ডেস্ক রির্পোট:- হাইকোর্টের নির্দেশনা ছাড়া আজ-কাল দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) অনুসন্ধানও শুরু করতে দেখা যায় না। স্বশাসিত স্বাধীন এ সংস্থাটির আচরণে অনেকে মনে করতে পারেন, এটি নির্ঘাত উচ্চ আদালতের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধাবোধ। কিন্তু না। বরং হাইকোর্টের আদেশ-নির্দেশকে তোয়াক্কা না করার নজিরও নেহায়েত কম নেই। নিজের কাঁধে দায় না নেয়ার কৌশল হিসেবে রাষ্ট্রীয় এ সংস্থাটিকে প্রায়ই আদালতের কাঁধে বন্দুক রাখতে দেখা যায়। সর্বশেষ সরকারদলীয় এমপি আব্দুস সালাম মুর্শেদীর বিষয়ে অনুসন্ধান করতে বাধ্য হওয়া এর প্রমাণ। দুদক এ ধরনের প্রমাণ সৃষ্টি করে চলেছে হরহামেশাই।
স্বামীর বিরুদ্ধে করা একটি মামলার প্রতিবেদনে সুপারিশের ভিত্তিতে এক নারীর বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। ওই নারীর স্বামী নৌপরিবহন অধিদফতরের পদস্থ কর্মকর্তা। তাকে ‘দুর্নীতিবাজ’ সাব্যস্ত করার লক্ষ্যে ‘ফাঁদ’ পাতে দুদক। ফাঁদে ফেলে গ্রেফতার করা হয় তার স্বামীকে। মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু সেই মামলার যখন বিচার শুরু হয় তখন উল্টে যায় পাশা। মামলার প্রধান সাক্ষী দাবি করে বসেন, ফাঁদ-কর্মে ব্যবহৃত টাকা তিনি ‘ঘুষ’ হিসেবে ওই কর্মকর্তাকে দেননি। এতে উল্টো ফাঁদে পড়ে দুদক নিজেই। এরপর ফাঁদ পেতে ‘দুর্নীতিবাজ’ পাকড়াওয়ের সহজতম অস্ত্রটি খুব একটা ব্যবহৃত হতে দেখা যায়নি। বিচারে ওই কর্মকর্তাকে কারাগারে নেয়া হলেও বিচারে আইনত তাকে শাস্তি প্রদান অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এ পর্যায়ে ফাঁদ মামলা সংশ্লিষ্ট দুদকের কর্মকর্তা মুখ বাঁচাতে কাজে লাগান উদ্ভাবনী ক্ষমতাকে।
মামলা প্রতিবেদনে প্রস্তাব করেন বিআইডব্লিটিএর কর্মকর্তার স্ত্রীর পৃথক সম্পদ অনুসন্ধানের। বিতর্কিত দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ নেতৃত্বাধীন কমিশনও সেটি অনুমোদন করে। ২০১৯ সালে বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে শুরু হয় ‘অবৈধ সম্পদ অর্জন’-এর (স্মারক নং-০০.০১.২৬০০.৬০৩.০৩.০৩৫.১৯) অনুসন্ধান। সাহেলা নাজমুল নাম্নী ওই নারী পেশায় গৃহিণী। তবে তার টিআইএন নম্বর রয়েছে। সেখানে তিনি ব্যবসায়ী হিসেবে সরকারকে রাজস্ব দিচ্ছেন। সাহেলার সম্পদ অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয়া হয় এক কর্মকর্তাকে। তিনি অনুসন্ধানটি নথিভুক্তির সুপারিশ করেন। এ প্রেক্ষাপটে তাকে পুনঃঅনুসন্ধানের জন্য দায়িত্ব দেয়া হয় দুদকের অনু:-তদন্ত-২ এর উপ-পরিচালক মোহাম্মদ হাফিজুল ইসলামকে। তিনি অভিযোগ সংশ্লিষ্ট সাহেলা নাজমুলকে জিজ্ঞাসাবাদই করেননি। তার দেয়া কাগজপত্রও সঠিকভাবে যাচাই করেননি। সাহেলার তখন আশঙ্কা জাগে যে, তিনি এই অনুসন্ধান কর্মকর্তার কাছ থেকে ন্যায়বিচার পাবেন না। এ প্রেক্ষাপটে তিনি ইও পরিবর্তন চেয়ে কমিশনে আবেদন দেন। এতে কর্ণপাত না করে চলতে থাকে অনুসন্ধান। এ প্রেক্ষাপটে রিট (নং-১৫৫/২০২১) করেন সাহেলা। আদালত সাহেলার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান কার্যক্রম বন্ধে রুল জারিসহ কার্যক্রম স্থগিত করেন। উপ-পরিচালক হাফিজুল ইসলামকেও তলব করেন হাইকোর্ট। পরে দুদকের আপিলের প্রেক্ষিতে ইতঃপূর্বে সাহেলার পক্ষে জারিকৃত রুল খারিজ করে দেয়। খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে সাহেলা আপিল বিভাগে রিভিউ করেন (নং-৮৮/২০২৩)। রিভিউ পেন্ডিং থাকা অবস্থায় সাহেলার বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হাফিজ মামলা{নং-সজেকা ১৪(৭)২৩} ঠুকে দেন। মামলায় প্রয়োগ করা হয় দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ এর ২৬(২) ও ২৭ (১), দণ্ডবিধির ১০৯ ধারা এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারা। ১০৯ ধারায় এতে সহযোগী আসামি করা তার স্বামীকেও। মামলাটির তদন্ত শুরু হয়। কিন্তু অনুসন্ধান পর্যায়ে তার বক্তব্য গ্রহণ না করা এবং কাগজপত্র সঠিকভাবে যাচাই না করায় উপ-পরিচালক হাফিজুল ইসলামকে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ না করার অনুরোধ জানান সাহেলা। এ কর্মকর্তার তদন্তে তিনি ন্যায়বিচার পাবেন নাÑ মর্মে আশঙ্কা প্রকাশ করেন। এছাড়া মামলায় ধরা পড়ে ভয়াবহ রকম ত্রুটি। একই সম্পদ এজাহারে দুইবার দেখানো হয়। স্বামী-স্ত্রীর লেনদেনকেও ‘অর্থপাচার’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। যাকে দিয়ে অনুসন্ধান তাকে দিয়েই তদন্ত করানোর বিষয়ে আপত্তি তুলে আইও পরিবর্তনে অন্তত ৮ বার আবেদন করেন কমিশনে। এমনকি এ বিষয়ে ব্যক্তিগত শুনানিরও আবেদন করেন তিনি। সেটিও আমলে নেয়নি কমিশন। যদিও দুদক আইন-২০০৪ এর ২২ ধারায় ব্যক্তিগত শুনানির বিধান রয়েছে। ‘অভিযুক্ত ব্যক্তির শুনানি’ সংক্রান্ত এ ধারায় বলা হয়েছে, ‘দুর্নীতি বিষয়ক কোনো অভিযোগের অনুসন্ধান বা তদন্ত চলাকালে কমিশন যদি মনে করেন যে, অভিযোগের সহিত সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তির বক্তব্য শ্রবণ করা প্রয়োজন, তাহা হইলে কমিশন উক্ত ব্যক্তিকে শুনানির যুক্তিসঙ্গত সুযোগ প্রদান করিবে। দুদক আইনের আওতায় তিনি আইও পরিবর্তন এবং ব্যক্তিগত শুনানি গ্রহণের জন্য কমিশন বরাবর অন্তত ৮টি চিটি দেন। এতে প্রতিকার না মিললে সাহেলা আবারো আদালতের শরণাপন্ন হন। রিট (নং-৮৯৬৬/২০২৩) করেন তিনি। শুনানি শেষে গত ৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট মোহাম্মদ হাফিজুল ইসলামকে পরিবর্তন করে অন্য যেকোনো কর্মকর্তাকে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগসংক্রান্ত আবেদন ৬০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন। কিন্তু উপ-পরিচালক হাফিজ এ আদেশের তোয়াক্কা না করে বিভিন্ন দফতরে সাহেলার তথ্য-উপাত্ত চাইতে থাকেন (স্মারক নং-০০.০১.২৬০০.৬০৩.০৩.০৩৫.১৯.৬১১০/(১) ।
