ডেস্ক রির্পোট:- বৈশাখের শুরুতে দেশে তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেছে। ৫১ জেলায় চলছে প্রচণ্ড দাবদাহ। ইতোমধ্যেই হিট স্টোকে বিভিন্ন জেলায় ১০ জন মারা গেছেন। ভ্যাপসা গরমের মধ্যে বিদ্যুতের ঘনঘন লোডশেডিংয়ে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের মানুষের ত্রাহি দশা। দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে সারাদেশের জনজীবন। সেচের অভাবে ধানক্ষেত শুকিয়ে যাচ্ছে, আমের মুকুল ঝড়ে যাচ্ছে, বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে কৃষিজাতপণ্য উৎপাদন। বিদ্যুতের আসা-যাওয়ায় কলকারখানায় উৎপাদন কমে গেছে, কোলরেস্টরেজে পঁচে যাচ্ছে কৃষিপণ্য। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফ্যান না চলায় তাপপ্রবাহে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে শহরকেন্দ্রীক মানুষের জীবন। বিদ্যুৎ না থাকায় ফ্রিজে নষ্ট হচ্ছে খাদ্যপণ্য। অথচ দেশের বিদ্যুৎ সেক্টরে ব্যাপক সাফল্য দেখানো হচ্ছে। রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুতে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের বিতর্কের মধ্যে দাবি করা হচ্ছে দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ৩০,২৭৭ মেগাওয়াট। তবে গতকাল সারাদেশে চাহিদা ১৭ হাজার মেগাওয়াটের বিপরীতে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১৫,৬৪৮ মেগাওয়াট। উৎপাদনের এ হিসাব সরকারের কেতাবের হলেও প্রকৃত উৎপাদন কত তা জানা সত্যিই কঠিন। কারণ সরকারের হিসাবে চাহিদার চেয়ে মাত্র দেড় হাজার মেগাওয়াট ঘাটতি হলে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা লোডশেডিং হওয়ার কথা নয়। বিদ্যুতের প্রকৃত চাহিদা, উৎপাদন ও বিতরণ হিসাবের সঙ্গে বাস্তবের মিল দেখা যাচ্ছে না। গত কয়েকদিন থেকে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা লোডশেডিং স্বাভাবিক ঘটনা। ঢাকা, সভার, নারায়ণগঞ্জ, গাজিপুর, মানিকগঞ্জ, নরসিংদী, টঙ্গী, চট্টগ্রামসহ দেশের প্রত্যেকটি এলাকার শিল্পকারখানা উৎপাদন কমে গেছে। বিদ্যুতের অভাবে শ্রমিক বসিয়ে রেখে বেতন দেয়ায় কারখানাগুলো লোকসানের মুখে পড়ে যাবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) কার্যকরী কমিটির নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, লোডশেডিংয়ের ফলে উৎপাদন বিশালভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জেনারেটর চালিয়ে উৎপাদন অব্যাহত রাখার চেষ্টা করায় উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। লোডশেডিংয়ের কারণে সময় মতো উৎপাদন না হওয়ায় শিপমেন্ট শিডিউল ফেল করার কারণে বায়ারদের কাছে এখন আমাকে দেন দরবারে যেতে হচ্ছে। এ সংকট দীর্ঘমেয়াদি হলে আমরা বায়ারদের কাছে যে কমিটমেন্ট করেছিলাম সেটি ফেল করবো। তাতে আমাদের বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।
ঈদের পর থেকে দেশজুড়ে বয়ে চলা তাপপ্রবাহে হাঁসফাঁস করছে জনজীবন। অতিরিক্ত গরমে বেড়ে গেছে বিদ্যুতের চাহিদাও। এ চাহিদার পরিমাণ ৩ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। গত দুই থেকে তিন মাস দিনে গ্রামাঞ্চলে ১৩ থেকে ২০ ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। কোথাও কোথাও একবার গেলে টানা দুই/তিন ঘণ্টা বিদ্যুৎ আসছে না। প্রচণ্ড গরমে বারবার বিদ্যুৎ বিভ্রাটে জনজীবন জেরবার। বিঘ্নিত হচ্ছে সেচসহ স্বাভাবিক কার্যক্রম এবং লোডশেডিংয়ের কারণে সময় মতো উৎপাদন না হওয়ায় শিপমেন্ট শিডিউল ফেল করার কারণে বায়ারদের কাছে দেন দরবারে যেতে হচ্ছে শিল্পকারখানার মালিকদের। রাজধানীসহ ঢাকা জেলায় লোডশেডিং দিন দিন বাড়ছে। দেশে বর্তমানে মোট ১৮টি রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে ১০টি কেন্দ্র ‘নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট’ নীতিতে চলছে। বাকি আটটিকে আগের নিয়মে ক্যাপাসিটি চার্জসহ যাবতীয় খরচ দিতে হচ্ছে। কোনো বিদ্যুৎ না নিয়েই গত ১১ বছরে সরকার বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোকে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে। এটি ক্যাপাসিটি চার্জ বা বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতার ভাড়া নামে পরিচিত বলে বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। দেশে ক্রমবর্ধমান ডলার সঙ্কটের কারণে, কয়লা, এলপিজিসহ জ¦ালানি আমদানি কমে গেছে। তার প্রভাব পড়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। জ্বালানি নির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখতে হচ্ছে।
চাহিদার চেয়ে উৎপাদন ক্ষমতা বেশি থাকা, সরকারের উচ্চ মূল্যে কেনা ও প্রতিযোগিতার অভাবে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। সমঝোতা ছাড়া দরপত্রের মাধ্যমে চুক্তি হলে কম দামে বিদ্যুৎ পেত সরকার। এসব ভুল নীতির কারণে উৎপাদন ব্যয় অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি ভর্তুকি বেড়েছে। এর দায় চাপানো হয়েছে জনগণের ওপর। বিদ্যুতের দাম দফায় দফায় বাড়ানোয় এর প্রভাবে ঘটেছে মূল্যস্ফীতি। বেড়ে গেছে জীবনযাত্রার ব্যয়। এসব কথা বলা হয়েছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা প্রতিবেদনে। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, এর প্রভাব, বিকল্প উপায় ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বক্তব্য তুলে ধরেন গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
কুমিল্লায় গড়ে ৩০ শতাংশ বিদ্যুৎ ঘাটতি, বগুড়ায় গরমের সঙ্গে পাল্লা লোডশেডিংয়ের, খুলনায় বিঘ্নিত কাজকর্ম, নওগাঁয় ব্যাহত সেচ,সিলেটে ৫১ ভাগের বেশি লোডশেডিং, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহে ৮ ঘণ্টার লোডশেডিং, বরিশালে এক-তৃতীয়াংশ লোডশেডিং, রংপুর-কুড়িগ্রাম ৬০ শতাংশ বিদ্যুৎ ঘাটতি। লোডশেডিং থামছে না। দেশজুড়ে এখন মৃদু তাপপ্রবাহ চলছে। চলতি সপ্তাহে তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠেছে। আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলছে, আগামী কয়েক দিন তাপমাত্রা আরও বাড়তে পারে। এ অবস্থায় পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে বিতরণ কোম্পানিগুলো। তাদের ভাষ্য, এলাকাভেদে চাহিদার তুলনায় ৩০ থেকে ৫০ ভাগ বিদ্যুৎ কম মিলছে। বাধ্য হয়ে লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। সরবরাহ না বাড়লে সামনে ভোগান্তি আরও বাড়বে। পিজিসিবির তথ্য অনুসারে, গতকাল বিকেল ৩টায় সারাদেশে দেড় হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং ছিল। সন্ধ্যার পর বিদ্যুতের চাহিদা বাড়তে থাকে। সঙ্গে বাড়ে লোডশেডিং। বিতরণ কোম্পানিগুলোর সূত্র জানায়, পিক সময়ে (সর্বোচ্চ চাহিদা) দেশে প্রায় আড়াই হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং দিতে হচ্ছে।পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) ঘাটতি সবচেয়ে বেশি। এ জন্য গ্রামগঞ্জে লোডশেডিংও বেশি। বিশেষ করে ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম ও রংপুরে বেশি লোডশেডিং। কিছুটা স্বস্তি বরিশাল বিভাগে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ও ন্যাশনাল লোড ডিসপাচ সেন্টারের তথ্যানুসারে দেখা যায়, গত ১৪ এপ্রিল দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১২ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট, যার বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে ১৫ হাজার ৫১৪ মেগাওয়াট। ১৫ এপ্রিল চাহিদা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ১৪ হাজার মেগাওয়াটে, যার বিপরীতে উৎপাদন হয় ১৫ হাজার ৫৪৩ মেগাওয়াট। এরপর ১৬ এপ্রিল বিদ্যুতের চাহিদা দাঁড়ায় ১৫ হাজার মেগাওয়াটে, যার বিপরীতে উৎপাদন হয় ১৫ হাজার ৮৯০ মেগাওয়াট। ১৭ এপ্রিল চাহিদা কিছুটা কমে ১৪ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটে নেমে আসে, যার বিপরীতে উৎপাদন হয় ১৬ হাজার ৪১১ মেগাওয়াট। গত ১৮ এপ্রিলও চাহিদা ১৪ হাজার ৮১ মেগাওয়াটে বজায় থাকে। তবে গত শনিবার আবার বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যায়। সেদিন চাহিদার ১৫ হাজার ৫০০ মেগাওয়াটের বিপরীতে উৎপাদন হয় ১৫ হাজার ৩৫৮ মেগাওয়াট, ফলে লোডশেডিং দিতে হয় ১৪২ মেগাওয়াট। আর গত রোববার বিদ্যুতের চাহিদা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ২০০ মেগাওয়াটে, যা গত এক সপ্তাহের মধ্যে সর্বোচ্চ। চলতি গরমে এই চাহিদা ১৭ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট হতে পারে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি বলেন, গরমে বিদ্যুতের চাহিদা ১৭ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট হতে পারে। এই চাহিদা পূরণ করে আমরা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের চেষ্টা করছি। কিন্তু আমাদের বড় বাধা অর্থ। অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র গ্যাসের জন্য উৎপাদন করতে পারছে না। অনেকে আবার সামান্য কিছু উৎপাদন করছে।
পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। গ্যাস সংকটে ১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট উৎপাদন কম হয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে দিনে অন্তত ২৩২ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা থাকলেও সরবরাহ হচ্ছে ১০০। পেট্রোবাংলার কাছে গ্রীষ্মের জন্য অন্তত ১৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস চেয়েছে পিডিবি। দেশে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা ১২ হাজার ২২৬ মেগাওয়াট। সরবরাহ কম থাকায় গড়ে সাড়ে ৫ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন হচ্ছে। তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা ৬ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। খরচ বেশি বলে এগুলো কম চালানো হয়। তবে গরমে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় চালানো হচ্ছে এসব কেন্দ্রও। এতে পিডিবির খরচ বেড়ে গেছে। তবে এখানেও রয়েছে জ্বালানি সংকট। বেসরকারি খাতের তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো তেল আমদানির জন্য পর্যাপ্ত ডলার পাচ্ছে না। পিডিবির কাছে বড় অঙ্কের বকেয়া পড়েছে তাদের।