মার্কিন শুনানিতে প্রশ্নের মুখে বাংলাদেশ,পোশাকখাত ফের সঙ্কটের মুখে

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় বুধবার, ১৩ মার্চ, ২০২৪
  • ২০৯ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- কয়েক মাস আগে যুক্তরাষ্ট্র নতুন শ্রমনীতি ঘোষণা করেছে। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক রফতানি করে বাংলাদেশসহ পাঁচ দেশের বিষয়ে শুনানি গত সোমবার ভার্চ্যুয়ালি আয়োজন করে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি সংস্থা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কমিশন (ইউএসআইটিসি)। প্রায় চার ঘণ্টার ওই শুনানির বড় অংশ জুড়ে বিভিন্ন প্রশ্নের মুখে পড়েন বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা। ইউএসআইটিসির চেয়ারম্যান ডেভিড জোহানসন ও তার তিন সহকর্মী বাংলাদেশে শ্রম অধিকার, শ্রম আইন, শ্রমিকদের উৎপাদনের তুলনামূলক দক্ষতা, মজুরিসহ নানা বিষয়ে জানতে চান। মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি দপ্তরের (ইউএসটিআর) অনুরোধে বাংলাদেশসহ এই পাঁচ দেশ নিয়ে তদন্ত শুরু করছে ইউএসআইটিসি। কীভাবে এ দেশগুলো মার্কিন পোশাকশিল্পের বাজারের এত বড় অংশ দখল করে রেখেছে, তা তথ্যানুসন্ধান করে দেখবে কমিশন। এই পাঁচ দেশের কেউ অসুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বাজার দখল করছে কি না, তা খুঁজে বের করাই প্রধান উদ্দেশ্য এ কমিশনের। অন্য চার দেশ হলো ভারত, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তান। বাংলাদেশের রফতানি আয়ের মূল উৎস তৈরি পোশাক খাত, যেখান থেকে বিজিএমইএ’র হিসেবে গেলো বছর এসেছে ৪৭ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। এরমধ্যে একক দেশ হিসেবে সবচেয়ে বেশি আয় এসেছে আমেরিকা থেকে ৭ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার। যদিও এই আয় আগের বছরের চেয়ে ২৫ শতাংশ কম। এমনিতেই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রফতানি কমেছে আবার নতুন করে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার চিন্তা। আর এতে আতঙ্ক বিরাজ করছে দেশের পোশাক খাতে। যা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানিতে আগামী দিনে নেতিবাচক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশ্লেষকদের মতে, আমেরিকার সাথে বাংলাদেশের বর্তমান সমস্যা রাজনৈতিক। তাই ‘কূটনৈতিক’ তৎপরতার মাধ্যমে দ্রুত এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। এদিকে বাংলাদেশে শ্রম আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কারের তাগিদ দিয়েছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থাও (আইএলও)। এ জন্য সরকার ও অংশীজনদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ত্রিপক্ষীয় আলোচনার সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। আইএলও’র এ বার্তাও পোশাক খাতের জন্য অশনিসঙ্কেত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া শ্রমিক অধিকার নিশ্চিতে সরকারের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করছে পোশাক খাতের রফতানি আয়ের আর এক বড় উৎস ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। শিগগিরই এ বিষয়েও তাদের চাপ আসছে বলে মনে করছেন পোশাক খাত সংশ্লিষ্টরা। অপরদিকে দীর্ঘদিন থেকেই পণ্যের দাম নিয়ে চাপে রয়েছে পোশাক খাত। ব্যয়ের অনুপাতে বায়ারদের কাছ থেকে সঠিক দাম পাচ্ছে না। কয়েকদিন আগেও তৈরি পোশাকের ন্যায্য দাম নিশ্চিতে ক্রেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য গত সোমবার এক অনুষ্ঠানে শঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, পোশাক খাতের কিছু হলে দেশের অবস্থা আফ্রিকার যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ অ্যাঙ্গোলার মতো হতে পারে। এ জন্য পোশাক খাত থেকে নির্ভরতা কমিয়ে পণ্য বৈ-চিত্রকরণ করার কথা বলেছেন তিনি। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এক পণ্যের ওপর নির্ভরশীল হলে অবস্থা আফ্রিকার যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ অ্যাঙ্গোলার মতো হবে। তাদের জ্বালানি তেল ছিল। যখন জ্বালানি তেলের দাম পড়ে গেলো, তারাও পড়ে গেলো। পোশাক খাতের যদি কিছু হয় আমাদের অবস্থাও তাদের মতো হবে। এ শিক্ষাটা আমাদের নিতে হবে। আমাদের পণ্য বৈ-চিত্রকরণ করতে হবে, উৎপাদন বাড়াতে হবে।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, কাস্টমস জটিলতা এবং গ্যাস সঙ্কট-এই দুটিই হচ্ছে আমাদের আমদানি-রফতানির জন্য প্রধান বাধা। ইতোমধ্যে পোশাক খাতে নগদ সহায়তা কমানোর ঘোষণা দেয়া হয়েছে। কিন্তু সেই সঙ্গে অন্য কোনো সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়নি। এতে এই খাতে দুশ্চিন্তা বেড়েছে।

