ডেস্ক রির্পোট:- ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় বাংলাদেশের ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজিম আনার খুন হয়েছেন। নিহতের লাশ পাওয়া নিয়ে ধূ¤্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। গতকাল বুধবার সকালে কলকাতার নিউটাউনের সঙ্গে সঞ্জীবা গার্ডেনস নামে একটি আবাসনের ফ্ল্যাটে তার লাশ উদ্ধারের খবর মিললেও এখন পুলিশ সূত্র বলছে, লাশ উদ্ধার হয়নি। তবে এমপি আনার যে কক্ষে ছিলেন সেখানে রক্তের দাগ দেখা গেছে।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার একটি বাড়িতে আনোয়ারুল আজিম আনার এমপি হত্যাকা- নিয়ে দুই দেশে তোলপাড় চলছে। সর্বত্রই আলোচনা কিভাবে এমপি খুন হলেন? কেন তাকে খুন করা হলো? এক সময়ের মাদক স¤্রাট আজিম হত্যার নেপথ্যের রহস্য কি? কলকাতায় হত্যাকা-ের ঘটনায় বাংলাদেশে ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা দায়ের করেছেন নিহতের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন। তিনি মামলার এজাহারে ‘পরিকল্পিতভাবে হত্যা’ উল্লেখ করেছেন। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) এইচ এম আজিমুল হক জানান, তদন্তপূর্বক আসামিদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, আনোয়ার আজিমের হত্যাকা- দুঃখজনক, মর্মান্তিক, অনভিপ্রেত। যে ফ্ল্যাটে তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়েছিল, কলকাতা পুলিশ সেখানে লাশ পায়নি। কীভাবে হত্যাকা- ঘটানো হয়েছে, সে বিষয়ে তদন্ত চলছে। এ নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিস্তারিত বলবে। আমরা মিশনের মাধ্যমে খোঁজ রাখছি। মিশন কলকাতা পুলিশের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে। যেহেতু তদন্তাধীন বিষয়, তাই এ বিষয়ে বেশি কিছু বলা যাচ্ছে না।
ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য মো. আনোয়ারুল আজিম (আনার) ২০১৪ সালে এমপি হওয়ার আগে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ‘মাদক স¤্রাট’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। পুলিশি গ্রেফতার এড়াতে তিনি ১৪ বছর আত্মগোপনে ছিলেন। তিন বারের এমপি আনোয়ারুল আজিম গত ১২ মে চিকিৎসার জন্য ভারতের পশ্চিমবঙ্গে যান। এরপর বরানগরে মন্ডলপাড়ার পূর্বপরিচিত গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে ওঠেন। ১৩ মে তিনি নিখোঁজ হন বলে গত ১৮ মে বরানগর থানায় ডায়েরি করেন গোপাল বিশ্বাস। স্বজনরা পশ্চিমবঙ্গ ও দিল্লিতে গিয়ে হন্যে হয়ে তাঁকে খোঁজেন। কিন্তু তার অবস্থান সম্পর্কে কোনো তথ্য মিলছে না। অতঃপর গত ২১ মে নিখোঁজ এমপির মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন রাজধানীর মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে গিয়ে পিতার নিখোঁজের তথ্য জানান। তিনি তার পিতাকে খুঁজে বের করার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অনুরোধ করেন।
