের পর্যাপ্ত সময় ব্যয়, চিকিৎসা পেতে কম সময় অপেক্ষা ও সার্বিক স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মান ভালো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিদেশে চিকিৎসার জন্য যাওয়া রোগীদের সর্বোচ্চসংখ্যক হলেন ক্যান্সারের রোগী, যা মোট বিদেশগামী রোগীর ২১ শতাংশ। এরপর ১৮ শতাংশ যাচ্ছেন হৃদরোগের চিকিৎসা নিতে। এ ছাড়া বাকিরা যাচ্ছেন প্রজনন জটিলতা, অর্থোপেডিক চিকিৎসা, গ্যাস্ট্রোঅ্যান্ট্রোলজি, লিভার, কিডনি, চোখ, কান ও স্নায়বিক চিকিৎসার জন্য। গবেষণায় বহু কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে, যা বহির্মুখী চিকিৎসা পর্যটনের জন্য দায়ী। এর মধ্যে রয়েছে অদক্ষ জনবল, সেবা দেয়ার জন্য স্বাস্থ্যসেবা শিল্প, স্বাস্থ্য নীতি ও কৌশল বাস্তবায়নের অনুপস্থিতি। স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি, নগণ্য সংখ্যক মানবসম্পদ ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, উন্নত ও আধুনিক প্রযুক্তির অনুপস্থিতিও উঠে এসেছে গবেষণায়। এ ছাড়াও গবেষণায় ডাক্তার এবং চিকিৎসাকর্মীদের আচরণগত কারণে মানুষ বিদেশে ভালো চিকিৎসার সন্ধানে যাচ্ছেন। ওই গবেষণায় বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয় স্বাস্থ্য খাতে উন্নতির জন্য। চিকিৎসকদের জন্য মূল্যায়ন প্রোগ্রাম নিতে হবে। এ ছাড়া সরকার থেকে উচ্চ চিকিৎসা শিক্ষা এবং দক্ষতা বাড়ানোর জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এর মাধ্যমে বিদেশে গিয়ে চিকিৎসকরা তাদের একাডেমিক মান উন্নয়ন করতে পারবেন এবং অভিজ্ঞতা যা রোগীদের রোগ সংক্রান্ত যেকোনো জটিল কেস পরিচালনা করতে সাহায্য করবে। ডাক্তারদের উচিত পর্যাপ্ত সময় এবং প্রয়োজন অনুযায়ী প্রতিটি রোগীর প্রতি মনোযোগ দেয়া।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশের অনেকেই বিদেশে যেয়ে থাকেন। এদেরকে আমরা দু’টি শ্রেণিতে ভাগ করতে পারি। বিত্তশালীরা, সাধারণ বা জটিল, যেকোনো রোগ হলেই বিদেশে চলে যান চিকিৎসা করাতে। আর মধ্যবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্তদের চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে হয় যখন বাংলাদেশের ডাক্তাররাই পরামর্শ দেন বা এখানে চিকিৎসা করানোর পরও যখন কোনো উন্নতি দেখা যায় না। প্রথম দলটি যান ইচ্ছা হলেই, আর দ্বিতীয় দলটিকে যেতে হয় বাধ্য হয়ে।

আর্থিক দিক থেকে কম শক্তিশালী (মধ্যবিত্ত) পরিবারের লোকজন ভারতে, বিশেষ করে কলকাতা বা অন্য কোনো শহরে; আর ধনী ব্যক্তিরা থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর বা অন্যান্য দেশে যান। আর দরিদ্র পরিবারের রোগীরা দেশের সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা পেলেই যথেষ্ট, বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করানোর কথা স্বপ্নেও ভাবেন না।

দেশের বাইরে চিকিৎসা গ্রহণে বিপুল পরিমাণ ব্যয় এখানকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ওপর আস্থার সংকটকেই সামনে নিয়ে আসছে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, দেশে বিগত বছরগুলোয় সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো বেড়েছে। চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি সেবার পরিধিও প্রসারিত হয়েছে। কিন্তু সে অনুপাতে আস্থা তৈরি হয়নি। আবার দেশের সব অঞ্চলে সমানভাবে বিশেষায়িত সেবা পৌঁছেনি। নির্ভুল রোগ নিরীক্ষা, বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা না পাওয়ার পাশাপাশি চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগও দীর্ঘদিনের। এসব সংকটের কারণে রোগীদের বড় একটি অংশ চিকিৎসার জন্য যাচ্ছেন বিদেশে। সাধারণ মানুষ সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য গিয়ে কাঙ্ক্ষিত সেবা না পেলে বেসরকারি হাসপাতালে যায়। যখন সেখানেও প্রয়োজনীয় সেবা মেলে না, তখন যাদের সক্ষমতা রয়েছে তারা বিদেশে চলে যান চিকিৎসার জন্য।

