সৈয়দ ইবনে রহমত:- ২০০৮ সালের এপ্রিলের ঘটনা। আঞ্চলিক পরিষদ থেকে প্রকাশিত এক চিঠিতে পার্বত্য তিন জেলায় বিজু পালনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। অথচ, তার কয়েক বছর আগে থেকে ত্রিপুরাদের বৈসুক, মারমাদের সাংগ্রাই এবং চাকমাদের বিজুকে একসাথে বৈসাবি নাম দিয়ে পালন করা হচ্ছিল। কিন্তু সেই বছর আঞ্চলিক পরিষদ বৈসাবি বাদ দিয়ে শুধু বিজু পালনের ঘোষণা দেওয়াতে পাহাড়ের অপর বৃহৎ দুটি জনগোষ্ঠির মানুষ তথা মারমা ও ত্রিপুরারা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। সে সময় মারমা এবং ত্রিপুরাসহ আরো বেশ কিছু জনগোষ্ঠির নেতৃবৃন্দকে প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখেছি। বৈসাবি বাদ দিয়ে আঞ্চলিক পরিষদ থেকে বিজু উদযাপনের চিঠিকে তারা চাকমাদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন হিসেবেই দেখেছিলেন এবং তার প্রতিবাদে নিজেদের উদ্যোগে আলাদা আলাদাভাবে বৈসুক ও সাংগ্রাই উদযাপন করেছিলেন। বিষয়টি সে সময় অনেকদূর গড়িয়েছিল।
সেই প্রেক্ষাপটেই পার্বত্য তিন জেলার মারমা-ত্রিপুরাসহ অন্যান্য ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠির নেতাদের নিয়ে চন্দ্রঘোনায় এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় পাহাড়ের তিন জেলা থেকে মারমা, ত্রিপুরা, পাংখো, লুসাই, বম, মুরং, তঞ্চঙ্গাসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠির শতাধিক নেতা উপস্থিত হয়ে চাকমাদের কাছে তারা কীভাবে বঞ্চিত হয়ে আসছেন সে ব্যাপারে তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। সভায় যোগদানকারীদের মতামতের ভিত্তিতেই চাকমা বাদে অন্য জনগোষ্ঠিগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি বিকল্প সংগঠন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়। যদিও জেএসএসের হুমকি ধামকির কারণে শেষ পর্যন্ত সংগঠনটি আর দাঁড়াতে পারেনি।
যাহোক, সেখানে উপস্থিত বান্দরবানের এক বম নেতা পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাধিপত্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করতে গিয়ে নিজের কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছিলেন। চাকমাদের কাছে বমসহ অন্যান্য জনগোষ্ঠির মানুষ কীভাবে নিপীড়িত, বঞ্চিত হচ্ছে তার উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করেছিলেন। তিনি অবশ্য জেএসএস সন্তু গ্রুপের সাথে আগেও ছিলেন, যতদূর জানি এখনো তিনি একই দলের নেতা হিসেবেই আছেন। ওই বম নেতা বলেন, তখন আঞ্চলিক পরিষদের তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির বিভিন্ন পদে লোক নিয়োগ হচ্ছিল। তিনি তার নিজ জনগোষ্ঠির এসএসসি পাস একটি ছেলেকে নিয়ে গেলেন আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তু লারমার কাছে। অনুরোধ করে বললেন, বম সম্প্রদায়ের মানুষ শিক্ষা-দীক্ষায় খুবই পিছিয়ে আছে। তাদের মধ্যে সরকারি চাকরিজীবী নাই বললেই চলে। ছেলেটি মেধাবী এবং তখন পর্যন্ত তার এলাকার একমাত্র এসএসসি পাস। তার পরিবার খুবই দরিদ্র বলে আর পড়াতে পারছে না। ছেলেটিকে যদি আঞ্চলিক পরিষদের যেকোনো একটি পদে চাকরি দেয়া যায় তাহলে তার পরিবারের অভাব যেমন মিটবে, তেমনি হয়তো প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে আরো কিছুদূর পড়াশোনারও সুযোগ পাবে।
কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, সেদিন সন্তু লারমা তার নিজ দলের একজন অনুগত এই নেতার অনুরোধে বম জনগোষ্ঠির সেই ছেলেটিকে চাকরি দেয়ার ব্যাপারে কোনোভাবেই রাজি হননি। একই সভায় খাগড়াছড়ির একজন মারমা নেতা বলেছিলেন, অন্যান্য জায়গায় আন্তঃধর্মের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে প্রেম-বিয়ের মাধ্যমে ধর্মান্তরিত হওয়ার ঘটনা ঘটে। সাধারণত যে এলাকায় যে ধর্মের প্রভাব বেশি থাকে আন্তঃধর্মের বিয়ের ক্ষেত্রে অন্য ধর্মের তরুণ বা তরুণীটি নিজ ধর্ম ত্যাগ করে প্রভাবশালী ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়। একইভাবে পাহাড়ের আন্তঃজাতিগোষ্ঠির তরুণ-তরুণীদের মধ্যে প্রেম-বিয়ের অনেক ঘটনায় জাত পরিবর্তনের ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে, প্রেম বা বিয়ের ক্ষেত্রে তরুণ বা তরুণীর যেকোনো একজন যদি চাকমা জনগোষ্ঠির হন, তাহলে এক্ষেত্রে অন্য জাতের তরুণ বা তরুণীটি নিজ জনগোষ্ঠির জীবন ও সংস্কৃতি পরিত্যাগ করে চাকমা জাতিগোষ্ঠির জীবন-সংস্কৃতি গ্রহণ করে চাকমা হয়ে যায়। ওই মারমা নেতা এমন কয়েকটি জুটির উদাহরণ দিয়ে প্রশ্ন রেখে বলেন, চাকমারা অন্য জনগোষ্ঠিগুলোকে কোণঠাসা করে পাহাড়ের নিজেদের কতটা বেশি প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে, একটু চিন্তা করলে এসব ঘটনার মাধ্যমেই তা ভালো করে বুঝা যায়।
চুক্তির পূর্বে শান্তিবাহিনীতে ছিলেন এমন বেশ কয়েকজন নেতাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাদের বক্তব্য থেকেও জানা গিয়েছিল নানা বঞ্চনার কথা। শান্তিবাহিনীতে চাকমা ব্যতিত অন্য জনগোষ্ঠি থেকে আসা সদস্যদের কতটা অবহেলা আর অবমূল্যায়ন করা হতো সেসব কথা। দুই-একটা ব্যতিক্রম ছাড়া নেতৃত্বে যাওয়াটা তো স্বপ্নের মতো বিষয় ছিল, তার চেয়ে বরং ভালো ট্রেনিং, ভালো একটা অস্ত্রের আশা করাও অনেক ক্ষেত্রে অসম্ভব ছিল। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে খাদ্যসামগ্রীসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যোগাড় করা, রান্না করে খাওয়ানো, মালামাল বহন করার কাজেই ব্যবহার করা হতো তাদের। যেকোনো ছোটখাট বিষয়েও তাদের প্রতি সন্দেহ থাকতো চাকমাদের। এই সন্দেহের বশে অনেককে জীবনও দিতে হয়েছে নিজ দলের চাকমা কমান্ডারদের নির্দেশে।
স্বাধীনতার পর থেকেই সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠির শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিং, বিশ^বিদ্যালয়সহ উচ্চ শিক্ষার সকল প্রতিষ্ঠানে ভর্তি কোটা চালু করে। শুরুতে এই কোটার সুযোগ সীমিত থাকলেও ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। শুধু দেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই নয়, বরং অন্যান্য দেশেও বৃত্তি দিয়ে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ দিয়ে পাহাড়ের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠিগুলোর শিক্ষার্থীদের পাঠানো হয়েছে। বিসিএস-সহ সরকারি-আধাসরকারি-স্বায়ত্তশাসিত সকল প্রতিষ্ঠানের চাকরিতে পাহাড়ের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্বার প্রার্থীদের ৫ শতাংশ কোটা দিয়েছে। এসব ক্ষেত্রে এই কোটা সুবিধা দেয়ার কারণ ছিল পিছিয়ে থাকা পাহাড়িদের শিক্ষিত করে, প্রতিষ্ঠিত করে পাহাড়ের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করা। বাস্তবতা হচ্ছে সরকারের দেয়া এসব কোটা সুবিধার সিংহভাগই ভোগ করেছে একটি জাতি তথা চাকমা সম্প্রদায়।