বাংলাদেশের একটি গোয়েন্দা সূত্র জানায়, পরিবারের পক্ষ থেকে এমপি আজিম একা ভারতে গেছেন বলে শুরু থেকে প্রচার করা হলেও আসলে তার সঙ্গে আরো দু’জন ছিলেন। তারাও বাংলাদেশি বলে এখন পর্যন্ত তথ্য মিলেছে। সিসিটিভি ক্যামেরার কিছু ফুটেজে ভারতীয় গোয়েন্দারা এমন তথ্য পেয়েছেন। ওই দুই ব্যক্তির নাম-পরিচয় সম্পর্কে জানানো হয়, দু’জনই এমপি আজিমের দীর্ঘদিনের পরিচিত। কলকাতা পুলিশের ধারণা, দুই দেশের দুষ্কৃতকারীরা ঘটনায় জড়িত। ওই আবাসনের ৫৬ নং রুমে তাকে হত্যার পর টুকরো করা হয়েছে এবং সেখান থেকে লাশের টুকরো কোথাও ‘গায়েব করে ফেলেছে’ দুষ্কৃতকারীরা। পুলিশ নিশ্চিত যে, এমপি আনার হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আনোয়ারুল আজিম আনারকে কলকাতার নিউটাউনে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে। ভারতীয় পুলিশ আমাদের জানিয়েছে, আনোয়ারুল আজিম খুন হয়েছেন। এটা সুনিশ্চিত। কারা খুন করেছে? এই খুনের মোটিভ কী? এগুলো খুঁজে বের করতে ভারতীয় পুলিশ কাজ করছে। বাংলাদেশের পুলিশও কাজ করছে। এ বিষয়ে ভারতীয় পুলিশের সঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশ সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছে। ভারতীয় পুলিশের তথ্য অনুযায়ী আনোয়ারুল আজিম খুনের সঙ্গে সম্পৃক্তদের মধ্য থেকে ৩ অপরাধীকে আমাদের পুলিশ ধরেছে। আটক আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। ঘটনার তদন্ত চলছে। ঝিনাইদহ একটি সন্ত্রাসপ্রবণ এলাকা। আনোয়ারুল আজিম তিনবার সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তিনি কলকাতায় চিকিৎসা করাতে যাওয়ার পরই ঘটনাটি ঘটে। শিগগিরই খুনের মোটিভ খুঁজে বের করা হবে। ভারতীয় পুলিশ আমাদের সব ধরনের সহযোগিতা করছে। লাশ এখনও আমাদের কাছে আসেনি বা পৌঁছায়নি। আমরা আরও কিছু তথ্য পেয়েছি। সেগুলো এখনই প্রকাশ করতে চাচ্ছি না। আনোয়ারুল সাহেব কোথায় খুন হয়েছেন? কে কে খুন করেছে? কোন অস্ত্র দিয়ে খুন হয়েছেন? সব কিছুই তদন্ত শেষ হলে পরে জানানো হবে। এই ঘটনাটি ভারত-বাংলাদেশের পুলিশ তদন্ত করছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই হত্যাকা-ের কারণে ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কে ছেদ পড়বে না। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ। সম্পর্কের ফাটল ধরবে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। কারণ, আনোয়ারুল আজিম হত্যার ঘটনায় ভারতের কেউ জড়িত হননি। এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে যা তথ্য রয়েছে- আমাদের দেশের মানুষই তাকে হত্যা করেছে।
ফেরদৌস ডরিন গোয়েন্দা পুলিশকে পিতার খোঁজ করার অনুরোধ জানানোর পর পুলিশ তদন্ত শুরু করে। কলকাতার বাংলাদেশ উপ-দূতাবাসে আনারের খোঁজ নেন ঢাকার গোয়েন্দারা। কর্তৃপক্ষ ভারতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে সহযোগিতা চায়। এরপরই তদন্তে জোর আসে। এরপর খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, এমপি আনারের মোবাইল ফোনের শেষ অবস্থানস্থল (লোকেশন) ঝাড়খন্ড রাজ্যে। কিন্তু কলকাতা পুলিশের কিছু সূত্র মাধ্যমে নিশ্চিত হয়, এমপি ঝাড়খন্ডে যাননি। তার মোবাইল ফোন অন্য কেউ নিয়ে গেছে সেখানে। যাতে তদন্তে বিঘœ ঘটানো যায়। স্বর্ণ চোরাচালান নিয়ে সৃষ্ট বিরোধের জের ধরে তাকে হত্যা করা হতে পারে এমন মোটিভ নিয়ে এগোচ্ছে পুলিশ।
