ডেস্ক রির্পোট:- দেশের ভূ-সীমানায় সব উৎস মিলে বছরে পানির মজুত কমছে ২০০ কোটি কিউবিক মিটার করে। অর্থাৎ দেশের অভ্যন্তরীণ নদ-নদী, জলাশয় ও ভূগর্ভস্থ স্তরে কমে যাচ্ছে পানি। অন্যদিকে বছরে দেশে বৃষ্টিপাত কমছে ১০ মিলিমিটার করে। শুকনো মৌসুমে দেশের প্রধান তিন নদ-নদীর পানিপ্রবাহ কমছে বছরে ১১৩ কিউবিক মিটার করে। যার বড় প্রভাব পড়ছে দেশের কৃষি খাতে সেচব্যবস্থার ওপর। কেবল উত্তরাঞ্চলে চাষাবাদের জন্য পানির সংকট দিনে দিনে বাড়ছেই। নদ-নদী, জলাশয়ে সেচের পানি না পাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানির সহায়তা নিতে গিয়েও পড়তে হচ্ছে বড় বিপদে। প্রতিবছরের সেচের জন্য প্রয়োজনীয় এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর শূন্য দশমিক ৯৪ মিটার করে কমে যাচ্ছে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী ন্যাচারে প্রকাশিত এক বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধে বাংলাদেশের সর্বশেষ পানি পরিস্থিতি নিয়ে এমন তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পানি জোগানে এমন বিপর্যয় নেমে এলে দেশের উত্তর-পশ্চিমে কৃষিব্যবস্থা একরকম মরণদশায় পড়বে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল বাতেন বলেন, ‘যেভাবে আমাদের দেশে পানির সংকট হচ্ছে, পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে, তা অব্যাহত থাকলে আমাদের দেশের কৃষির জন্য মরণদশা আসবে। খুবই খরাপ হবে। এবার যেভাবে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে তাতে ধারণা করা যায়, বৃষ্টি অনেক বেশি হবে। আবহাওয়ার পূর্বাভাসও তাই বলছে। যদি তাই হয়, তবে ভূগর্ভস্থ পানির শূন্যতা কিছুটা হলেও দূর হবে এবং পানির সংকট দূর করতে সাহায্য করবে।’
এদিকে ন্যাচারের ওই প্রবন্ধের শুরুতেই বাংলাদেশের কৃষি পরিস্থিতি তুলে ধরে বলা হয়, বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। যেখানে মোট দেশজ উৎপাদন ২০০০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রায় আট গুণ বেড়েছে। খাদ্যনিরাপত্তাকে উৎসাহিত করার জন্য সরকার কৃষিব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করেছে। তবে কৃষির এই অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পর্যাপ্ত সেচব্যবস্থার অভাবে। ফলে দেশের কৃষকদের এখন শুধু বর্ষা মৌসুমে (জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত) নয়, শুষ্ক মৌসুমেও ধান চাষে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। সেদিকে লক্ষ্য রেখে ধানসহ অন্যান্য ফসলের জাত আবিষ্কারেও নজর দেওয়া হচ্ছে। ফলে ধানের উৎপাদনশীলতা ১৯৯০ সালের তুলনায় দ্বিগুণ হয়েছে (হেক্টরপ্রতি)। এখন বাংলাদেশ বছরে প্রতি হেক্টরে ৪ দশমিক ৮ টন চাল উৎপাদন করে, যেখানে ভারত ও থাইল্যান্ডের মতো অন্যান্য নেতৃস্থানীয় ধান উৎপাদনকারী দেশগুলোতে হেক্টরপ্রতি ২.৯-৩.৯ টনের বেশি চাল উৎপাদন হতে দেখা যায় না।
প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে এখন শুষ্ক মৌসুমে প্রায় ৫০ লাখ হেক্টর জমিতে সেচ দিতে হয়। যার ৭৩ শতাংশ পানি ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে আসে। একই সময়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতেও কৃষির জন্য ব্যাপক পরিমাণে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা হয়। ভারত থেকে বাংলাদেশের অবস্থান উজানে হওয়ায় দেশের ভেতরে ভূগর্ভস্থ পানির প্রবাহেও ঘাটতি পড়ে।
ন্যাচারের তথ্য অনুসারে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে স্যাটেলাইট ডেটা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০০২ সাল থেকে সারা দেশে ৩৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন ঘনমিটার স্থলজ পানির জোগান (নদী, হ্রদ, জলাভূমি, মাটির আর্দ্রতা, ভূগর্ভস্থ ও অন্যান্য জলাধারের পানি সমষ্টি) কমে গেছে। এই ক্ষতির সিংহভাগই ভূগর্ভস্থ পানি হ্রাসের কারণে। দেশের উত্তর-পশ্চিম এবং ঢাকাসহ কিছু জায়গায় ২০০০ সাল থেকে প্রতিবছর জলাবদ্ধতাও ১ মিটার করে হ্রাস পাচ্ছে। এর মানে হলো চাষাবাদের জন্য এসব এলাকায় দুই দশক আগের তুলনায় এখন প্রায় ২০ মিটার গভীর থেকে ভূগর্ভস্থ পানি টেনে তুলতে হচ্ছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, দেশে বর্তমানে প্রায় ৭৯ লাখ হেক্টর জমিতে সেচ দরকার হয়। সেচ সরবরাহ ও সেচ এলাকা সম্প্রসারণের জন্য ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) মাধ্যমে ১১টি প্রকল্প ও ৬টি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বাস্তবায়িত সেচ প্রকল্প ও কর্মসূচির মাধ্যমে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪০ হাজার হেক্টর সেচ এলাকা বৃদ্ধি করা হয়েছে। ৮৬০ কিলোমিটার খাল পুনঃখনন, ৪২ কিলোমিটার ফসল রক্ষা বাঁধ, ১ হাজার ৬১ কিলোমিটার ভূগর্ভস্থ সেচনালা, ১২৫টি সৌরশক্তিচালিত সেচপাম্প স্থাপন, ১৪২টি সৌরশক্তিচালিত ডাগওয়েল স্থাপন, ৯৫টি শক্তিচালিত পাম্প স্থাপন, ৪৫৫টি সেচযন্ত্রে বিদ্যুতায়ন, ৫৪টি ড্রিপ সেচব্যবস্থা প্রদর্শনী প্লট স্থাপন, ৬টি স্প্রিংকলার সেচব্যবস্থা প্রদর্শনী প্লট স্থাপন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের সদস্য পরিচালক (ক্ষুদ্র সেচ) মো. মজিবুর রহমান বলেন, ‘সেচ চাহিদা পূরণে আমরা যথেষ্ট চেষ্টা করছি। এমন সব জায়গায় নতুন নতুন চাষাবাদের জমি খুঁজে বের করছি, যেখানে সেচের চাহিদা কম থাকবে। সেই সঙ্গে কম পানি লাগে তেমন জাতের ফসল উৎপাদনেও জোর দেওয়া হচ্ছে। তারপরও যেহেতু পানির সংকট বাড়ছে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে, তাই সেচের সক্ষমতা বাড়াতে নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। তবে আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে ভূগর্ভ থেকে সেচের জন্য বা অন্য কাজে ব্যবহারের জন্য যে পরিমাণ পানি উত্তোলন করা হয়, সেই হারে রিচার্জ বা শূন্যতা পূরণ হয় না কিংবা তুলনামূলক কম হয়।’
ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘সেচ কার্যক্রম সচল রাখতে আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা। সেদিকে নজর রেখে কৃষিকাজে বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।’
অন্যদিকে এবারের সেচ মৌসুমকে সামনে রেখে সেচব্যবস্থা সহজ করতে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের আওতায় পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি নতুন সার্কুলার জারি করেছে। এতে বলা হয়েছে, বৈদ্যুতিক সেচ কার্যক্রমের জন্য আলাদাভাবে কোনো সেচ মৌসুম থাকবে না। স্থানীয় প্রয়োজনীয়তার স্বার্থে বছরব্যাপী বৈদ্যুতিক সেচকাজ পরিচালিত হবে। বছরব্যাপী সেচ সংযোগের সব আবেদনকারীকে দ্রুত সংযোগ দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
সার্কুলারে জানানো হয়, আউশ, আমন ও বোরো ধান উৎপাদনের পাশাপাশি পেঁয়াজ, রসুন, ডাল, তেলজাতীয় ফসল, হলুদ, আদা, শাকসবজি, মৌসুমি ফুল-ফল উৎপাদনের লক্ষ্যে সব ধরনের কৃষিকে সেচের আওতাভুক্ত করা হবে। বর্তমান সেচ নীতিমালার আওতায় সব সেচ আবেদনকারীকে সংযোগ দিতে হবে। সমিতির উপকেন্দ্র এবং ৩৩ কেভি ও ১১ কেভি ফিডার ওভারলোডের অজুহাতে সেচ সংযোগ বন্ধ রাখা যাবে না। এ ব্যাপারে শিথিলতা প্রমাণিত হলে দায়ীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এদিকে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাউবো) সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত এই বোর্ডের আওতায় বাস্তবায়িত ৯৭০টি প্রকল্পের মধ্যে ৫৩৩টি প্রকল্প হচ্ছে বন্যানিয়ন্ত্রণ, নিষ্কাশন ও সেচধর্মী প্রকল্প। এসব প্রকল্পের আওতায় সর্বমোট ৬৬ দশমিক ৩৭ লাখ হেক্টর জমিতে চাষাবাদের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১১১ দশমিক ৭২ লাখ মেট্রিক টন বেশি খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাপাউবো প্রকল্পের মাধ্যমে সরাসরি ১০ দশমিক ৭ লাখ হেক্টর জমিতে (৩টি ফসল মৌসুমে) সেচ দেওয়া সম্ভব হয়েছে, যা জাতীয় সেচকৃত এলাকার ১৩ শতাংশ। বাপাউবোর বাস্তবায়িত প্রকল্পের মধ্যে ৫২টি সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষিজমিতে ভূ-উপরিস্থ পানিতে সেচকাজে ভূমিকা রাখছে। এসব সেচ প্রকল্পে ব্যারাজ বা পাম্পের সাহায্যে ড্যাম থেকে বা উৎস থেকে গ্রাভিটি ফ্লো পদ্ধতিতে সেচখালের মাধ্যমে কৃষকের জমিতে পানি সরবরাহ করা হয়। ৫২টি সেচ প্রকল্পের আওতায় আবাদি জমির পরিমাণ হচ্ছে ১১ লাখ ১৭ হাজার ১৭৩ হেক্টর, সেচযোগ্য এলাকা ৫ লাখ ১৫ হাজার ৭৬৯ হেক্টর এবং সেচকৃত এলাকা ৪ লাখ ২৬ হাজার ৩৫ হেক্টর।খবরের কাগজ