পাহাড়ে বসবাস করা ১১ বা ১৩টি ক্ষুদ্র জাতির মধ্যে জনসংখ্যার দিক থেকে চাকমারা বৃহত্তর। এরপর আছে যথাক্রমে মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গাসহ অন্যান্যরা। চাকমারা শুধু জনসংখ্যার দিক থেকে নয়, বরং তারা বৃটিশদের সাথে লিয়াজু করে চলায় তখন থেকেই শিক্ষা-দীক্ষা, চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে এগিয়ে আছে। আর এগিয়ে থাকার এই সুযোগে তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেও সরকারের দেয়া কোটাসহ সকল সুবিধার অন্তত ৮০ শতাংশ দখল করে রেখেছে। অবশিষ্ট ২০ শতাংশের মধ্যে ১৮ থেকে ১৯ শতাংশ সুবিধা গ্রহণ করছে মারমা এবং ত্রিপুরা জনগোষ্ঠির মানুষ। বাকি ৮ থেকে ১০টি জনগোষ্ঠির মানুষ একত্রে মিলে পেয়েছে মাত্র ১ থেকে ২ শতাংশ সুবিধা। আজকের দিনে এসেও অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠির কপালে এই বঞ্চনার মাত্রা খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। আর সেই বঞ্চনার কথা বলেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছয়টি জনগোষ্ঠির প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন দাবি করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আলোচনায় এসেছে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) এবং তাদের সশস্ত্র শাখা কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ)। তাদের দাবি, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলার ২৬টি উপজেলার মধ্যে ৯টি উপজেলা তাদের পিতৃভূমি। এই ৯টি উপজেলা নিয়ে তাদের নিজস্ব শাসন কায়েম করে দিতে হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা তথা ২৬টি উপজেলার মোট আয়তন ১৩২৯৫ বর্গ কিলোমিটার। কেএনএফ-এর দাবিকৃত ৯টি উপজেলা বাঘাইছড়ি, বরকল, জুড়াছড়ি, বিলাইছড়ি, রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদমের মোট আয়তন ৭৫৬৬.৭৪৭ বর্গ কিলোমিটার। যা পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট আয়তনের ৫৬.৯১ শতাংশ। অন্যদিকে কেএনএফ-এর দাবি মতে, তাদের সাথে আছে বম, পাংখো, লুসাই, খিয়াং, ম্রো, খুমী এই ছয়টি জাতি। ২০২২ সালের জনশুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদন মতে, তিন পার্বত্য জেলা তথা খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি এবং বান্দরবান জেলার মোট জনসংখ্যা ১৮ লাখ ৪২ হাজার ৮শ’ ১৫ জন। অন্যদিকে কেএনএফ ভুক্ত ছয় জাতির মোট জনসংখ্যা মাত্র ৭৬ হাজার ৪শ’ ৯১ জন, যা পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৪.১৬ শতাংশ। ব্যাপারটি দাঁড়ায় এই যে পার্বত্য চট্টগ্রামের ৪.১৬ শতাংশ মানুষ ওই অঞ্চলের মোট আয়তনের ৫৬.৯১ শতাংশ জায়গার উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। প্রশ্ন হলো, বাকি ৯৫.৮৪ শতাংশ মানুষ কি আঙ্গুল চুষবে? তাই এটি যে বাস্তবসম্মত কোনো দাবি নয়, বরং আকাশকুসুম কল্পনা সে ব্যাপারটি তাদের অনুধাবন করতে হবে।
তাছাড়া কেএনএফের মধ্যে বম ছাড়া অন্য জনগোষ্ঠিগুলোর সদস্যদের খুব একটা খুঁজে পাওয়া যায় না, তাই বম ছাড়া অন্যদের মধ্যে কেএনএফের গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু তার বিশ্বাসযোগ্য কোনো প্রমাণ নেই। এমনকি বমদের মধ্যেও যে তাদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে, তার উদাহরণ আছে অনেক। কেএনএফ যে আসলেই তাদের জাতির অধিকার আদায়ের লড়াই করতে সংগঠিত হয়েছে, সে ব্যাপারেও প্রশ্ন তোলার সুযোগ আছে তাদের কর্মকাণ্ডের মধ্যেই। যেমন তাদের সশস্ত্র সন্ত্রাসী তৎপরতার শিকার অন্যরা যতটা না হচ্ছে তার চেয়ে তাদের নিজ জনগোষ্ঠির সাধারণ মানুষই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পুরুষদের পাশাপাশি নারী ও শিশুদেরও সশস্ত্র শাখায় যুক্ত করে তাদের জীবনকেও অনিশ্চিত ও বিপন্ন করে