ওদিকে এমপি আনার কলকাতায় যার বাসায় উঠেন সেই গোপাল বিশ্বাস থানায় নিখোঁজের ডায়েরি করেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, এমপি আনার ডাক্তার দেখাতে ১২ মে সন্ধ্যা ৭টার সময় তার বাড়িতে আসেন। পরের দিন দুপুর ১টা ৪৫ মিনিটে ডাক্তার দেখানোর জন্য ওই বাড়ি থেকে বের হন। যাওয়ার সময় বলে যান, ‘আমি দুপুরে খাব না, সন্ধ্যায় ফিরে আসব’। তারপর তিনি সন্ধ্যাবেলা না ফিরে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করে জানান, ‘আমি বিশেষ কাজে দিল্লিতে চলে যাচ্ছি। ফোন করবো, তোমাদের ফোন করার দরকার নেই’। এরপর ১৫ মে বেলা ১১টা ২১ মিনিটে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করে জানান, ‘আমি দিল্লিতে পৌঁছেছি। আমার সাথে ভিআইপিরা আছেন। ফোন করার দরকার নেই’। এই একই মেসেজ নিজের বাড়িতে এবং নিজের পিএকে ফরওয়ার্ড করেছিলেনে এমপি।
তখনই কলকাতা পুলিশের সন্দেহ হয়। ওই ক’দিনে একবারও ফোনে কথা না বলে কেন তিনি (এমপি আনার) মেসেজ করছেন। এরপরই শহরের বিভিন্ন সিসিটিভি ফুটেজ দেখে পুলিশ। তখন তারা নিশ্চিত হয়, এমপি আনার কলকাতার বাইরে যায়নি। বরং কেউ তার মোবাইল ফোন ঝাড়খন্ড পর্যন্ত নিয়ে যায়।
এরপর বিভিন্ন সিসিটিভি ফুটেজ ও সূত্র ধরে তদন্ত এগোতে থাকে পুলিশের। সে অনুসারে তারা খোঁজ পায়, কলকাতার নিউটাউন লাগোয়া সঞ্জীবা গার্ডেনের। তারা জানতে পারে, ওই আবাসিকের ব্লক-বিইউ ৫৬ নং রুমে এমপি আনারের লাশ টুকরো করে তিনজন দুষ্কৃতকারী। তারপর সেখান থেকে ব্যাগে করে খ-িত লাশ কোনো নর্দমায় ফেলে আসে দুষ্কৃতকারীরা। এই ঘটনায় আরো অনেকে জড়িত বলে ধারণা করছে কলকাতা পুলিশ। পুলিশ ওই ফ্ল্যাটের মালিকের কাছ থেকে জানতে পারে, ফ্ল্যাটটি একজনকে ভাড়া দেওয়া হয়েছিল। একটি সূত্রমতে, সেই ভাড়াটিয়া পুলিশের হাতে গ্রেফতার। কলকাতার পুলিশ আরো বলছে, পূর্বপরিকল্পনা করেই কলকাতায় ডাকা হয়েছিল এমপি আনারকে। দুই দেশের দুষ্কৃতকারী এই হত্যার সঙ্গে জড়িত। তবে তদন্ত কোন দিকে যাবে তা সময়ই বলবে। কিন্তু নিশ্চিত যে, এমপি আনার আর বেঁচে নেই। তবে তার লাশ এখনো উদ্ধার হয়নি। গণমাধ্যমের খবর হলো এমপি আজিমের বিরুদ্ধে স্বর্ণ চোরাচালান, হুন্ডি কারবার, মাদক ও নারী পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এক সময় তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের রেড নোটিশ ছিল। তাই এপার-ওপারের চোরাচালানকেন্দ্রিক বিরোধের জেরে তিনি কোনো ফাঁদে পড়ার ঘটনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
এদিকে গতকাল ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, আনোয়ারুল আজিম বাংলাদেশের কিছু অপরাধীর হাতে নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন। এটি পারিবারিক, আর্থিক, নাকি এলাকার কোনো দুর্বৃত্তকে দমন করার জন্য হয়েছে, তা আমরা তদন্ত করে দেখছি। বিষয়টি নিয়ে আমরা নিবিড়ভাবে ভারতীয় পুলিশের সঙ্গে কাজ করছি। প্রতিক্ষণেই তাদের সঙ্গে আমাদের কথা হচ্ছে। অনেক তথ্য পাচ্ছি। তদন্তের স্বার্থে সেসব বিষয় আমরা বলতে চাচ্ছি না। সংসদ ভবন এলাকা থেকে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন। এ জন্য এ ঘটনায় শেরে বাংলা নগর থানায় আজকের মধ্যে মামলা হবে। তার মেয়ে মামলা করতে সহযোগিতা ও পরামর্শের জন্য আমাদের কাছে এসেছেন। আমরা তার মেয়েকে মামলা করতে সহযোগিতা করব। তিনি আরো বলেন, একজন সংসদ সদস্যকে যেভাবে বাংলাদেশের কিছু অপরাধী নৃশংসভাবে হত্যা করেছে, আমরা তাদের কয়েকজনকে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছি। তদন্তের স্বার্থে আমরা আটক ব্যক্তিদের নাম বলছি না। বাকিদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।
মাদক স¤্রাট থেকে এমপি : আনোয়ারুল আজিম আনারের পৈতৃক বাড়ি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের মধুগঞ্জ বাজার এলাকায়। তিনি কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তিনি ঝিনাইদহ-৪ আসন থেকে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে টানা তিনবার এমপি নির্বাচিত হন।
স্থানীয় সূত্রগুলোর তথ্য হচ্ছে, আনোয়ারুল আজিম আনার এক সময়ের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের চরমপন্থিদের নিয়ন্ত্রণ করতেন। অস্ত্র ও বিস্ফোরকদ্রব্য পাচারের হোতা হিসেবেও পুলিশের খাতায় ছিল তার নাম। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে দীর্ঘদিন ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ও চরমপন্থিদের গডফাদার হিসেবে পরিচিতি পান। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র, বিস্ফোরক, মাদকদ্রব্য ও স্বর্ণ চোরাচালান, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি এবং চরমপন্থিদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে ৯টি মামলা ছিল। ইন্টারপোলের ওয়ান্টেড আসামি হিসেবে পুলিশ একবার আজিমকে গ্রেফতার করলেও তার ক্যাডাররা পুলিশের ওপর আক্রমণ করে তাকে (আজিম) ছিনিয়ে নেয়। ওই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে। পুলিশের গ্রেফতার এড়াতে দীর্ঘ ১৪ বছর তিনি আত্মগোপনে ছিলেন।
ঝিনাইদহের রাজনৈতিক কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এরশাদের শাসনামল তথা ১৯৮৬ সালের দিকে আজিম মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়েন। ভারতের বাগদা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের বাঘাভাঙ্গা সীমান্ত পথে চোরাচালান করতেন। ওই সময় কালীগঞ্জ থানাসহ মহেশপুর, কোটচাঁদপুর ও চুয়াডাঙ্গার জীবননগর থানা পুলিশের সঙ্গে মাসিক চুক্তিতে ‘টোকেন’ তৈরি করে তার বাহিনী। ওই টোকেন দেখালেই প্রশাসনের লোকজন মাদকদ্রব্য বহনকারী গাড়ি ছেড়ে দিত। এই টোকেন বাণিজ্য থেকে আনার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ‘মাদক স¤্রাট’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। এই মাদক কারবারের মাধ্যমে বিপুল অর্থবিত্তের মালিকও বনে যান তিনি। ১৯৯১ সালে আনার ঝিনাইদহের আরেক চোরাকারবারি পরিতোষ ঠাকুরের সঙ্গে মিলে স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তখন তিনি বিএনপির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। স্বর্ণে বড় বড় চালান রাজধানী থেকে বাঘাডাঙ্গা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচার করতেন।
