শাইখ সিরাজ:- বাংলাদেশের কৃষি বিবর্তন খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। গত চার দশকের বেশি সময় ধরে কৃষির খবরাখবর সংগ্রহে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছি। কৃষকের কথা তুলে ধরেছি, তুলে ধরেছি গবেষকদের কথা। গিয়েছি বিভিন্ন দেশে। সে সব দেশের কৃষিচর্চা জানাতে চেষ্টা করেছি দেশের কৃষককে। সূচনা থেকে কৃষি ছিল পরম্পরার, পারিবারিক শিক্ষার অংশ। বাবা-দাদার সঙ্গে কাজ করতে করতে কৃষি সম্পর্কে জানা বোঝা হয়ে যেত কৃষকের। সে সঙ্গে প্রকৃতির কাছ থেকে পেত প্রাথমিক পাঠ। বাতাসের গতি, আকাশের সূর্যের অবস্থান, মাটির গঠন দেখেই কৃষক বলে দিতে পারত পরিবেশ পরিস্থিতি। কিন্তু আজকের কৃষি ঠিক গতদিনের কৃষি নয়, তেমনি আগামীর কৃষিও আজকের কৃষির মতো থাকবে না। খুব দ্রুতই পরিবর্তিত হচ্ছে বৈশ্বিক কৃষি পরিস্থিতি। একদিকে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষির আবহমান ধারা যেমন বিপর্যস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে নিত্যনতুন প্রযুক্তির সংযোজনের প্রভাবে কৃষি হচ্ছে গতিশীল। এই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে কৃষককে হতে হবে আধুনিক, প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ এবং পরিবর্তন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রেখে হতে হবে দূরদৃষ্টি সম্পন্ন।
এ কথা সত্য কৃষি উন্নয়ন ও প্রযুক্তির বিকাশে বহু দেশ থেকে আমরা পিছিয়ে আছি। তবে যতটুকু এগিয়েছি সেখানে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে আমাদের কৃষকই। নতুন কৃষি পদ্ধতি সম্পর্কে জানার এবং সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে গিয়ে সীমাবদ্ধতাকে উৎরে গেছেন তারা। ফলে আজ আমরা মাঠে মাঠে যে বৈচিত্র্যপূর্ণ কৃষি দেখছি, তা রচনা করেছেন আমাদের কৃষকই তাদের নিজের কৌতূহলে এবং চেষ্টায়। যেমন ধরুন নারায়ণগঞ্জের হারুন-অর-রশিদের কথাই যদি বলি, টেলিভিশনে ঘরের ভিতর বিদেশি প্রযুক্তিতে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে ঘাস চাষের প্রতিবেদন দেখে নিজের মতো করেই দেশীয় পদ্ধতিতে অবকাঠামো তৈরি করে নিয়েছিলেন তিনি। কিংবা ফেনীর কৃষক সোলায়মান গাজী নিজের অদম্য ইচ্ছা থেকে মালয়েশিয়া থেকে সংগ্রহ করেছিলেন বারোমাসি আমের সায়ন। যা থেকে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট পরবর্তীতে বারোমাসি আমের জাত বারি ১১ উদ্ভাবন করে। এমন অসংখ্য উদাহরণ আমি দিতে পারি। বাংলাদেশের কৃষক ক্ষেত্রবিশেষে আমাদের গবেষকদের চেয়ে এগিয়ে আছেন। এক সেমিনারে এ কথা অবশ্য স্বীকার করে নিয়েছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন। যা হোক, বলছিলাম আমাদের কৃষক যতটা আগ্রহী ও কৌতূহলী আমরা যদি সব কৃষককে একটা কাঠামোর ভিতর নিয়ে এসে কৃষির হালনাগাদ তথ্য সম্পর্কে জানিয়ে দিতে পারতাম, প্রশিক্ষিত করতে পারতাম তাহলে আমাদের কৃষি আরও গতিশীল হতো। কৃষকের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কৃষি সমস্যাগুলো সমাধান করা যেত খুব সহজেই।
আমার কাছে কৃষকের প্রচুর চিঠি, টেলিফোন কল ও ইমেইল আসে। নতুন কৃষি আর প্রযুক্তি নিয়ে তাদের আগ্রহের শেষ নেই। ‘কোথায় মাল্টাচাষের প্রশিক্ষণ নেওয়া যায়, জানাবেন স্যার?’ কিংবা ‘স্যার, বাইরের দেশ থেকে যে গাজর আমদানি হয়, সেই গাজরটার সাইজ কত সুন্দর! আমরা যে গাজর চাষ করি সেইটার সাইজ এমন ত্যাড়াবাঁকা কেন?’ এমন অসংখ্য প্রশ্ন। তার মানে কৃষক জানতে চায়, নতুন কৌশল শিখতে চায়। কিন্তু হাতে-কলমে শেখানোর কেউ নেই। এমনকি কৃষক জানেও না কোথায় গেলে তার প্রশ্নের উত্তর মিলবে। বিশেষ করে পরিবর্তনের এই সময়ে যখন শিক্ষিত তরুণরা আগ্রহী হয়ে উঠছে কৃষি উদ্যোগে। সে সব উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষণের তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। ইউটিউব দেখে কিংবা সফল কারও গল্প শুনে শুনে উদ্যোগী হচ্ছেন তারা। না জেনে, না বোঝে, প্রশিক্ষণ না নিয়ে বিনিয়োগ করে ব্যর্থ হয়ে বিমুখ হচ্ছেন।