সর্বশেষ গত ১৩ ফেব্রুয়ারি আটলান্টিক প্রোপার্টিজ অ্যান্ড ডেভলপমেন্টসহ বিভিন্ন দফতরে নোটিশ দেন তিনি। তবে সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন থাকা অবস্থায় দুদক তদন্ত কার্যক্রম অব্যাহত রাখাকে সরাসরি আদালত অবমাননা এবং সংবিধানের লঙ্ঘন বলে মন্তব্য করেন সংস্থাটির সাবেক আইনজীবী সৈয়দ মামুন মাহবুব। তিনি বলেন, উচ্চ আদালতের আদেশ-নির্দেশ দুদকসহ প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক প্রতিপালনে বাধ্য। এখানে ১৫ দিনের মধ্যে অনুসন্ধান প্রতিবেদনের একটি কপি অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রদানের নির্দেশনা ছিল। দুদক সেটি প্রতিপালন করেছে বলে মনে হয় না। এ বিষয়ে তিনি ডিএলআর ১৪ ইখঈ ১ঠ ড়ভ ঝবপঃরড়হ ৪৩৯ এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, রিভিউ পিটিশন পেন্ডিং রেখে অনুসন্ধান কর্মকর্তার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কমিশন কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না।
অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ এ প্রতিবেদককে বলেন, হাইকোর্ট একটি আদেশ দিলে এটি মানতে বাধ্য। আইওপরিবর্তনের আদেশ যদি উচ্চ আদালত দিয়ে থাকে তাহলে সেটি প্রতিপালন না করা আদালত অবমাননা। হয় দুদককে আদেশ মানতে হবে নয়তো আপিল করতে হবে। আপিল না করলে তো বিদ্যমান আদেশ না মানার কোনো বিকল্প দুদকের হাতে নেই।
একই সম্পত্তি দুইবার দেখিয়ে মামলা : আসামির ‘অবৈধ সম্পদ’ দেখাতে গিয়ে এজাহারের ৩ নম্বর সম্পত্তি হিসেবে উল্লেখ করে ঢাকা জেলার তুরাগ থানা ভাটুলিয়া মৌজায় (দাগ নং-১০৬৬) ১৬ দশমিক ৫ শতক জমি। এটির মূল্য দেখানো হয় ২৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। আবার একই জমি ৫ নম্বর সম্পত্তি হিসেবে দেখানো হয়েছে। উত্তরা সাবরেজিস্ট্রি অফিসে রেজিস্ট্রিকৃত উভয় দলিলের নম্বর ১১১১৯/২০১৪। যার অবস্থান ভাটুলিয়া মৌজায় ৩৩ শতাংশ জমি। এখানে শায়েলা নাজমুলের বিরুদ্ধে ২৬ লাখ ৫০ হাজার টাকার তথ্য গোপনের অভিযোগ আনা হয়েছে। দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে তিনি রাজউকের পূর্বাচলে আটলান্টিক মেরিটাইম একাডেমিতে ৬০ লাখ টাকা বিনিয়োগের তথ্য উল্লেখ করেন। কিন্তু কোনো প্রমাণ কিংবা যুক্তি না দেখিয়েই এজাহারে ১০ লাখ টাকার তথ্য গোপনের অভিযোগ আনা হয়েছে। এজাহারের একটি স্থানে জনৈক মো: আব্দুল হান্নানের কাছ থেকে সাহেলা নাজমুল ৩টি চেকের মাধ্যমে ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা গ্রহণ করেছেনÑ মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও এই চেক নগদায়ন করা হয়নি। তাই সম্পদের রূপান্তরিত হয়নি। কিন্তু এজাহারে চেকে উল্লেখিত অঙ্ককে ‘সম্পদের তথ্য গোপন‘ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। স্বামীর কাছ থেকে সাহেলা ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যাংকিং চ্যানেলে ঋণ নেন, যা উভয়ের আয়কর নথিতে উল্লেখ রয়েছে। স্বামী-স্ত্রীর এই লেনদেনকে এজাহারে ‘মানিলন্ডারিং’ গণ্য করা হয়েছে।
এদিকে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট নারী সাহেলার আইনজীবী ব্যারিস্টার হেলাল উদ্দিন বলেন, এখানে একটি কাস্টমস আছে। আপিল বিভাগে একটি বিষয় পেন্ডিং থাকলে সেটি নিয়ে কাজ করা যায় না। কিন্তু দুদক সেটি করছে। এ কারণে দুদকের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা করা যায়। ইনকিলাব