দুই থানার পাশেই কেএনএফের আট আস্তানা, অস্ত্র লুটে ছয় মামলা
থানচি-রুমা ছেড়ে বান্দরবান শহরে ছুটছে মানুষ
থানচি-রুমা ছেড়ে বান্দরবান শহরে ছুটছে মানুষ
বান্দরবান:- একাত্তর সাল থেকে বান্দরবানের থানচি উপজেলা বাজারে ব্যবসা করে আসছেন চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার বাসিন্দা ৬৪ বছর বয়সী সিদ্দিকুর রহমান। এক ছেলে ও স্ত্রী নিয়ে বাজারের পাশেই একটি ঘরে বসবাস তাঁর। তবে দু’দিন ধরে পাহাড়ের সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) যেভাবে থানা আক্রমণ, ব্যাংক ডাকাতি, গোলাগুলি শুরু করেছে, তাতে আতঙ্কিত হয়ে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে থানচি ছেড়েছেন সিদ্দিক।
শুক্রবার বিকেলে বান্দরবান সদরে এক আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নেন তারা।
সিদ্দিকুর রহমান জানান, ঈদ এলেও সে খুশি নেই তাঁর মনে। কেএনএফ সন্ত্রাসীদের হামলা তাঁর ঈদের ব্যবসার সম্ভাবনা নষ্ট করে দিয়েছে। উল্টো জীবন বাঁচানোই এখন প্রথম কাজ। বৃহস্পতিবার রাতে কেএনএফের সঙ্গে পুলিশ-বিজিবির গোলাগুলির সময় ঘরে মাটিতে শুয়ে কোনো রকমে জীবন বাঁচিয়েছেন। কখন আবার কেএনএফ বাজারে হামলা করে– সে ভয়ে নিরাপত্তাহীনতায় থানচি ছাড়ছেন।
থানচি বাজারে গত ১৩ বছর ধরে মুদি দোকান করেন চিকু মারমা। বৃহস্পতিবার রাতের গোলাগুলির ঘটনায় গতকাল দুপুরে দোকানে তালা দিয়ে বান্দরবান সদরে পরিবার নিয়ে চলে যান তিনিও। চিকু বলেন, ‘জীবনে এমন গোলাগুলি দেখিনি। দোকানের নিচে পাহাড়ের ঢালুতে মাটিতে শুয়ে জীবন রক্ষা করেছি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত আর থানচিতে ফিরব না।’
সিদ্দিক ও চিকুর মতোই গতকাল সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত থানচি বাজার এলাকা থেকে প্রায় দেড়শ পরিবার বান্দরবান সদরে চলে গেছে বলে জানা যায়। যারা এখনও আছেন, তাদেরও দিন কাটছে চরম আতঙ্কে। কেউ থানচি বাজার এলাকায় থাকতে চাইছেন না। তারা বলছেন, সামনেই ঈদ ও পাহাড়িদের সবচেয়ে বড় সামাজিক উৎসব বৈসাবি। কিন্তু নিরাপত্তাহীনতা তাদের সব আনন্দ কেড়ে নিয়েছে। থানচি, রুমা ও আলীকদমের বাসিন্দাদের মনে উৎসবের আনন্দের চেয়ে বেশি ভর করেছে ভয় ও নিরাপত্তাহীনতা।
গতকাল সকালে থানচি বাজারে গিয়ে দেখা যায়, ছোট-বড় ২৪০টি দোকানের মধ্যে সব মিলিয়ে ১৫টি দোকান খোলা। অন্য দোকানগুলোতে তালা ঝুলছে। যে ক’টি দোকান খোলা রয়েছে তার অধিকাংশই ক্রেতাশূন্য। বাজারে পাহাড়ি মানুষের উপস্থিতিও চোখে পড়েনি। চারদিকে থমথমে, চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছে। বাজারের মোড়ে মোড়ে পুলিশ ও বিজিবি সদস্যরা পাহারা দিচ্ছে।
ভাই ভাই মুদি দোকানের মালিক মো. সাইদুল বলেন, ‘আগে দিনে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা বিক্রি করতাম। গত তিন দিনে তা ৫০০ টাকায় এসে ঠেকেছে। শুক্রবার মাত্র ৬০ টাকা বিক্রি করেছি। বাজারে এখন কেউ ভয়ে আসছে না।’
থানচি বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিন বলেন, ‘কেএনএফের অস্ত্রের মহড়া, থানায় আক্রমণ নিয়ে গোলাগুলির ঘটনায় বাজার ও আশপাশের মানুষ আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। এখন রাতেই বেশি ভয় হচ্ছে। কারণ দিনে পুলিশ ও বিজিবির অবস্থান বাড়ায় রাতের অন্ধকারে নানা ঘটনা ঘটাচ্ছে সন্ত্রাসীরা। নিরাপত্তাহীনতার কারণে জীবন বাঁচাতে পাহাড়ি-বাঙালি অনেকে থানচি ছেড়ে বান্দরবান সদরে চলে যাচ্ছে।’
থানচি হেডম্যানপাড়ার বাজার-সংলগ্ন বাসিন্দা চাই হুং প্রো বলেন, ‘রাতে হঠাৎ গোলাগুলি শুরু হলে জীবন বাঁচাতে পরিবারের আট সদস্যের সবাই জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছিলাম। এমন পরিস্থিতি কোনোদিন দেখিনি। দূরে আত্মীয়ের বাসায় আপাতত চলে যাব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
থানচি উপজেলা সদরের ব্রিজের মাথায় গিয়ে এক প্রতিবেশীকে নিয়ে চাঁদের গাড়িতে করে এলাকা ছাড়েন টিঅ্যান্ডটিপাড়ার বাসিন্দা জুলি আক্তার। জানা গেল, তারা সন্তানদের নিয়ে বান্দরবান সদরে চলে যাচ্ছেন। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এমন সাতটি চাঁদের গাড়ি করে ৭০-৮০ জন নারী-শিশু থানচি ত্যাগ করেন বলে জানান গাড়ির লাইনম্যান সাইফুল। থানচি উপজেলা সদরের ইউপি চেয়ারম্যান অং প্র মোরং বলেন, গোলাগুলির ভয়ে অনেক পরিবার থানচি ছেড়ে আত্মীয়স্বজনের বাসায় চলে যাচ্ছে। আমি নিজেও গোলাগুলির ঘটনায় ভয় পেয়েছি।
থানচি থানার ওসি জসিম উদ্দিন বলেন, ‘থানচিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। একজন সহকারী পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে অতিরিক্ত আরও ১০০ পুলিশ সদস্য থানা পুলিশের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। সন্ত্রাসীদের জবাব দিতে জোরদার করা হয়েছে যৌথ বাহিনীর অভিযান। কিছু মানুষ থানচি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে বলে শুনেছি।’
পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি নূরে আলম মিনা বলেন, ‘রুমা, থানচি, রোয়াংছড়ি ও আলীকদমে সার্বিক নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। যৌথ বাহিনীর অভিযানও জোরেশোরে চলছে। ব্যাংক ডাকাতি, অস্ত্র ও গুলি লুটের ঘটনায় ৬টি মামলা হয়েছে। থানায় আক্রমণের ঘটনায় পৃথক মামলা করার প্রক্রিয়া চলছে।
পাশেই আট আস্তানা
বান্দরবানের রুমা থানার এক থেকে দুই কিলোমিটারের মধ্যে কেএনএফের অন্তত চারটি আস্তানা রয়েছে বলে জানা গেছে। আস্তানাগুলো বেথেলপাড়া, কেসপাইপাড়া, ইডেনপাড়া ও মুয়ালপিপাড়ায়। তার মধ্যে কেএনএফের প্রতিষ্ঠাতা নাথান বমের বাড়ি ইডেনপাড়ায়। এই চার পাড়াতেই বম জনগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস। রুমা থেকে অপহৃত সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার নেজাম উদ্দিনকেও রুমা বাজারের পাশে অবস্থিত বেথেলপাড়া থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।
একইভাবে থানচি থানার এক কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত তংকংপাড়া। সেখান থেকেই কেএনএফ সন্ত্রাসীরা দুটি চাঁদের গাড়ি করে এসে সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকে ডাকাতি করে। আবার ওই গাড়িতেই তারা তংকংপাড়ায় ফিরে যায়। এখনও সেখানে তারা আস্তানা গেড়ে রয়েছে।
তংকংপাড়া ছাড়াও পাশের বোডিংপাড়া, কাইন্দংপাড়া, শেরকরপাড়ায় কেএনএফ সন্ত্রাসীরা কয়েকটি অংশে বিভক্ত হয়ে অবস্থান করছে বলে জানা গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসব পাড়ার ওপর নজরদারি করার সময় তাদের অবস্থানের চিত্র ধরা পড়েছে।
নিরাপত্তা বাহিনীর সূত্র বলছে, রুমা ও থানচিতে ডাকাতি এবং অস্ত্র লুট করার পর গভীর জঙ্গলে না গিয়ে তাদের ঘাঁটি বমপাড়ায় অবস্থান নিয়েছে সন্ত্রাসীরা। যদিও অতীতে আরেক সশস্ত্র সংগঠন জেএসএস পুলিশ-সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘাতে জড়ানোর পর তারা গভীর জঙ্গলে চলে যেত। কিন্তু কেএনএফ সন্ত্রাসীদের তার উল্টো অবস্থান নিতে দেখা যাচ্ছে।
যেভাবে থানচি থানায় আক্রমণ
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে তিন দিক থেকে থানচি থানা আক্রমণের চেষ্টা করে কেএনএফ। এর আগে বিকেলে সন্ত্রাসীদের একটি দল পুরো এলাকা রেকি করে। একটি দল থানচি উপজেলার নাইক্ষ্যানপাড়া থেকে চেষ্টা করে থানার দিকে আসার। সেই দলে ছিল ৮০-৯০ জনের সশস্ত্র সন্ত্রাসী। ৩০ জনের সশস্ত্র আরেকটি দল উপজেলার হাসপাতাল রোড দিয়ে থানা আক্রমণ করে। পুলিশ পাল্টা গুলি চালালে উভয় পক্ষে ঘণ্টাখানেক ৪০০ থেকে ৫০০ রাউন্ড গোলাগুলি হয়। পরে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়।
সন্ত্রাসীদের খোঁজে উড়ছে ড্রোন
নিরাপত্তা সূত্র বলছে, কেএনএফ সন্ত্রাসীরা এখনও থানচি থানার এক থেকে দেড় কিলোমিটারের মধ্যে আত্মগোপন করে আছে। ড্রোনের মাধ্যমে তাদের অবস্থান শনাক্ত করার চেষ্টা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। একই সঙ্গে ড্রোন ক্যামেরা দিয়ে জোর নজরদারিও চালানো হচ্ছে। দেখা গেছে, সন্ত্রাসীরা সংগঠিতভাবেই অস্ত্র নিয়ে অবস্থান করছে। তাদের এ ধরনের তৎপরতায় যে কোনো সময় আবার কোথাও আক্রমণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে আক্রমণ প্রতিরোধে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে পুলিশ।
থানচি থানার ওসি জসিম উদ্দিন বলেন, ‘বৃহস্পতিবার রাতে থানচি বাজার ও থানার তিন দিক থেকে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে সন্ত্রাসীরা থানা দখলের চেষ্টা করে। আমরা পাল্টা গুলি চালালে তারা পালিয়ে যায়। কেএনএফ সদস্যরা এখনও থানার এক থেকে দেড় কিলোমিটারের মধ্যে আত্মগোপনে রয়েছে বলে গোয়েন্দা তথ্যে নিশ্চিত হয়েছি। ব্যাংক ডাকাতি, থানা আক্রমণের মতো দুর্ধর্ষ ঘটনার পরও গভীর জঙ্গলে সরে যায়নি কেএনএফ।’
৬ মামলা
এদিকে রুমা ও থানচিতে সোনালী ব্যাংক এবং কৃষি ব্যাংকে ডাকাতির ঘটনায় ৬টি মামলা রেকর্ড করেছে পুলিশ। গতকাল রুমা ও থানচি থানায় মামলাগুলো রেকর্ড করা হয়। মামলার এজাহারে কেএনএফ সন্ত্রাসীদের কথা উল্লেখ থাকলেও নির্দিষ্ট করে কাউকে আসামি করা হয়নি।
সব মামলার এজাহারে অজ্ঞাত চারশ থেকে পাঁচশ আসামির কথা লেখা রয়েছে। তবে এখনও লুট হওয়া অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার হয়নি। গত মঙ্গল ও বুধবার রুমা এবং থানচিতে তিনটি ব্যাংকে ডাকাতির সময় পুলিশ-আনসারের ১৪টি অস্ত্র ও বিপুল পরিমাণ গুলি লুট হয়। এ ঘটনায় থানচি থানায় তিনটি এবং রুমা থানায় তিনটি মামলা হয় বলে নিশ্চিত করেছেন চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি নূর আলম মিনা। তিনি জানান, থানচি থানা আক্রমণ ও আলীকদমে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় আরও দুটি পৃথক মামলার প্রক্রিয়া চলছে।সমকাল