বাংলাদেশ তৈরিপোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র প্রথম সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে আমরা পোশাক কারখানার মালিকরা কঠিন সময় পার করছি। অর্ডার নেই, রফতানি নেই, কিন্তু পোশাক তৈরিতে খরচ বেড়েছে। গত ডিসেম্বর থেকে আমাদের ওপর বাড়তি চাপ পড়েছে। কিন্তু এসব পরিস্থিতির জন্য কাউকে দায়ীও করা যাচ্ছে না। পোশাক কারখানার খরচের সঙ্গে আয়ের হিসাব মিলছে না। এভাবে টিকতে না পেরে প্রায় অর্ধেক কারখানা বন্ধের পথে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে আরও প্রভাব পড়বে। কারণ, লোকসান দিয়ে মালিকপক্ষ তো আর বেশি দিন কারখানার উৎপাদন চালু রাখতে পারবে না।

সূত্র মতে, চরম ডলার সঙ্কট, বৈশ্বিক টানাপোড়েন, অভ্যন্তরীণ সঙ্কট আর হঠাৎ করেই প্রণোদনা কমানোর ঘোষণায় দুশ্চিন্তা বেড়েছে পোশাক খাত ঘিরে। এছাড়া দীর্ঘদিন থেকে শিল্প-কারখানায় তীব্র গ্যাস ও বিদ্যুৎ সঙ্কট বিদ্যমান। আর নতুন করে শ্রম অধিকার লঙ্ঘনে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার শঙ্কায় কালো মেঘ দেখা দিয়েছে খাত সংশ্লিষ্টদের মধ্যে।

চট্টগ্রামের দেওয়ানহাটে ডেলমাস গার্মেন্ট প্রাইভেট লিমিটেড জ্যাকেট তৈরির কারখানা। গত এক বছর ধরে প্রতি মাসেই ৫ থেকে ১৫ লাখ টাকা লোকসান দিয়ে চলেছে। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি এ দুই মাসে লোকসানের পরিমাণ আরও বেড়েছে।

কারখানাটির স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ হোসেন বলেন, পরিস্থিতির পরিবর্তন আসবে সেই আশায় লোকসান দিয়ে হলেও কারখানা চালু রেখেছি। তবে এভাবে লোকসান দিয়ে তো আর বেশি দিন কারখানা চালু রাখা সম্ভব না। যদি আরও কয়েক মাস এভাবে লোকসান গুনে কারখানা চালাতে হয়, তাহলে আমার কারখানাটি বন্ধ করে দিতে হবে।

তিনি বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গত বছর ব্যবসায় লোকসান গুনতে হয়েছিল। বৈশ্বিক সেই যুদ্ধাবস্থা এখনো আছে। এবার আবার যুক্ত হয়েছে শ্রমিকদের বর্ধিত বেতন-ভাতা। একে তো অর্ডার নেই, সেই সঙ্গে বর্ধিত বেতন-ভাতা। আমাদের ব্যবসায় বর্তমান পরিস্থিতিকেই তুলে ধরে।

চট্টগ্রামের ক্লিপটন গ্রুপের প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, তৈরি পোশাকশিল্পের অবস্থা গত তিন মাস আগে যে রকম ছিল এখনকার অবস্থা তার থেকেও বেশি নাজুক। ছোট-বড় সব কারখানাতেই অর্ডারের সঙ্কট রয়েছে।

এদিকে গত সোমবার ইউএসআইটিসির শুনানিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বিজিএমইএ লিখিতভাবে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করার পর বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেয়। বাংলাদেশের পক্ষে বেশির ভাগ প্রশ্নেরই উত্তর দিয়েছেন তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান। এ ছাড়া শুনানিতে ২৪ মার্চ পর্যন্ত লিখিত বক্তব্য উপস্থাপনের সুযোগ থাকবে। আর আগামী ৩০ আগস্ট কমিশন তাদের তদন্ত প্রতিবেদন ইউএসটিআরের কাছে হস্তান্তর করবে।