১৯৯৬ সালে আনার বিএনপি থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে যোগ দেন। মাদক ও স্বর্ণ চোরাচালানের কারবারের সঙ্গে কালীগঞ্জ পৌরসভার এক কমিশনারের হাত ধরে অস্ত্র চোরাকারবারে জড়িয়ে পড়েন। তার অবৈধ অস্ত্রের চালান চরমপন্থি ক্যাডার সামসেল ওরফে রবিনের কাছে বিক্রি হতো। কথিত আছে, সরকারের পুরস্কার ঘোষিত শীর্ষ সন্ত্রাসী প্রকাশ ভারতে আত্মগোপন করার পর তার মাধ্যমে অস্ত্র চোরাকারবার চালিয়ে যান আজিম। বাগদা এলাকার মাদক সম্রাট জয়ন্ত কুমার, কার্তিক, গৌতম সাহা ও বনগাঁর দেবদাসের সঙ্গে আনারের মাদকের কারবার ছিল।
সূত্রের দাবি, ২০০৭ সালে চুয়াডাঙ্গার লোকনাথপুর এলাকা থেকে ১২ কেজি ৯৫০ গ্রাম স্বর্ণ আটক করে তৎকালীন সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআর। চোরাকারবারিরা নিশ্চিত হয় যে, দর্শনা শ্যামপুরের সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম স্বর্ণগুলো ধরিয়ে দিয়েছে। ওই ঘটনায় টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হন সাইফুল। তিনি নিজেও স্বর্ণ চোরাকারবারিদের সিন্ডিকেটে যুক্ত ছিলেন। ওই হত্যা মামলায় আনারসহ আসামি করা হয় ২৫ জনকে। কুষ্টিয়ার চরমপন্থি নেতা মুকুল, শাহীন রুমী, ঝিনাইদহের চোরাকারবারি পরিতোষ ঠাকুর, আনারসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে পরের বছর আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। ২০১২ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে রাজনৈতিক বিবেচনায় আজিমসহ বেশ কয়েকজন মামলা থেকে অব্যাহতি পান। এ মামলায় আজিম গ্রেফতারে ২০০৯ সালে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছিলেন চুয়াডাঙ্গার বিশেষ আদালত।
উপজেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে ধীরে ধীরে আনোয়ারুল আজিম আনারের বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো কমে যেতে শুরু করে। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি নির্বাচিত হলে ক্ষমতার দাপটে বেশির ভাগ মামলা থেকে নিজেকে মুক্ত করেন। এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
শোকে স্তব্ধ কালীগঞ্জ : আনোয়ারুল আজিম আনারের নিহত হওয়ার খবর নির্বাচনী এলাকায় পৌঁছলে আত্মীয়স্বজন ও দলীয় নেতা-কর্মীদের মাঝে শোকের ছায়া নেমে আসে। শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়ে গোটা কালীগঞ্জ। শোকে কাতর হতবিহ্বল নেতা-কর্মীরা ছুটে আসেন তার ভুষন পাইলট স্কুলপাড়ার বাড়িতে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গোটা কালীগঞ্জ শহর শোকাতুর হয়ে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। আত্মীয়স্বজনদের পাশাপাশি অনেক নেতা-কর্মীকে বুক চাপড়ে কাঁদতে দেখা যায়। দেশ স্বাধীনের পর ভারতের মাটিতে একজন বাংলাদেশি এমপি খুনের বিচার দাবি করেন কালীগঞ্জের নেতা-কর্মীরা। তারা ভারতের কাছে খুনের জবাবও চেয়েছেন।
ঢাকায় অবস্থানরত এমপির ছোট মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন পিতার মৃত্যুর খবর শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের জানান, যার বাবা নেই, তার দুনিয়ায় কেউ নেই। আমার বাবাকে কেন খুন করা হলো তার জবাব চাই। ছোটবেলায় আমার বাবাকে কাছে পাইনি। কারণ তিনি মামলা-হামলার ভয়ে পালিয়ে বেড়াতেন। এখন বড় হয়ে বাবাকে আর কাছে পাব না। ঘাতকরা আমাকে এতিম করে দিয়েছেন। আমি ঘাতকদের ফাঁসি দেখতে চাই। তিনি কাউকে সন্দেহ করছেন না বলেও জানান।
কালীগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের নেতা মাসুদুর রহমান মন্টু বলেন, আনোয়ারুল আজিম আনার নিরহঙ্কার মানুষ ছিলেন। তিনি রাতদিন মোটরসাইকেলে ঘুরেছেন। তিনি কাউকে কোনোদিন শত্রু মনে করেননি। মানুষের উপকার ছাড়া তিনি কারো ক্ষতি করেননি। কালীগঞ্জের সাবেক পৌর মেয়র মোস্তাফিজুর রহমান বিজু জানান, তিনি ভালোবাসা দিয়ে কালীগঞ্জের মানুষের মন জয় করেছিলেন। মানুষের দুঃখে ছুটে যেতেন। সেক্ষেত্রে রাত-দিন ছিল না। কালীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান শিবলী নোমানী বলেন, কালীগঞ্জবাসী একজন বন্ধু, ভালো পিতা সর্বোপরি একজন অভিভাবককে হারালেন। তিনি বলেন, এভাবে তাকে যে খুন করা হবে তা ভাবতেও অবাক লাগে। তাকে হারিয়ে আমরা মর্মাহত ও বাকরুদ্ধ। তিনি এই হত্যাকা-ের বিচার দাবি করেন।
কালীগঞ্জ উপজেলার ১নং সুন্দরপুর দুর্গাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ওহিদুজ্জামান ওদু বলেন, এমপির সাথে কারো কোনো বিরোধ ছিল না। যা ছিল তা খুবই সামান্য কিন্তু তার জনপ্রিয়তা ছিল অনেক।
পিতা হত্যার বিচার চাই : ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন তার বাবার হত্যার বিচার দাবি করেছেন। গতকাল বুধবার রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার বাবাকে কে এবং কেন হত্যা করেছে তার সুষ্ঠু তদন্ত চাই। আমি এর শেষ দেখতে চাই। কেন তারা আমার বাবাকে মেরেছে? আমার বাবার খুনিদের ফাঁসি দেখতে চাই। তিনি আরো বলেন, আমি মামলা করব। আমি প্রধানমন্ত্রী, ডিএমপি কমিশনার ও ডিবি প্রধানের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখছেন।’ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উদ্দেশে ডরিন বলেন, ‘আমার একটাই অনুরোধ, আমার বাবার হত্যার ন্যায়বিচার করুন। একসময় আমার বাবা মিথ্যা মামলার কারণে ১৪ বছর পলাতক ছিলেন। আমি তখন খুব ছোট ছিলাম।’ এখন আবার তাকে হারালাম। এমপি আনারের সঙ্গে পরিবারের শেষ যোগাযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বাবার সঙ্গে শেষ ভিডিও কলে কথা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, ভারতে যাচ্ছেন এবং দু-একদিনের মধ্যে ফিরে আসবেন।’
সর্বশেষ খবর : কলকাতার নিউটাউনের সঞ্জিবা গার্ডেনের যে ফ্ল্যাটে এমপি আনারের খ-িত লাশ পাওয়া গেছে সেটি ভারতীয় শুল্ক দফতরের একজন কর্মকর্তার। আর তা ভাড়া দেয়া হয়েছিল একজন বাংলাদেশি নাগরিকের কাছে। এই ফ্ল্যাটেই গত ১৩ মে এমপি আনার খুন হয়ে থাকতে পারেন বলে পুলিশ ধারণা করছে। প্রায় ২০০ কোটি টাকার প্রজেক্ট নিয়ে সেখানে আলোচনা হচ্ছিল বলে ভারতীয় পুলিশ ক্লু পেয়েছে। এই চক্রের সাথে মোট ৬ জন জড়িত বলেও ধারণা করছেন তারা। এদের মধ্যে বাংলাদেশি যেমন রয়েছে, আছে ভারতীয় নাগরিকও। এখন এই ২০০ কোটি টাকার ব্যবসা কি আসলেই সত্য? নাকি ব্যবসার এমন টোপ দিয়ে তাকে ফাঁদে ফেলানো হয়েছিল। এমপি আনারের মরদেহের খ-িত অংশ ডিএনএ পরীক্ষার জন্য বুধবার বিকালে পাঠিয়েছে ভারতীয় পুলিশ। রিপোর্ট পাওয়ার পর বিষয়টি আরও নিশ্চিত হওয়া যাবে।