ডেস্ক রির্পোট:- ২০২৩ সালের মার্চে দেশের মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিক বেড়ে ৯ শতাংশে উঠে। এরপর আর কোনো মাসেই মূল্যস্ফীতি এই অঙ্কের নিচে নামেনি। অর্থাৎ টানা ১৪ মাস ধরে দেশের মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের উপরেই অবস্থান করছে। সর্বশেষ গত এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। গতকাল বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত প্রতিবেদনে এই তথ্য পাওয়া গেছে। বিবিএসের সর্বশেষ হিসাব অনুসারে, এপ্রিলে সার্বিক মূল্যস্ফীতি সামান্য কমলেও খাদ্য মূল্যস্ফীতি আবার বেড়েছে। এ মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ১০ দশমিক ২২ শতাংশ, যা মার্চে ছিল ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। এদিকে এপ্রিলেও মূল্যস্ফীতির চেয়ে শ্রমিক মজুরি বৃদ্ধির হার কমে ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ হয়েছে। কেবল এই মাসই নয়, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে টানা ২৭ মাস মূল্যস্ফীতির হারের তুলনায় মজুরি বৃদ্ধির হার কম। এমন পরিস্থিতিতে দেশের নিম্নআয়ের মানুষ অসুবিধায় রয়েছেন।
চারজনের সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তিনি নিজেই। ঢাকায় ইলেকট্রিকের কাজ করেন। মাসে সর্বোচ্চ ১৮ হাজার টাকা আয় করেন। তা দিয়ে সংসার ও সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। আতাউর বলেন, বেতন দিয়ে এখন ডাল-ভাত জোগাড় করাই কঠিন হয়ে গেছে। বাজারে গিয়ে দেখা যায়, আজ এটার দাম বেড়েছে, তো কাল অন্যটার। সন্তানরা বড় হচ্ছে। তাদের লেখাপড়ার খরচও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাদেরকে ভালো জায়গায় পড়াতেও পারছি না। সবমিলিয়ে কষ্টের মধ্যদিয়ে দিন পার করতে হচ্ছে। অন্যদিকে একটি বেসরকারি হাউজিং প্রকল্পে শ্রমিকের কাজ করে রাশেদ মিয়া প্রতিদিন আয় করেন ৭০০ টাকা। এই আয় তার পরিবারের খরচ মেটাতে যথেষ্ট নয়। তিনি বলেন, এই টাকা দিয়ে পাঁচ সদস্যের পরিবার চালানো কঠিন। সবকিছুর দাম বাড়তি। অথচ আয় বাড়েনি।
সবচেয়ে কম মজুরি বাড়ছে শিল্প খাতের শ্রমিকদের: বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিলে গড় মজুরি বৃদ্ধির হার সামান্য বেড়ে ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ হয়েছে। যার মধ্যে কৃষিতে ৮ দশমিক ২৫, শিল্প খাতে ৭ দশমিক ৩৬ ও সেবা খাতে মজুরি সূচক ৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ। অর্থাৎ সবচেয়ে কম মজুরি বাড়ছে শিল্প খাতের শ্রমিকদের।
মূল্যস্ফীতির চাপ বেশি সিলেটে: বিবিএসের বিভাগভিত্তিক হিসাবে দেখা গেছে, সিলেটে মজুরি বৃদ্ধির হার সবচেয়ে কম। এপ্রিলে এই বিভাগে মজুরির হার ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। ফলে সিলেটে মূল্যস্ফীতির চাপ সবচেয়ে বেশি। বিবিএসের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম বিভাগে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৫৭, বরিশালে ৬ দশমিক ৯৬, ঢাকায় ৭ দশমিক ৪১, রাজশাহীতে ৭ দশমিক ২৩, খুলনায় ৭ দশমিক ২৯ এবং রংপুর বিভাগে ৮ দশমিক ২১ শতাংশ। অর্থাৎ সবচেয়ে বেশি মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছে রংপুর বিভাগে।
শহরের চেয়ে গ্রামে কষ্ট বেশি: বিবিএস প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে, মূল্যস্ফীতির হার শহরের চেয়ে গ্রামেই বেশি। সাধারণ, খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত খাতে শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষ বেশি চাপে আছে। এপ্রিলে শহরে সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ, অথচ গ্রামে এই হার ছিল ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। গ্রামে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতির হার ১০ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং খাদ্য বহির্ভূত খাতে ৯ দশমিক ৬০ শতাংশ। অন্যদিকে শহরে সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ। শহরে খাদ্য খাতে ১০ দশমিক ১৯ শতাংশ এবং খাদ্যবহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতির হার হয়েছে ৯ দশমিক ০১ শতাংশ। শহরের তুলনায় গ্রামে সব খাতেই মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে।
বিআইডিএসের জরিপ বলছে খাদ্য মূল্যস্ফীতি আরও বেশি: এদিকে বিবিএসের হিসাবে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ২২ শতাংশ হলেও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) হিসাবে তা ১৫ শতাংশ। বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন বলেছেন, বাড়তি মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্নআয়ের মানুষ অসুবিধায় রয়েছে। সম্প্রতি বিআইডিএসের পক্ষ থেকে দেশের সব জেলা থেকে তথ্য নিয়েছি। এরপর একটি পদ্ধতিতে মূল্যস্ফীতি হিসাব করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১৫ শতাংশ। তিনি বলেন, প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, মূল্যস্ফীতির হার বাড়ার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে মাছের দাম। গত এক বছরে মাছের দাম ২০ শতাংশের উপর বেড়েছে। এরপর রয়েছে পোল্ট্রি মুরগির দাম। দেশের পোল্ট্রি খাদ্যের বড় অংশই আমদানিনির্ভর। গত দুই বছরে আমদানি করা এসব খাবারের দাম কয়েক গুণ বেড়েছে, যা শেষ পর্যন্ত মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে। বিনায়ক সেন মনে করেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে শুধু সুদহার বাড়ানো বা এ রকম পৃথক পদক্ষেপ নিলে হবে না। এর সঙ্গে শুল্ক কমানোসহ সমন্বিতভাবে বেশ কিছু উদ্যোগ নিতে হবে। পোল্ট্রি খাদ্যে শুল্ক কমানো প্রয়োজন। এটি কমানো হলে তা মাছ ও মুরগির মতো পণ্যের দাম কমাতে সহায়ক হবে। এতে মূল্যস্ফীতিও কমবে।
কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, বিবিএস অনেকগুলো বিষয় অ্যাড্রেস না করেই মূল্যস্ফীতির প্রতিবেদন তৈরি করে থাকে। এজন্য প্রকৃত মূল্যস্ফীতির তথ্য উঠে আসে না। প্রকৃতপক্ষে দেশের মূল্যস্ফীতি আরও বেশি। তিনি বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের পাশাপাশি গ্যাস, বিদ্যুৎসহ প্রতিটি পণ্যের দামই বেড়েছে। কিন্তু মানুষের ইনকাম সেভাবে বাড়েনি। মানুষ অসুবিধার মধ্যে আছে। কোনো ভাবেই ম্যানেজ করতে পারছে না। তাদেরকে কিছুটা স্বস্তি দিতে সরকারের উদ্যোগ নিতে হবে। আমদানি করা নিত্যপণ্যের কর কমাতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধা প্রকৃত পাওনাদাররা পাচ্ছে না। এটি নিশ্চিত করতে হবে। মানবজমিন