বাংলাদেশের বিষয়ে শুনানির শুরুতে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, বাংলাদেশে গত ১০ বছরে তিন দফায় শ্রমিকদের মজুরি অন্তত ৩১৬ শতাংশ বেড়েছে। তবে পোশাকশিল্পের ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিটে উৎপাদনের খরচ অনেক বেড়েছে।

বাংলাদেশ যে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে আছে সেখানে পণ্যের মূল্যই একমাত্র পূর্বশর্ত নয়। বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সরকার তা নানাভাবে উত্তরণের চেষ্টা করছে।

বাণিজ্যসচিবের পর বিজিএমইএ সভাপতি লিখিত বক্তব্য দেন। এরপর তাদের দুজনের বক্তব্য ধরে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন কমিশনের তিন কমিশনার রোন্ডা শিমিড্টলেইন, জেসন কেয়ার্নস ও এমি কারপেল। তারা শ্রমিকদের মজুরি, ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার, কাজের পরিবেশ, স্বাস্থ্যসেবা, জীবন বিমাব্যবস্থাসহ বেশ কিছু জানতে চান। এ সময় বিজিএমইএ সভাপতি অধিকাংশ প্রশ্নের উত্তর দেন।

ইউএসআইটিসির এক কমিশনার বাংলাদেশের কর্মীদের গড় কাজের দক্ষতা ও উৎপাদন ক্ষমতা কম্বোডিয়ার চেয়ে বেশি কি না, জানতে চান। এমনকি বাংলাদেশের কর্মীরা কম্বোডিয়ার চেয়ে কম মজুরি পাওয়ার পরও বেশি পণ্য উৎপাদনে সক্ষম কি না, প্রশ্নে করেন। এ সময় ফারুক হাসান বলেন, কম্বোডিয়ার তুলনায় বাংলাদেশের কর্মীদের কর্মদক্ষতা বেশি কি না, সেটা বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের মালিকেরা গত ২০ বছরে আধুনিক প্রযুক্তির মেশিনে বিপুল বিনিয়োগ করেছে। বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক মেশিনের মাধ্যমে বাংলাদেশের পোশাক উৎপাদিত হয়। বাংলাদেশের কর্মীদের কায়িক শ্রমের পরিমাণ একেবারেই ন্যূনতম। যদিও বাংলাদেশের কর্মীদের উৎপাদনের ক্ষেত্রে দক্ষতা চীন, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার তুলনায় কম।

গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল ঢাকা সফর করে। ওই সফরের সময় তারা বাংলাদেশের শ্রম পরিস্থিতির উন্নতির ওপর জোর দেয়। তারা বিশেষ করে শ্রমিকদের সমাবেশ এবং ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার, ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন প্রক্রিয়ার আইন সংশোধন নিয়ে সরকারের সঙ্গে মুক্ত আলোচনার মতো বিষয়গুলো নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং সেগুলো সরকারের সঙ্গে আলোচনায় তুলে ধরেছিল।

গত বছরের নভেম্বরের মাঝামাঝি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেন, বিশ্বজুড়ে যারা শ্রমিক অধিকার হরণ করবে, শ্রমিকদের ভয়ভীতি দেখাবে এবং আক্রমণ করবে, তাদের ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞাসহ নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেবে যুক্তরাষ্ট্র। আর এ নীতি ঘোষণার পর দেশটিতে থাকা বাংলাদেশ দূতাবাস নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা করে বাংলাদেশ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠিও দিয়েছে।

এ বিষয়গুলোতে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন গণমাধ্যমকে বলেছেন, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়েছে যে এ তদন্ত যদি বস্তুনিষ্ঠ ভিত্তিতে করা হয়, সেটি তারা করতেই পারে। এ তদন্তে যাতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য না থাকে, সেটি প্রত্যাশা করে ঢাকা। শুনানিতে বাংলাদেশ তার অবস্থান তুলে ধরেছে। আর যদি প্রতিযোগিতাবিরোধী কিছু তদন্তে উঠে আসে, তাহলে তা আমলে নেবে বাংলাদেশ।

ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলাম বলেন, শ্রম অধিকার লঙ্ঘনে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপের যে নতুন নীতি যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করেছে, তা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানিতে নেতিবাচক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বর্তমান বিষয়টি পুরোপুরি আমি মনে করি রাজনৈতিক। তাই এটি সরকারের উচিত হবে ‘কূটনৈতিক’ তৎপরতার মাধ্যমে দ্রুত এর সমাধানে কাজ করা। কারণ যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পোশাক খাতের সবচেয়ে বড় রফতানির বাজার।ইনকিলাব

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions