ডেস্ক রির্পোট:- ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে গত ১ জুন রাজধানীর পল্লবীর ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল অ্যান্ড কার্ডিয়াক সেন্টারে ভর্তি হয়েছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তা নাদিয়া নূর (৩০)। ভর্তির পাঁচ দিন পরেই মারা যান চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা এই রোগী। চিকিৎসায় অবহেলায় নাদিয়ার প্রাণ গেছে অভিযোগ করে তার স্বামী আনিসুর রহমান পলাশ বলেন, ভর্তির পরে সারা দিনে তার ডায়রিয়া নিয়ন্ত্রণে চলে আসে এবং রাতে আলট্রাসনোগ্রাফি করলে দেখা যায় পেটে ১৬ সপ্তাহের সন্তানও সুস্থ আছে। কিন্তু পরের দিনেই নাদিয়ার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। সে ছটফট করছিল। কিন্তু রাত ১১টা থেকে ডেকেও কোনো ডাক্তারকে রোগীর কাছে আনা যায়নি। বারবার ডাকার পর রাত ২টায় ডাক্তার এসে যখন দেখলেন ততক্ষণে ওর শারীরিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে শুরু করে। আইসিইউতে নেওয়া হয়। এ সময় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় রোগীকে আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার। আইসিইউর দায়িত্বরতদের এ সিদ্ধান্ত জানালে তারা পোশাক বদলের কথা বলে এই রোগীকে দুই ঘণ্টা কোনো ধরনের স্যালাইন, অক্সিজেন ছাড়াই ফেলে রাখে। এতে ওর অবস্থা খারাপ হলে অন্য হাসপাতালে নিতে পারিনি। এরপর পেটে বাচ্চাটা মারা যায়, নাদিয়া লাইফসাপোর্টে চলে যায়। হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা ও চিকিৎসকদের অবহেলায় প্রাণ হারায় আমার স্ত্রী, মা হারা হয়েছে আমার চার বছরের ছেলে। শুধু এ হাসপাতাল নয়, দেশের অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতালে সেবা নিতে এসে রোগীর ভোগান্তি নিত্যচিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব ক্লিনিকে সেবার নামে চলছে ব্যবসা। আর এর বলি হতে হচ্ছে রোগীদের। অতি মুনাফালোভী এই ব্যবসায়ীদের ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হচ্ছে অসংখ্য পরিবার। এর বাইরে অপচিকিৎসায় অঙ্গহানি, সেবা নিতে এসে তিক্ত অভিজ্ঞতা তো আছেই। দেশের স্বাস্থ্যসেবায় আস্থাহীনতার কারণে বিদেশগামী রোগীর ভিড় বাড়ছে। ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দূতাবাসে মেডিকেল ভিসার জন্য যাওয়া মানুষের ভিড় ঊর্ধ্বমুখী। দেশের সরকারি হাসপাতালে অব্যবস্থাপনা, সংকট, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা। বেসরকারিতে রয়েছে আস্থার সংকট, প্রতারণার ফাঁদ। উচ্চবিত্তের বিদেশ যাওয়ার প্রবণতাকে এসব কারণ আরও উসকে দিচ্ছে। ভালো সেবার আশায় মধ্যবিত্ত এমনকি নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষও ছুটছেন বিদেশ। মনোযোগ দিয়ে রোগীর কথা না শোনায় বেশ কিছু চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। অনেক চিকিৎসক বিদেশে তিন দিন, ছয় দিনের ট্রেনিংয়ে অংশ নিয়ে সেগুলোও লিখে রাখেন নেমপ্লেটের পাশে। যাতে নামের পাশে এগুলোকে ডিগ্রি মনে করে রোগীরা ভিড় করেন ওই চিকিৎসকের চেম্বারে। রাজধানীর লালমাটিয়া এলাকার বাসিন্দা নাজনীন নাহার বলেন, বেসরকারি হাসপাতালের চেম্বারে ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলাম। আমরা সন্তান নেওয়ার চেষ্টা করছি কিন্তু বারবার সন্তান পেটে আসার পর নানা জটিলতা তৈরি হয়ে গর্ভপাত হচ্ছে। আমি মানসিকভাবেও বিধ্বস্ত। গত সপ্তাহে একজন ডাক্তার দেখিয়েছি। প্রায় ৩০ হাজার টাকার টেস্ট করিয়েছি। এন্ড্রোক্রাইনোলজির এই চিকিৎসক আমার কথাও শুনলেন না, আগের টেস্টগুলোও দেখলেন না। ওই টেস্টগুলো আবার দিয়ে তিনি যেখানে চেম্বার করছেন সেই হাসপাতাল থেকে করে নিয়ে আসতে বললেন। চিকিৎসকের এ ব্যবহারে আমি মানসিকভাবে আরও ভেঙে পড়ি।’ তার স্বামী ফয়সাল আহমেদ বলেন, ‘সমস্যায় না পড়লে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ফাঁকফোকর জানা যায় না। সেবা দেওয়ার নামে কিছু চিকিৎসক এবং হাসপাতালের অনৈতিক বাণিজ্য আমরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। প্রায় দেড় লাখ খরচ হয়ে গেছে কিন্তু সন্তান না হওয়ার কারণটাই কেউ এখনো জানতে পারিনি। ডাক্তারের কাছে গেলেই তারা শুধু টেস্টের লিস্ট ধরিয়ে দেয়।’ সারা দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে হাসপাতাল, ক্লিনিক, ব্লাড ব্যাংক। পরপর রোগী মৃত্যুর ঘটনায় দেশজুড়ে আলোচনা চলছে বেসরকারি হাসপাতালের সেবা নিয়ে। তাই স্বাস্থ্য খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে এসব হাসপাতালের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে স্বাস্থ্য অধিদফতর। জানা যায়, বিভিন্ন সময় অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে অভিযানে নামে স্বাস্থ্য অধিদফতর। বেশ কিছু দিন এই অভিযান চললেও পরবর্তীতে তা ঝিমিয়ে পড়ে। ২০২০ সালে এমন অভিযানে নেমেছিল স্বাস্থ্য অধিদফতর। কিন্তু মালিকপক্ষের চাপে অভিযান আলোর মুখ দেখেনি। ফলে অবৈধ অনেক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। ২০২২ সালের ২৫ মে আকস্মিক ঘোষণা দিয়ে অবৈধ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযানে নামে স্বাস্থ্য অধিদফতর। সেই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে অভিযান অব্যাহত রাখার সুপারিশ করেছিলেন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিশিষ্টজনরাও। এমনকি এ কার্যক্রমকে স্বাগত জানিয়েছিল বাংলাদেশ বেসরকারি হাসপাতাল মালিক সমিতিও। ওই সময় বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানকে জরিমানাসহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। লাইসেন্স নবায়নের সময়ও বেঁধে দেওয়া হয় কিছু প্রতিষ্ঠানকে। কিন্তু তারা কোনো তোয়াক্কাই করেনি। কারণ, লাইসেন্স নবায়ন করতে গেলেই যে সেবার শর্তগুলো পূরণ করতে হবে। অনেক প্রতিষ্ঠানের সেই শর্ত পূরণের সক্ষমতাও নেই। আবার কিছু প্রতিষ্ঠানের অনীহাও রয়েছে। পরবর্তীতে অভিযানের গতি কমে এলে আবারও সক্রিয় হয়ে ওঠে অবৈধ সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো। গত বছর ডেঙ্গুর ব্যাপকতা বাড়ার সুযোগ নিয়ে আবার দৌরাত্ম্য বাড়লে অবৈধ সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে আবারও অভিযানে নামে স্বাস্থ্য অধিদফতর। কিন্তু সেটিও ঝিমিয়ে পড়ে। খতনা করাতে গিয়ে শিশু মৃত্যুর ঘটনায় আবারও মাঠে নামে স্বাস্থ্য অধিদফতর। কিন্তু এখন অনেকটাই ঝিমিয়ে পড়েছে অভিযান।বাংলাদেশ প্রতিদিন