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, এখন দিনে ২৬৪ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এর মধ্যে এলএনজি থেকে ৬০ কোটি ঘনফুট মিলছে। একটি এলএনজি টার্মিনাল বন্ধ থাকায় কমপক্ষে ২৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস কম পাচ্ছে। এ টার্মিনাল চালু হলে গ্যাস সরবরাহ বাড়তে পারে। গত মাসে সামিটের টার্মিনালটি চালুর কথা থাকলেও গ্যাস সরবরাহ এখনও শুরু করেনি। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলায় লোডশেডিং বেড়েছে। রমজানে মানুষ অতিষ্ঠ এবং ঈদ ঘিরে স্বাভাবিক কাজকর্ম বিঘ্নিত হচ্ছে। এ অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে থাকা ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি জানিয়েছে, গত বুধবার রাত ৯টায় চাহিদার ৬৭৫ মেগাওয়াটের বিপরীতে সরবরাহ ছিল ৫৯২। নগরীর ক্লে রোডের পাঞ্জাবি দোকানের মালিক সোলায়মান শেখ বলেন, গত দু-তিন দিন ধরে প্রতি রাতেই দুই থেকে তিনবার লোডশেডিং হচ্ছে। বেচাকেনা করা যাচ্ছে না। ডুমুরিয়ার সাজিয়াড়া গ্রামের কৃষক সাহেব আলী বলেন, ২৪ ঘণ্টায় পাঁচ থেকে ছয়বার বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ গেলে ঘণ্টার বেশি থাকছে।
রাজশাহী থেকে রেজাউল করিম রাজু জানান, রাজশাহী অঞ্চলের উপরদিয়ে বয়ে যাচ্ছে তীব্র তাপাদহ। চারিদিকে গরম বাতাসের ঝাপটা কি ঘরে কি বাইরে কোথাও স্বস্তি নেই। মানুষ পশু পাখি হাঁসফাস করছে। তাপ থেকে বাঁচতে ঘরের মধ্যে থেকেও শান্তি নেই। কারন তাপাদহের সাথে শুরু হয়েছে বিদ্যুতের আসা যাওয়া। ফলে মানুষ আরো বিপাকে পড়েছে। যখন তখন বিদ্যুতের আসা যাওয়ায় মানুষ ক্ষুব্ধ বিরক্ত। রাজশাহী অঞ্চলের বিদ্যুত সরবরাহ ব্যবস্থা নিয়ে সম্প্রতি বিভাগীয় প্রশাসন বিদ্যুত সরবরাহ কোম্পানীগুলোর সাথে আলোচনা হয়। সভায় রাজশাহী অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ ও লোডশেডিংয়ের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। তাতে দেখা যায়, বিভাগের আট জেলায় গত বছরের তুলনায় এ বছর বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু জাতীয় গ্রিড থেকে সে অনুযায়ী বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না। বর্তমানে শুধু পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিরই সেচের জন্য এখন ৫৮১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন। কিন্তু জাতীয় গ্রিড থেকে পাওয়া যাচ্ছে ৩৮৮ মেগাওয়াট। ঘাটতি থাকছে ১৯৩ মেগাওয়াট। বাণিজ্যিক ও আবাসিক সংযোগের ক্ষেত্রে আরও প্রায় ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি থাকছে রোজ। একইভাবে নেসকোর ক্ষেত্রেও প্রায় ৪০ শতাংশ বিদ্যুতের ঘাটতি থাকছে। বিদ্যুৎ ঘাটতির ফলে শুরু হয়েছে লোডশেডিং। কি শহর কি গ্রাম সর্বত্র বিদ্যুতের আসা যাওয়া। ফলে পানির পাম্পগুলো ঠিকমত চালানো যাচ্ছেনা। এমন অবস্থায় দুশ্চিন্তার ভাঁজ কৃষকের কপালে। শুধু ধান নয় প্রচণ্ড খরায় আমের গুঁটি ঝড়ে পড়ছে। সেচ দিয়ে গুঁটিপড়া বন্ধের চেষ্টা হচ্ছে।
বগুড়ায় বিদ্যুৎ সংকটের কারণে এখন জনদুর্ভোগ চরমে। বগুড়া জেলায় বিদ্যুতের চাহিদা ২০০ মেগাওয়াট। কিন্তু বিতরণ কোম্পানিগুলো পাচ্ছে মাত্র ৯২ মেগাওয়াট। ফলে চাহিদার চেয়ে ৫৫ শতাংশের বেশি ঘাটতি থাকছে। এর ফলে ঘনঘন লোড শেডিং ও টানা দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ না থাকায় কলকারখানার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। হিমাগারে রাখা আলুর মান নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে। হিমায়িত মাছ কম দামে বিক্রি করে দিতে হচ্ছে। হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম। শিল্প মালিকরা বলছেন, জেনারেটর চালিয়ে শিল্পপণ্য উৎপাদন করতে গিয়ে আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাদের।
কোল্ড স্টোরেজ এ্যাসোসিয়েশন সূত্রে বলা হয়েছে, বগুড়ার ৫৬টি কোল্ড স্টোরেজে ৫ লাখ মেট্রিক টন আলুর মজুদ রয়েছে। কিন্তু দিনের বেশিরভাগ সময় ( ৮/১০ ঘন্টা ) বিদ্যুৎ না থাকায় মজুদ গোল আলুর মান বজায় রাখা যাচ্ছে না। খুব তাড়াতাড়ি পরিস্থিতির উন্নতি না হলে হয়তো স্টোরে মজুদ বিপুল পরিমাণে আলু নষ্ট হয়ে যেতে পারে ।
চট্টগ্রামে প্রচণ্ড তাপদাহের সাখে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে লোডশেডিং। এতে জনজীবন যেমন বিপর্যস্ত তেমনি কলকারখানার উৎপাদনও চরম ব্যহত হচ্ছে। চট্টগ্রামে বিদ্যুতের চাহিদা প্রায় ১৬০০ মেগাওয়াট। আর সরবরাহ মিলছে ১২ থেকে ১৩শ মেগাওয়াট। ফলে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে তিশ থেকে চারশ মেগাওয়াট লোডশেডিং চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তবে পিডিবির কাগজে কলমে লোডশেডিং আরো কম। রাতে দিনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিংয়ে সাধারণ মানুষ ত্যক্ত, বিরক্ত, অতিষ্ঠ। বেশি বিপাকে পড়েছেন শ্রমজীবী ও কর্মজীবীরা। শিক্ষার্থীদের পড়া লেখা বন্ধের উপক্রম হয়েছে। বিদ্যুতের সাথে পাল্লা দিয়ে পানি সঙ্কট আরো তীব্র হয়েছে। নগরীজুড়ে চলছে পানির হাহাকার। পরিস্থিতি সামাল দিতে রেশনিং করে পানি সরবরাহ করছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। গ্যাস, পানি ও জ্বালানি সঙ্কটের কারণে চট্টগ্রামে সাতটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১০টি ইউনিট বন্ধ রয়েছে। কয়লার অভাবে বাঁশখালীর এসএস পাওয়ার প্ল্যান্ট এবং মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদনে ধস নেমেছে। গত রোববার ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার এসএস পাওয়ার থেকে মাত্র ২৭০ মেগাওয়াট এবং ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার মাতারবাড়ি থেকে ৩৬৮ মেগাওয়াট সরবরাহ পাওয়া গেছে। কাপ্তাই লেকের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ মহাপ্রকল্পের ৫টি ইউনিটের চারটি বন্ধ হয়ে গেছে। একটি মাত্র ইউনিট চালু রাখা হচ্ছে। চট্টগ্রাম অঞ্চলের ২৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা চার হাজার মেগাওয়াটের বেশি। এতে সবরাহ মিলেছে ১৩৬০ মেগাওয়াট। চট্টগ্রামের মতো সারা দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে।