রোগীর চাপ বেশি থাকায় ভারত, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরের কয়েকটি হাসপাতাল ঢাকায় তাদের দপ্তরও খুলেছে। এসব অফিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাদের মাধ্যমে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়া রোগীদের সিংহভাগই এদেশে বিভিন্ন হাসপাতাল ও চিকিৎসকের কাছে আগে চিকিৎসা নিয়েছেন। কেউ কেউ কয়েক বছর ধরে চিকিৎসা নিয়েও কোনো নিরাময় পাননি। কোনো কোনো রোগীর অবস্থা আবার সংকটাপন্ন। কেউ সঠিক চিকিৎসার অভাবের কথা বলেন আবার কেউ আস্থার অভাবের কথা বলেন। বিশেষ করে ক্যান্সার, হৃদরোগ, কিডনি, স্নায়বিক, চক্ষুসহ বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি রোগের চিকিৎসার জন্য রোগীরা তাদের কাছে আসছেন।

কেস স্টাডি: ৬ বছর আগের ঘটনা। বেসরকারি খাতের উচ্চপদস্থ বিশিষ্ট এক ব্যক্তি হঠাৎ হার্টের সমস্যায় গিয়েছিলেন রাজধানীর বারিধারাস্থ নামিদামি একটি বেসরকারি হাসপাতালে। দেশের হাসপাতালটির চিকিৎসকরা তাকে সঠিক চিকিৎসা দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন বলে তিনি অভিযোগ করেন। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে ওই রোগী বলেন, চিকিৎসার শুরুতেই চিকিৎসকরা আমার ঘাড়ের বাম পাশে ৫ থেকে ৬টি ছিদ্র করার চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে রোগী নিজেই প্রতিবাদ করে উঠেন। চিকিৎসকদের এই কাজ বন্ধ করার অনুরোধ করেন। ওই মুহূর্তে রোগীর স্বজনরা ওই হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবার প্রতি আস্থা রাখতে পারছিলেন না। ফলে তারা দ্রুত এয়ার এম্বুলেন্সে রোগীকে থাইল্যান্ডে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে রোগী জানান, আমার স্বজনরা থাইল্যান্ডের হাসপাতালে পৌঁছার আগেই আমাকে বহনকারী এয়ার এম্বুলেন্সটি হাসপাতালে পৌঁছে যায়। সেখানকার চিকিৎসকরা প্রাথমিক পর্যায়ে আমাকে দেখার পর শোয়া থেকে উঠে বসতে বলেন। থাইল্যান্ডের হাসপাতালের চিকিৎসকরা অধীনস্থ স্টাফদের দ্রুত নির্দেশ দিলেন আমাকে খাবার দিতে। এই কথা শুনে রোগী অর্ধেক সুস্থ অনুভব করেন বলে তিনি মন্তব্য করেন। খাবার গ্রহণের মাঝামাঝি সময়ে রোগীর স্বজনরাও হাসপাতালে রোগীর সামনে উপস্থিত হন। ওখানে চিকিৎসার পর তিনি সুস্থ হন। এখনো সুস্থ আছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি আরও জানান, থাইল্যান্ডের যে হাসপাতালে তিনি চিকিৎসা নিয়েছিলেন সেখানকার চিকিৎসকরা আধুনিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তারা চিকিৎসা শাস্ত্রের নতুন নতুন বিষয়ে প্রশিক্ষণের জন্য আমেরিকা ও সুইডেনের মতো দেশে যান। কিন্তু বাংলাদেশের চিকিৎসকদের মধ্যে বিষয়টি যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জটিল রোগে ভুগছিলেন। প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি দেশে চিকিৎসকদের শরণাপন্ন হন। কিন্তু কোনো কিছুতেই সুস্থ হচ্ছিলেন না। পরে তিনি এবং তার পরিবার চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিলেন দেশের বাইরে চিকিৎসা করাবেন। সম্প্রতি ওই রোগী তার দপ্তরে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে জানান, আমার চিকিৎসায় ভরসা পাচ্ছিলাম না। তাই দেশের বাইরে যাওয়ার চিন্তা করলাম। অনেকটা আস্থা হারিয়ে ফেলেছি। পরে ধারদেনা করে থাইল্যান্ডে গিয়েছি। ওখানে চিকিৎসায় মোট তার ২০ লাখ টাকার উপরে খরচ হয়েছে বলে জানিয়েছেন। এখন কেমন আছেন-জানতে চাইলে হাসিমুখে তিনি বললেন, আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভালো আছি।