সরকারের কৃষি বিভাগের অনেকের সঙ্গেই আমি কথা বলে জেনেছি, কৃষক প্রশিক্ষণ কার্যক্রমগুলো মূলত প্রকল্পনির্ভর। প্রকল্প শেষ হয়ে গেলে সেই প্রশিক্ষণ কৃষক মাঠে কীভাবে কাজে লাগালো তাও মূল্যায়ন করা হয় না। ফলত কৃষকের এই প্রশিক্ষণগুলো অনেকটা কাগজে-কলমেই হয়।
বিগত বাংলাদেশে তরুণদের কৃষিতে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে যুব উন্নয়ন অধিদফতরের প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনার ভালো ভূমিকা রয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কৃষি প্রেক্ষাপটের যে পরিবর্তন হয়েছে, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরিমার্জন ও পরিবর্ধন ঘটেনি তাদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের। শুধু তাই নয়, স্কুল পর্যায়ে কৃষি শিক্ষা বাধ্যতামূলক বটে, তবে তা যেন বই ও খাতা-কলমে প্র্যাকটিস পরীক্ষাতেই সীমাবদ্ধ। অথচ অনেক উন্নত দেশে আমি দেখেছি শিশু-কিশোরদের কৃষি বিষয়ে সম্যক ধারণা দিতে মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের কৃষকদের সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময়ের ব্যবস্থা করা হয়। ফলে খুব কাছ থেকে ফসল ফলানোর বিষয়াদি দেখে কৃষির মহিমা অনুধাবন করতে পারে তারা। আমাদের দেশের স্কুলের কৃষিশিক্ষা পাঠের কারিকুলামও হালনাগাদ করা প্রয়োজন। যেন নতুন প্রজন্ম বর্তমানের পরিবর্তিত কৃষি সম্পর্কে জেনে বুঝে বড় হতে পারে। কারণ কৃষি আর কাদা-মাটির কৃষি নেই। কৃষি এখন স্মার্ট পেশা। সবচেয়ে বড় কৃষি বিষয়ে মজবুত ফাউন্ডেশন নিয়ে বেড়ে ওঠা কিশোরের মনে অন্যরকম স্বপ্ন তৈরি হবে। তাদের হাত দিয়েই রচিত হবে নতুন দিনের কৃষি। শুধু সরকারি পর্যায়ে নয়, বেসরকারি পর্যায়ে কৃষি প্রশিক্ষণের পরিধি বাড়ানো যেতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে সরকারের তদারকির প্রয়োজন আছে। বছর দুয়েক আগে আমাদের দেশে বায়োফ্লকের জোয়ার বয়ে গেল। হাজার হাজার তরুণ বায়োফ্লকের প্রশিক্ষণ নিতে উদ্গ্রীব হয়ে উঠল। তখন একশ্রেণির লোক বায়োফ্লকের প্রশিক্ষণ দেওয়ার নামে তরুণদের কাছ থেকে লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। অথচ তখন পর্যন্ত বায়োফ্লকের গ্রহণযোগ্য কোনো কাঠামোই তৈরি হয়নি। অনেক তরুণ তাদের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে বায়োফ্লকে মাছচাষ করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন এমন সংবাদও পেয়েছি। তাই যে কোনো কৃষি প্রশিক্ষণে সরকারের সম্পৃক্ততার যেমন প্রয়োজন আছে, তেমনি প্রয়োজন আছে সরকারি নীতিমালার। ফেসবুক, ইউটিউবের এই সময়ে নানাভাবেই কৃষকের কাছে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব। ভার্চুয়ালি তথ্য প্রদান কিংবা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে যারা কাজ করছেন তারা চাইলে কৃষি প্রশিক্ষণ বিষয়ে ক্যানভাস, ডোমেস্টিকা বা ইউডেমির মতো অনলাইন প্রশিক্ষণ প্ল্যাটফরম তৈরি করতে পারেন। এক্ষেত্রেও বেশ সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রশিক্ষিত দক্ষ জনগোষ্ঠীই দেশের সম্পদ। সব পেশাতেই দক্ষতার বিষয় রয়েছে। শুধু কৃষিই যেন বংশানুক্রমে প্রশিক্ষণ ছাড়াই যে কেউ করতে পারে। অথচ কৃষিতেই প্রয়োজন পূর্ণ মনোযোগ এবং কৌশলগত নানান ধরনের প্রাসঙ্গিক জ্ঞান ও তার প্রয়োগ। দীর্ঘদিন কৃষি ও কৃষক ছিল অবহেলিত। দীর্ঘ সংগ্রামের পর কৃষকের অবস্থান আজ অনেকখানি পরিবর্তন হয়েছে। তরুণরা আগ্রহী হচ্ছে কৃষিতে। তৈরি হচ্ছে কৃষি উদ্যোক্তা। ঠিক এই সময়ে এসে কৃষি প্রশিক্ষণের গুরুত্ব বেড়ে গেছে অনেক। উদ্যোমী তরুণদের কৌতূহলকে অমিত সম্ভাবনায় পরিবর্তন করা গেলে বেকারত্বের অভিশাপ যেমন দূর হবে দেশ এগিয়ে যাবে সমৃদ্ধির পথে। এ বিষয়গুলোতে সংশ্লিষ্টজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব
shykhs@gmail.com