রাঙ্গামাটি:- চারদিকে ছোট-বড় অসংখ্য পাহাড়-টিলা। যত দূর চোখ যায় কেবল সবুজের সমারোহ। প্রকৃতি এখানে একেবারেই শান্ত স্নিগ্ধ। সবুজে মোড়ানো এই জনপদে অর্ধশতাব্দী আগে গোড়াপত্তন হয় পিলারবিহীন নান্দনিক মসজিদের। যেখান থেকে নিয়ম করে দিনে পাঁচবার মুয়াজ্জিনের সুললিত কণ্ঠে উচ্চারিত হয় মহান আল্লাহর মহিমা আজান।
আনুষ্ঠানিক নাম কর্ণফুলী পেপার মিল কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ বা কেপিএম মসজিদ। তবে স্থানীয়দের কাছে এর পরিচিতি ‘বড় মসজিদ’ হিসেবেই। মসজিদটির ভিত্তি স্থাপন হয়েছিল ১৯৬৭ সালের ৮ ডিসেম্বর। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন পাকিস্তানের দাউদ গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান আহমেদ দাউদ এইচ কে-এর মা হাজীয়ানী হানিফা বাঈ। মূলত ১৯৫৯ সালে দাউদ গ্রুপ দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ কাগজ কল কেপিএমের দায়িত্ব নেওয়ার পর মসজিদটি স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
রাঙ্গামাটির কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনা ইউনিয়নের কেপিএম বারঘনিয়া আবাসিক এলাকায় পাহাড়ের ঢালে নির্মিত হয়েছে মসজিদটি। নজরকাড়া বিশেষ স্থাপত্যশৈলীর এই মসজিদটি কেপিএমের শ্রমিক কর্মচারীদের সুবিধার্থে নির্মিত হয়। শুরু থেকেই এই জনপদে ইসলামের আলো জ্বালিয়ে রেখেছে মসজিদটি। মসজিদটির স্থাপনাশৈলী এখনো বিমোহিত করে চলেছে অগণিত মানুষকে। এটি এখন স্থানীয়দের গর্ব আর মর্যাদার প্রতীক হয়ে উঠেছে।
মসজিদটির নির্মাণশৈলীতে রয়েছে মুসলিম ঐতিহ্যের বিভিন্ন নিদর্শন। ৮ হাজার ৪০০ বর্গফুট আয়তনের এই মসজিদের দৈর্ঘ্য ১২০ ফুট আর প্রস্থে ৭০ ফুট। একসঙ্গে ১ হাজার ৭০০ মুসল্লি সালাত আদায় করতে পারেন এই মসজিদে।
তবে মসজিদের মূল আকর্ষণ হচ্ছে চার দেয়াল ছাড়া মাঝে আর কোনো পিলার নেই। বিশাল এই মসজিদের ছাদ ধরে রেখেছে চারপাশের দেয়াল। মাঝে কোথাও পিলার না থাকায় মুসল্লিরা যেখানেই দাঁড়ান না কেন প্রত্যেকেই খতিব কিংবা ইমামকে বাধাহীনভাবে দেখতে পান।
সাধারণত ভবনের ছাদ সমান নির্মাণ করা হয়। কিন্তু এখানে পূর্ব ও পশ্চিমের দেয়াল থেকে আড়াআড়িভাবে ঢেউটিন আকৃতিতে ৯টি বিম দিয়ে ছাদ নির্মাণ করা হয়েছে। ধারণা করা হয় ছাদের চাপ কমাতেই তখনকার প্রকৌশলীরা এই প্রযুক্তি ব্যবহার করেন। ফলে ছাদের জন্য আর বাড়তি স্তম্ভের প্রয়োজন পড়েনি।
মসজিদ নির্মাণের প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পাকিস্তানের করাচি থেকে আনা হয়েছিল মসজিদের নির্মাণসমাগ্রী। আর ভারতের প্রকৌশলীরা এর নির্মাণকাজ করেছেন। নির্মাণকাজ শেষ করতে সময় লেগেছে পুরো এক বছর।