দেশের বেসরকারি একটি ব্যাংকের ম্যানেজার পর্যায়ে চাকরি করেন ‘ম’ আদ্যাক্ষরের এক কর্মকর্তা। তিনি গত দু’বছর আগে মস্তিষ্কের সমস্যার কারণে ভারতে চিকিৎসা করাতে গিয়েছিলেন। সম্প্রতি এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি দেশের দু’-একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতের ওপর আস্থা না থাকায় ভারতে চিকিৎসা করানোর জন্য গিয়েছেন। এখন সুস্থ।

গত বছরের মে মাসে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক জার্নাল ফ্রন্টিয়ার্সে ‘ডিটারমিনেন্টস অব বাংলাদেশি পেশেন্টস ডিসিশন মেকিং প্রসেস অ্যান্ড স্যাটিসফেকশন টুওয়ার্ড মেডিকেল ট্যুরিজম ইন ইন্ডিয়া’ শীর্ষক এক গবেষণাপত্র প্রকাশ হয়। এতে বলা হয়, ভারতের হাসপাতালগুলোতে বছরে বাংলাদেশি রোগী প্রায় সাড়ে চার লাখ। তবে মেডিকেল ভিসা ছাড়াও অন্যান্য ভিসা নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানোর তথ্যও রয়েছে। ওই গবেষণায়ও রোগীদের বিদেশমুখিতার পেছনে বাড়তি চিকিৎসা ব্যয়, দীর্ঘসূত্রতা, চিকিৎসার সহজলভ্যতার অভাবসহ বিভিন্ন কারণকে দায়ী করা হয়।

জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, দেশে সরকারি হাসপাতালে অবহেলা ও সংকট বেশি। আর বেসরকারি হাসপাতালগুলোর বাণিজ্যিক মনোভাবের কারণে সেবা নিয়ে তাদের মধ্যে সতর্কতা কম। ফলে আর্থিকভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের বড় একটি অংশ দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ওপরে ভরসা করছেন না। বহু রোগী বেসরকারিতে সর্বোচ্চ খরচ করেও ভালো সেবা পাচ্ছেন না। অব্যবস্থাপনা ও জবাবদিহিতার অভাবে সঠিক সেবা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। একই সঙ্গে চিকিৎসার ক্ষেত্রে বেড়েছে ব্যক্তির নিজস্ব খরচও (আউট অব পকেট পেমেন্ট)। বর্তমানে চিকিৎসা খাতে আউট অব পকেট ব্যয়ের দিক থেকে বিশ্বের শীর্ষে থাকা দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। এখানকার রোগীদের মোট ব্যয়ের ৬৮ দশমিক ৫ শতাংশ আউট অব পকেট পেমেন্ট। ২৩ শতাংশ ব্যয় করে সরকার এবং বাকিটা এনজিওরা।

দেশের জনস্বাস্থ্যবিদ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শক কমিটির সদস্য ড. আবু জামিল ফয়সাল এ প্রসঙ্গে বলেন, বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার অনেক কারণ রয়েছে। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কোথায় মানসম্পন্ন নেই। গুণগত সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের দেশে রোগীদের প্রতি চিকিৎসকদের মনোযোগ নিয়ে অনেক বিরূপ প্রতিক্রিয়া রয়েছে। রোগীর প্রতি চিকিৎসক, নার্স ও প্যারামেডিকেল কেউ আন্তরিক নন। এখানে চিকিৎসকদের সতর্ক ও সেবাদানের পরিপূর্ণ মানসিকতা থাকতে হবে। তিনি বলেন, যতদিন পর্যন্ত চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা তৈরি হবে না, ততদিন চিকিৎসার জন্য মানুষের বিদেশমুখিতা ঠেকানো যাবে না। আস্থা সৃষ্টির জায়গায় বড় প্রভাবক হলো চিকিৎসক। প্রযুক্তিগত নতুন নতুন জ্ঞানের অভাব রয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে আমাদের চিকিৎসকদের খাপ খাওয়াতে হবে।