তুলেছে। জঙ্গিদের আশ্রয় এবং প্রশিক্ষণে নিজেদের সম্পৃক্ত করে তাদের আদর্শ, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে অষ্পষ্টতা তৈরি করেছে। নিজেদের এলাকায় বসবাসরত কুকি-চিনসহ অন্যান্য জনগোষ্ঠির চাকরিজীবী থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী এমনকি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ব্যাপক হারে চাঁদাবাজি, যানবাহন থেকে চাঁদাবাজি কোনো আদর্শিক সংগঠনের কাজ হতে পারে না। এগুলো নিছক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ছাড়া অন্য কিছু না। তাছাড়া শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সাথে আলোচনা চলমান অবস্থায় পাহাড়িদের বিভিন্ন গ্রামে চাঁদাবাজি, পর্যটকদের টাকা-পয়সা-মোবাইল ছিনতাই, সর্বোপরি একের পর এক ব্যাংক ডাকাতি, অপহরণ, টাকা-অস্ত্র-গোলাবারুদ লুণ্ঠন কোনোভাবেই আত্মমর্যাদা সম্পন্ন আদর্শিক কোনো দল বা সংগঠনের কাজ হতে পারে না। এটা নিছক একেবারে নিচু শ্রেণির মন-মানসিকতার চাঁদাজ, ডাকাত বা সন্ত্রাসীর কাজ। এই নিচু মানসিকতা নিয়ে জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠায় সফল হওয়ার কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না।
শুরুতে ধারণা করা হয়েছিল, কেএনএফ সদস্যরা উচ্চ শিক্ষিত। তারা তাদের এলাকা এবং সংলগ্ন অঞ্চলের ভূগোল, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির রাজনীতি, আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস অধ্যয়ন করেই বোধহয় মাঠে নেমেছে। কিন্তু বাস্তবতায় তাদের মধ্যে সেই প্রাজ্ঞতার কোনো লক্ষণই দেখা যায়নি। তারা তাদের সশস্ত্র তৎপরতা শুরুর আগে সম্ভাব্য পরিণতিগুলো নিয়ে খুব একটা স্টাডি করেছে বলেও এখন পর্যন্ত প্রমাণ দিতে পারেনি। বরং তারা যা যা করেছে তার মধ্য দিয়ে তাদের উগ্রতা-হিংস্রতা-জেদ দেখানোর মতো হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে দেখা গেছে বার বার। এতে সাময়িক কিছু সাফল্য পেলেও দীর্ঘ মেয়াদে তাদের এবং তাদের জনগোষ্ঠির সাধারণ মানুষের জীবনকে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ফেলেছে, তাদের অস্তিত্বকেই বিলীন করার পথে নিয়ে গেছে, যা তাদের ভাবনাতে ছিল বলে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। যেকোনো বিষয়ে তাদের দুরদর্শী ভাবনার যে অভাব আছে, এর প্রমাণ পেয়েছিলাম সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সক্রিয় তাদের কিছু আইডির ম্যাসেঞ্জারে কথাবার্তা বলে।
তাদের সাথে কথা বলে বুঝতে পারি, শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সাথে দুই-একটা বৈঠক করেই তারা ধারণা করে বসেছিল পরবর্তী বৈঠকেই সবকিছু পেয়ে যাবে। ব্যাপারটি যে খুবই হাস্যকর ছিল তা বলতে না পারলেও, তাদের পরামর্শ দিয়েছিলাম, এই ধরনের পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেশের জনগোষ্ঠিগুলোর ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করতে। অন্তত পক্ষে তাদের সামনে জেএসএসের যে উদাহরণ আছে সেটা বিশ্লেষণ করে দেখতে। কারণ, একটি রাষ্ট্রের পক্ষে কখনো এসব ব্যাপারে হুটহাট সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব না। রাষ্ট্রকে একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, আভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক নানা পক্ষের বিষয় নিয়ে ভাবতে হয়, তারপর সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে হয়। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান আলোচনার জন্য সন্তু লারমাকে জেল থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। এরশাদ সরকার আলোচনা শুরু করেছিল। পরবর্তী বিএনপি সরকারের আমলে তার ধারাবাহিকতা বজায় ছিল। অবশেষে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর একটা পরিণতি এসেছে। সেই তুলনায় কেএনএফ এমন কিছু না যে দুইটা-তিনটা বৈঠকের মাধ্যমেই তাদের সব চাওয়া পাওয়ার পূরণ হয়ে যাবে। তাছাড়া কেএনএফের দাবি বাস্তবায়নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা রাষ্ট্র নয়, বরং জেএসএস। সেটাও বিবেচনায় রাখতে হবে।
কথা বলার সময় তারা ব্যাপারটি বুঝতে পারছে বলে সম্মতি দিয়েছে। কিন্তু পরে ব্যাংক ডাকাতি, অপহরণ, অস্ত্র লুট, ছিনতাইয়ের মতো সন্ত্রাসী কাজে জড়িয়ে প্রমাণ দিয়েছে, আসলে তারা কিছুই বুঝেনি। অথবা যারা আমার সাথে কথা বলেছে, তারা তাদের ঊর্ধ্বতনদের সেটা বুঝাতে পারেনি। ফলাফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দ্বারা আলোচনা ব্যস্তে দিয়েছে, শান্ত পাহাড়কে অশান্ত করেছে। কয়েকটি হামলায় সাময়িক সাফল্য পেয়ে নিজেদের বীরত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে দীর্ঘমেয়াদে নিজেদের অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার আশঙ্কার সৃষ্টি করেছে। ব্যাপারটি কেএনএফ নেতারা বুঝতে না পারলেও কুকি-চিন জনগোষ্ঠিগুলোর সাধারণ মানুষ ভালোভাবেই অনুধাবন করছে। সেকারণেই বম জনগোষ্ঠির সাধারণ মানুষ যেমন আজ কেএনএফের বিরুদ্ধে ব্যানার নিয়ে রাস্তায় নামছে, তেমনি তাদের কমিউনিটি তথা প্রথাগত নেতৃবৃন্দর সংবাদ সম্মেলন করে কেএনএফের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে জানিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে ওয়াকিবহাল যে কারো এটা বুঝতে অসুবিধার কথা নয় যে, কুকি-চিন জনগোষ্ঠিগুলো কোনোভাবেই রাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ নয়। অন্যদিকে কুকি-চিনদের বঞ্চনার জন্যও এককভাবে রাষ্ট্র দায়ী নয়। রাষ্ট্র তার পক্ষ থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে, কিন্তু একদিকে কুকিরা সেটা গ্রহণের মতো নিজেদের যোগ্য করে তুলতে পারেনি। অন্যদিকে জেএসএস তথা চাকমারা তার সিংহভাগ জবরদখল করে ভোগ করছে। আর পাহাড়ে চাকমাদের আধিপত্য বিস্তার যে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সকল স্তরে বিস্তৃত এই লেখার শুরুতে দেয়া কয়েকটি ঘটনার বিবরণ তার বাস্তব প্রমাণ। এমনকি পাহাড়ে এককভাবে বৃহত্তর জনগোষ্ঠি বাঙালিরাও নানাভাবে চাকমাদের কাছে বঞ্চিত হচ্ছে। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে কোনো জনগোষ্ঠির এই একাধিপত্য চিরকাল ধরে চলতে পারে না, তা সংশ্লিষ্ট সবাইকে বুঝতে হবে। তাই যথাযথভাবে এর প্রতিকারের কথাও ভাবতে হবে।
রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিয়ে বঞ্চিতদের প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত করে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সে ক্ষেত্রে কেএনএফ চাইলে সন্ত্রাসের পথ পরিহার করে গঠনমূলক ভূমিকা দ্বারা রাষ্ট্রকে ন্যায় প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করতে পারে। আবার তারা সেটা না করে এতদিন ধরে যে সন্ত্রাসের পথে হেঁটে এসেছে সেই পথেই অবিচল থেকে নিজেদের এবং নিজেদের জাতির অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন হওয়াকেও ত্বরান্বিত করতে পারে। এখন তারা কোন পথে যেতে চায় সেটা তাদেরকেই ঠিক করতে হবে। লেখক: সাংবাদিক ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষক।পার্বত্যনিউজ