বরিশাল, নজিরবিহীন তাপ প্রবাহের মধ্যেও বরিশাল অঞ্চলে বিদ্যুতের যাওয়া আসা থেমে নেই। এ অঞ্চলের ৬টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি এবং পশ্চিমাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানী-ওজোপাডিকো’র বরিশাল বিভাগ ও জেলা সদরসহ কয়েকটি উপজেলা সদরের অন্তত ১০ লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎ সরবরাহ বিতরণ ও সঞ্চালন ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে চরম ভোগান্তির শিকার। এমনকি গ্রামঞ্চলে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলোতে সরবারহ শহরের তুলনায় কম হওয়ায় যেমনি ভোগান্তি আছে, তেমনি শহর এলাকায় ওজোপাডিকো’র বিতরণ ব্যবস্থার লাগাতার গোলযোগেও গ্রাহকগণ প্রতিনিয়ত নাকাল হচ্ছেন। বরিশাল অঞ্চলে ওজোপাডিকো এবং পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলোতে সান্ধ্যপীক আওয়ারে প্রায় ১ হাজার মেগাওয়াট এবং ডে-পীক আওয়ারে প্রায় ৮শ মেগাওয়াট চাহিদার ১০-১৫ শতাংশ পর্যন্ত ঘাটতি পরিস্থিতিকে প্রায়শই নাজুক করে তুলছে।
খুলনা, খুলনা অঞ্চলের গ্রামগুলোতে যে কোনো সময় চলে যাচ্ছে বিদ্যুৎ। এতে বৈশাখের ভ্যাপসা গরমে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে জনজীবন। গ্রাম ছাড়া শহর এলাকাতেও ইদানীং লোডশেডিং আবারও দেখা দিয়েছে। গ্রামে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ও শহরে ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ওজোপাডিকো) বিদ্যুৎ সরবরাহ করে থাকে। পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহক খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলার কৈলাশগঞ্জ এলাকার মো. আবু শেখ বলেন, প্রতিদিন বিদ্যুৎ যাচ্ছে। ছাত্র-ছাত্রীরা পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ছে। কৃষিকাজেও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
খুলনা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার মো. জিল্লুর রহমান বলেন, পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহক প্রায় ৪ লাখ ৩০ হাজার। লোডশেডিংয়ের খুব খারাপ অবস্থা। খুলনা জেলায় পল্লী বিদ্যুতে ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন। তবে আমাদের বর্তমানে কোন ঘাটতি নেই। ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ওজোপাডিকো) খুলনা সদর দফতরের প্রধান প্রকৌশলীর দফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী সূত্র জানায়, পদ্মার এপাড়ের ২১ জেলার শহর অঞ্চলে গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ ৫৭ হাজার ৩৬৮ জন। খুলনায় আমাদের গ্রাহক আছে প্রায় ২ লাখ ৪৫ হাজার। ২১ জেলায় মোট ৫৮০ মেটাওয়াট বিদ্যুৎ লাগে।
কুমিল্লা থেকে সাদিক মামুন জানান, লোডশেডিংয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়ছে কুমিল্লায় বিদ্যুৎ ব্যবহারকারি কয়েক লাখ মানুষ। একদিকে প্রচণ্ড গরমে প্রতিদিনই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে কুমিল্লাবাসীকে। কুমিল্লায় পল্লি বিদ্যুৎ সমিতি ১ এর চাহিদা ১৩০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ঘটতি ৩০ মেগাওয়াট। পল্লি বিদ্যুৎ সমিতি-২ এবং ৩ ও লোডশেডিংয়ের মাধ্যম ঘাটতি পূল করতে হয়। এ ছাড়া পিডিবি ১ ও ২ এর ঘাটতি রয়ে ৩০ শতাংশ। গ্রাহকদের অভিযোগ, প্রতিদিনই দিনে-রাতে অন্তত ৮/১০ বার বিদ্যুৎ চলে যায়। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে শিল্প, কলকারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে দেখা দিচ্ছে স্থবিরতা। বাসাবাড়িতে পানির সংকট দেখা দিচ্ছে। কুমিল্লা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের একজন প্রকৌশলী বলেছেন চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ সরবরাহ কম হওয়ায় লোডশেডিং হচ্ছে।ইনকিলাব