১০ রোগের চিকিৎসায় মানুষ বিদেশ বেশি যাচ্ছে: মোটা দাগে ১০ রোগের চিকিৎসা নিতে দেশের বাইরে যাচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে ক্যান্সার (২১ শতাংশ), কার্ডিওভাসকুলার বা হৃদরোগের চিকিৎসা (১৮ শতাংশ), অর্থোপেডিক সার্জারির জন্য (৬ শতাংশ), কসমেটিক সার্জারি (৯ শতাংশ), বন্ধ্যত্ব (১৩ শতাংশ), ইএনটি (নাক-গান-গলা, ৩ শতাংশ), নিউরোলজি ৪ শতাংশ), স্থূলতা (২ শতাংশ), চোখের সমস্যার কারণে (২ শতাংশ), লিভার রোগ (৬ শতাংশ)। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়া মোট রোগীর অর্ধেকেরও বেশি, অর্থাৎ ৬১ শতাংশ পুরুষ ও বাকি ৩৯ শতাংশ নারী। বিশেষ করে সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডে যেসব রোগী যায়, তাদের বেশির ভাগই পুরুষ। এই সংখ্যা যথাক্রমে ৬৪ ও ৬৯ শতাংশ। কিন্তু ভারতে যাওয়া রোগীদের অর্ধেক নারী ও অর্ধেক পুরুষ। এই সংখ্যা যথাক্রমে ৪৯ শতাংশ ও ৫১ শতাংশ।

গবেষণায় দেখা যায়, ভারতে একজন রোগী যদি হাসপাতালে বহির্বিভাগে গিয়ে ডাক্তার দেখান তাহলে তার গড়ে ৭৫ হাজার টাকা, মিডিয়াম খরচ ৬০ হাজার টাকা আর সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকা ব্যয় করেছেন যারা বিদেশ থেকে গেছেন। সিঙ্গাপুরে গড়ে ৩ লাখ ৩০ হাজার ৫৬৮ টাকা, সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা, মিডিয়াম ২ লাখ ৫২ হাজার ৪৫৬ টাকা খরচ করেছেন চিকিৎসা বাবদ। থাইল্যান্ডে একজন রোগী গড়ে ২ লাখ ৯২ হাজার ৫২০ টাকা, মিডিয়াম ১ লাখ ৭০ হাজার ৫২০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ৩ লাখ ৮৫ হাজার টাকা ব্যয় করেছেন হাসপাতালে। অন্যদিকে, হাসপাতালে ভর্তি রোগীর ক্ষেত্রে খরচ হয়েছে ভারতে গড়ে ২ লাখ ৫০ হাজার ৭৬৮ টাকা, মিডিয়াম ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা এবং সর্বোচ্চ ১৩ লাখ টাকা। সিঙ্গাপুরে গড়ে ১১ লাখ ৭৪ হাজার ৩৬৭ টাকা, মিডিয়াম খরচ হয়েছে ৮ লাখ ৯০ হাজার ৫০০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। থাইল্যান্ডে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা, গড়ে ৮ লাখ ৯৪ হাজার ৫২০ টাকা এবং মিডিয়াম ৬ লাখ ৮৪ হাজার ৭৩২ টাকা ব্যয় করেছেন বাংলাদেশ থেকে যাওয়া একজন রোগী ওই দেশের হাসপাতালে। সাধারণত গবেষণায় বেশির ভাগ উত্তর দাতা বলেছেন, ১১ থেকে ২০ দিন ছিলেন সেখানে। এটা একবার চিকিৎসা করাতে গিয়ে তারা খরচ করেছেন। বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়া রোগীদের বেশির ভাগই ১৫-৬৫ বছরের মধ্যে কর্মক্ষম মানুষ, যা মোট রোগীর ৮৪ শতাংশ। রোগীদের অর্ধেকেরও বেশি, অর্থাৎ ৬১ শতাংশই পুরুষ, বাকি ৩১ শতাংশ নারী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পিএইচডি শিক্ষার্থী মুনিরা সুলতানার ২০২০ সালের নভেম্বরের গবেষণাপত্র ‘ফ্যাক্টর অ্যাফেক্টিং আউটবাউন্ড মেডিকেল ট্যুরিজম: এভিডেন্স ফ্রম বাংলাদেশ’ এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