প্রত্যক্ষদর্শীদের একজন বশির খান বলেন, মসজিদটি দাউদ গ্রুপ তৈরি করেছে। করাচি থেকে জাহাজে করে নির্মাণসামগ্রী আনা হয়। বাংলাদেশের কোনো সামগ্রী ব্যবহার করা হয়নি। অবশ্য এখন সংস্কারের প্রয়োজনে বিভিন্ন সামগ্রী ব্যবহার করা হচ্ছে।
সমজিদের মুসল্লি মোসলেহ উদ্দিন বলেন, মসজিদে টিনের মতো করে ঢেউ করে এই ছাদটা তৈরি করা হয়েছে। মাঝখানে কোনো পিলার নেই। এটাই একটা সৌন্দর্য। অনেক লোক দূর-দূরান্ত থেকে এই মসজিদ দেখতে আসেন। বিশেষ করে তাবলিগের লোকেরা আসলে তারা ফিরে গিয়ে প্রচার করেন। এতে আরও লোক বেড়ে যায়। আরেক মুসল্লি মো. খলিলুর রহমান বলেন, খতিব বা ইমাম সাহেব যে দোয়া কালাম বলেন, তা আমরা মসজিদের যেকোনো প্রান্ত থেকেই শুনতে পাই।
মূল মসজিদে প্রবেশের জন্য রয়েছে ৮টি দরজা। কাঠের তৈরি এসব দরজায় এখনো ঝুলছে কাঠের হাতল। মোজাইক করা মেঝে, বিশেষ নকশা করা দেয়াল, একটি গম্বুজ, মিম্বর ও ইমামের জন্য কাঠের চেয়ার রয়েছে ভেতরে। উত্তর দক্ষিণে সাতটি করে ও পশ্চিমে রয়েছে আটটি গম্বুজ আকৃতির দৃষ্টিনন্দন জানালা। এতে পর্যাপ্ত আলো ও প্রাকৃতিক বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা থাকায় ভেতরটা থাকে বেশ শীতল ও আলোময়।
মসজিদের উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব দিক দিয়ে রয়েছে বর্গাকৃতির তিনটি ভিন্ন প্রবেশপথ। এসব প্রবেশ পথের প্রতিটির ওপরে ছাদে রয়েছে চারটি করে অনুচ্চ মিনার। যেখানে স্থাপন করা হয়েছে মাইক। এদের মাঝে রয়েছে মাঝারি ও ছোট আকৃতির বেশ কয়েকটি মিনারও। এ ছাড়া ছাদের তিন দিকেই গম্বুজ আকৃতির ফলক মসজিদের বাহ্যিক সৌন্দর্য বাড়িয়েছে বহুগুণ।
স্বাধীনতার পর কেপিএম কর্তৃপক্ষ মসজিদটির পরিচালনার দায়িত্ব পায়। দীর্ঘ সময় স্বাভাবিকভাবে চললেও কালের বিবর্তনে এখন জৌলুস হারাতে বসেছে খ্যাতি আর গর্বের এই মসজিদ। বর্তমানে ঋণগ্রস্ত কেপিএমের প্রভাব পড়েছে মসজিদেও। এখন কেপিএম ও স্থানীয়দের দানেই নির্বাহ করা হচ্ছে মসজিদটির ব্যয়ভার। মসজিদটির স্বাতন্ত্র অক্ষুণ্ন রেখে সংস্কার ও মসজিদটিকে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
মসজিদের পেশ ইমাম ও খতীব, এ টি এম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘আর্থিক সংগতি না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে মসজিদটির সংস্কার হয়নি। রং ওঠে গিয়ে দেয়ালে শ্যাওলা জমেছে। অনেক স্থানেই দেয়ালে ফাটল ও ভাঙন ধরেছে। বর্ষায় ছাদ চুইয়ে বৃষ্টির পানি পড়ে মেঝেতে। বৃষ্টির পানিতে নষ্ট হয়ে ঝরে পড়ে সিলিং। মেঝেতে পানি জমায় সালাত আদায়ে ভোগান্তিতে পড়েন মুসল্লিরা। খসে পড়া সিলিং আর মেঝের পানিতে পিছলে আহত হয়েছেন অনেক মুসল্লি।’খবরের কাগজ