মন্ত্রী যা বললেন: চিকিৎসার জন্য মানুষ কেন দেশের বাইরে যাচ্ছেন-জানতে চাইলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী অধ্যাপক ডা. সামন্তলাল সেন মানবজমিনকে বলেন, দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে মানুষের মধ্যে আস্থা নেই। তাই মানুষ চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাচ্ছেন। আস্থা ফিরানোর চেষ্টা করছি। তিনি বলেন, যাদের টাকা পয়সা আছে তারা চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাচ্ছেন। করোনার সময় আমরা তো চিকিৎসা দিয়েছি। তখন তো তারা বিদেশ যায়নি। তিনি বলেন, আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি আস্থা ফিরানোর।
এর আগে ২৮শে জানুয়ারি ২০২৪ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন জানিয়েছিলেন, দেশের চিকিৎসার ওপর মানুষের আস্থা নেই। আস্থাহীনতার কারণে মানুষ বিদেশে চিকিৎসা নিতে যান। চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নতি করে দেশের মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে চান নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। অন্যদিকে তৃণমূল পর্যায়ে মানুষ আস্থা না পেয়ে ঢাকায় চলে আসছেন। ঢাকা থেকে মানুষ বিদেশ যাচ্ছেন চিকিৎসা নিতে। সবখানেই একটা আস্থাহীনতা কাজ করছে মানুষের মধ্যে। সেটি আমি বুঝি। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, স্বাস্থ্যসেবার মান এমনভাবে বাড়াতে হবে, এমন কিছু কাজ করতে হবে, যাতে মানুষ স্বাস্থ্যসেবা নিতে আস্থার অভাবে না ভোগেন। এর জন্য তিনি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে বিকেন্দ্রীকরণ করবেন বলে জানান। দেশের মানুষের স্বাস্থ্য সম্পর্কে ধারণার ঘাটতি আছে উল্লেখ করেন সামন্ত লাল সেন।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) স. ম. মাহবুবুল আলম, সিনিয়র কনসালটেন্ট ও ল্যাব কো-অর্ডিনেটর, প্যাথলজি বিভাগ, এভার কেয়ার হাসপাতাল ২০২১ সালের ১৯শে ডিসেম্বর তার এক প্রবন্ধে বলেছেন, বাংলাদেশের রোগীদের চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা ক্রমবর্ধমান। বিদেশ থেকে ফেরা রোগীদের বর্ণনা থেকে যে প্রধান কারণগুলো স্পষ্ট হয়, তা তিনি তুলে ধরেন। ১. বিদেশে স্বল্পমূল্যে চিকিৎসা করানো যায়। ২. উচ্চমানের চিকিৎসা সুবিধা পাওয়া যায়। দ্রুত রোগ নির্ণয় ও সঠিক চিকিৎসা হয় এবং ৩. চিকিৎসকরা আন্তরিক ব্যবহার করেন। পর্যাপ্ত সময় ও মনোযোগ প্রদান করেন। তিনি আরও বলেন, রোগ নিরাময়ের জন্য, কষ্ট লাঘবের জন্য রোগীরা দেশের ভেতরে এক চিকিৎসক থেকে আরেক চিকিৎসকের কাছে, এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে দৌড়াতে থাকেন। নিরুপায় মানুষ অপচিকিৎসা বা বিকল্প চিকিৎসা যেমন ঝাড়ফুঁক, কবিরাজের দ্বারস্থ হয়। ক্যান্সার ধরা পড়ার পরে বা দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত রোগীদের বিশেষায়িত চিকিৎসার খোঁজ করা প্রত্যাশিত। অত্যাধুনিক প্রাগ্রসর (হাই-অ্যান্ড) চিকিৎসাসেবা এখনো আমাদের দেশে অপ্রতুল। যতটুকু গড়ে উঠেছে তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। অত্যাধুনিক প্রাগ্রসর চিকিৎসা গ্রহণের জন্য তাই আমাদের দেশের রোগীদের প্রায়ই বিদেশে যেতে হয়। বিদেশের তালিকায় প্রথমত পড়ে ভারত, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া। যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশও আছে অতি ধনীদের পছন্দের তালিকায়। বিদেশগামী বাংলাদেশি রোগীদের সবচেয়ে বড় গন্তব্য পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত। বাংলাদেশের চিকিৎসকদের দক্ষতা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে অনেক উঁচুতে পৌঁছেছে। কিন্তু আমাদের সার্বিক চিকিৎসা সেবা পার্শ্ববর্তী দেশের করপোরেট হাসপাতালগুলোর চেয়ে এখনো অনুন্নত, দুর্দশাগ্রস্ত ও অপ্রতুল। আমাদের চিকিৎসাসেবায় উচ্চ ব্যয় কমাতে না পারলে ও সেবার মান উন্নত করতে না পারলে দেশের রোগীদের চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়া ঠেকানো যাবে না এবং সুস্থ বেসরকারি চিকিৎসাসেবা খাতও গড়ে উঠবে না।মানবজমিন,বেহাল স্বাস্থ্যখাত- ১

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions